মঙ্গলবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাহাবায়ে কেরামদের মর্যাদা

মুফতি মাওলানা মুহাম্মাদ এহছানুল হক মুজাদ্দেদী

সাহাবায়ে কেরামদের মর্যাদা

আরবি ‘সুহবত’ শব্দ থেকে ‘সাহাবি’ শব্দটি এসেছে। আভিধানিক অর্থ সঙ্গী, সাথী, সহচর। ইসলামী পরিভাষায় ‘সাহাবা’ শব্দটি দ্বারা রসুলুল্লাহ (সা.)-এর মহান সঙ্গী-সাথীদের বোঝায়। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) ‘আল-ইসাবা ফি তাময়িযিস সাহাবা’ গ্রন্থে সাহাবির পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘সাহাবি সেই ব্যক্তি, যিনি রসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ইমান সহকারে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন এবং ইসলামের ওপরই ইন্তেকাল করেছেন। সাহাবিগণ সত্যের, ন্যায়ের মাপকাঠি। একেকজন আকাশের এক একটি তারকার মতো। তাদের পরস্পরের মধ্যে মর্যাদা হিসেবে স্তর-ভেদ থাকতে পারে, কিন্তু পরবর্তী যুগের এমন কোনো মুসলমান, তা তিনি যত বড় জ্ঞানী, গুণী ও সাধক হোন না কেন কেউই একজন সাহাবির মর্যাদাও লাভ করতে পারেন না। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা একমত। স্মরণীয় যে, সাহাবিরাই রসুল (সা.) ও তাঁর উম্মতের মধ্যে প্রথম মধ্যসূত্র। পরবর্তী উম্মত আল্লাহর কালাম পবিত্র কোরআন, কোরআনের ব্যাখ্যা, আল্লাহর রসুলের পরিচয়, তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, মোটকথা দীনের সব কিছুই একমাত্র তাদেরই সূত্রে, তাদেরই মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। সুতরাং এই প্রথম সূত্র উপেক্ষা করলে, বাদ দিলে অথবা তাদের প্রতি অবিশ্বাস সৃষ্টি হলে দীন, শরিয়তের মূল ভিত্তিই ধসে পড়ে। কোরআন ও হাদিসের প্রতি অবিশ্বাস দানা বেঁধে ওঠে।

কোনো কোনো সাহাবির জীবদ্দশায় রসুল (সা.) তাদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। তবে মুসলিম আলেমগণ সাহাবিদের সবাইকে জান্নাতি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইবনে হাজার ‘আল ইসাবা’ গ্রন্থে স্পেনের ইমাম ইবনে হাজামের মন্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আস-সাহাবাতু কুল্লুহুম মিন আহলিল জান্নাতি কাতআন।’ অর্থাৎ, ‘সাহাবিদের সবাই নিশ্চিতভাবে জান্নাতি।’ সাহাবিদের গালি দেওয়া বা হেয়প্রতিপন্ন করা কিংবা সমালোচনা করা সম্পূর্ণ হারাম। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমার পরে তোমরা তাদের সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত কর না। তাদের যারা ভালোবাসে, আমার মোহাব্বতের খাতিরেই তারা ভালোবাসে আর যারা তাদের হিংসা করে, আমার প্রতিহিংসার কারণেই তারা তা করে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ)।

হজরত ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন তোমরা ওই লোকদের দেখবে যারা আমার সাহাবিদের গালমন্দ করে তখন তোমরা বলবে, তোমাদের প্রতি আল্লাহতায়ালার লানত, তোমাদের এ মন্দ আচরণের জন্য। (তিরমিজি)। সাহাবিদের মর্যাদা ও তাদের ফজিলত সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ইমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে। তারাই (সাহাবিগণ) সত্যনিষ্ঠ বা সত্যবাদী।’ (হুজুরাত-১৫)। ‘এমন সব লোকই (সাহাবিরা) সত্যিকারের মুমিন (যাদের ভিতর ও বাহির এক রকম এবং মুখ ও অন্তর ঐক্যবদ্ধ)। তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদিগারের কাছে সুউচ্চ মর্যাদা ও মাগফিরাত এবং সম্মানজনক রিজিক। (আনফাল-৪)। সাহাবিদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল; তাঁর সহচরগণ, কাফিরদের ওপর কঠোর এবং নিজেদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদের রুকু ও সিজদায় অবনত দেখবে। তাদের মুখমণ্ডলে সিজদার চিহ্ন থাকবে, তাওরাতে তাদের অনুরূপ গুণাবলির বর্ণনা এবং ইঞ্জিলেও রয়েছে তাদের অনুরূপ গুণাবলি।’ (আল ফাতাহ-২৯)। ‘মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাতে সন্তুষ্ট এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন জান্নাত, যার নিম্নদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। এটা মহা কামিয়াবি। (আততাওবা-১০০) আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারা তার (আল্লাহর) ওপর সন্তুষ্ট। এটা তার জন্য, যে আপন প্রতিপালককে ভয় করে। (বাইয়্যেনাহ, ০৮)। সাহাবিদের মহান মর্যাদা সম্পর্কে এসেছে অসংখ্য হাদিস। তার মধ্য থেকে কয়েকটি উল্লেখ করছি। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা আমার সাহাবিগণকে গালমন্দ কর না। কেননা তারা এমন শক্তিশালী ইমান ও সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী, তোমাদের কেউ যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর, তবুও তাদের এক মুদ (৩ ছটাক প্রায়) কিংবা অর্ধমুদ যব খরচের সমান সাওয়াবে পৌঁছতে পারে না। (বুখারি : ৩৩৯৭)। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘জাহান্নামের আগুন সে মুসলমানকে স্পর্শ করতে পারে না, যে আমাকে দেখেছে অর্থাৎ আমার সাহাবিরা কিংবা আমাকে যারা দেখেছে তাদের দেখেছে অর্থাৎ তাবেয়িরা।’ (তিরমিজি : ৩৮০১)। আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে আমার সাহাবিদের কষ্ট দিল সে যেন আমাকে কষ্ট দিল; যে আমাকে কষ্ট দিল সে যেন আল্লাহকে কষ্ট দিল; যে আল্লাহকে কষ্ট দিল অচিরেই আল্লাহ তাকে পাকড়াও করবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৯৬৪১)। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বিদায় হজের দিন আরাফাতের ময়দানে রসুল (সা.)-কে কাসওয়া উষ্ট্রের ওপর আরোহণ অবস্থায় উপদেশ প্রদান করতে দেখেছি, হে মানুষগণ! আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি যার অনুসরণ ও অনুকরণ করলে তোমরা অবশ্যই পথহারা হবে না। তা হলো আল্লাহপাকের কিতাব ও আহলে বাইত (তিরমিজি)। সাহাবিদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা অনুকরণ অনুসরণ করা প্রত্যেক মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাই আমরা আমাদের অন্তর, প্রেম দিয়ে রসুলে করিম (সা.)-এর সাহাবিদের ভালোবাসব। মহান আল্লাহ আমাদের সব সাহাবিকে ফায়জ ও বরকত দান করুন।  আমিন! বিহুরমাতি সাইয়্যেদিল মুরছালিন।

লেখক : মুফাসসিরে কোরআন, বেতার, টিভির ইসলামী উপস্থাপক, প্রিন্সিপাল, মনিপুর বাইতুর রওশন মাদ্রাসা কমপ্লেক্স, মিরপুর, ঢাকা।

 

সর্বশেষ খবর