শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আমাদের লড়াইয়ের সাহসী সাথী দীপ্তি লোহানী

কামাল লোহানী

কেউ রাজনীতি করেন সরবে, কেউবা নীরবে; পর্দার অন্তরালে থেকে। এরা হন প্রচারবিমুখ। তাই তাদের কর্মতৎপরতা এবং রাজনীতি সচেতনতার কাহিনী আমরা জানি না। কারণ কেউ খুব একটা বলেন না এদের কথা। এমনই একজনার কথা আজ আমি তারই ঘনিষ্ঠজন হিসেবে, সহযোদ্ধা হিসেবে বলছি। তিনি দীপ্তি লোহানী। ব্যক্তিগত জীবনে আমার সহধর্মিণীও বটে। কিন্তু দক্ষ শিক্ষয়ত্রী হিসেবেও অগণিত ছাত্রছাত্রীর প্রিয়ভাজন এবং গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের জনপ্রিয় বৌদি হয়ে রয়েছেন। ২৪ নভেম্বর তার একাশিতে পৌঁছাবার দিন আর দশম মৃত্যুবার্ষিকীও। একাত্তর বছর বয়সে ২০০৭ সালে এই দিনে প্রয়াত হন তিনি।

দীপ্তি লোহানীর শিক্ষকতা ছিল পেশা আর সংসার ছিল কর্তব্য। কিন্তু এসব পালন করেও তিনি যে মানুষের অধিকার আদায়ে সহায়ক শক্তি হিসেবে সদাব্যস্ত থাকতেন, সে কথা আমি ভুলি কেমনে! আমার ছিল সাংবাদিকতার পেশা, আর তখনকার সময়ে পত্রিকার সাংবাদিকতা রাত আড়াইটা তিনটে পর্যন্ত করতে হতো। আমার আবার রাজনীতি ছিল, ছিল সাংবাদিক ইউনিয়ন। পরিবারে সময় দেওয়া ছিল সীমিত, তাই দীপ্তি ছিলেন সার্বক্ষণিক। এখন ভাবী, এর মধ্যেও সবকিছু সামাল দিয়ে কী করে যে রাজনীতির উপাচার সামলাতেন! ভাবী আর বিস্ময় মানি। আমাকে কখনো কাজ দিয়ে ব্যস্ত রাখতে চাইতেন না, আমি যা করি, তাই যেন ঠিকমতো করতে পারি, তাই কায়মনে চাইতেন। আর সে কারণেই আমি ‘কামাল লোহানী’ হতে পেরেছি।

আমার কারণে দীপ্তিকে যে ঝামেলা পোহাতে হতো, তার অন্ত ছিল না। আজ ‘ক্রান্তি’ শিল্পীগোষ্ঠীর সভা, কখনো অগণিত শিল্পী নিয়ে শেখ লুত্ফর রহমানের, আলতাফ মাহমুদ অথবা লতিফ ভাইয়ের রিহার্সেল। ছোট বাসায় এত বড় রিহার্সেল আয়োজন-আপ্যায়ন; কোনো বিরক্তি ছিল না তার। আবার টঙ্গীর শ্রমিক নেতাদের পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গোপন বৈঠকের আস্তানা ছিল দীপ্তির বাসা। ওই মার্শাল ল’র আইয়ুবী আমলে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা আত্মগোপনকারী কমরেড দেবেন শিকদার আসতেন, তাকেই সব সামাল দিতে হতো। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের ছাত্রছাত্রী বন্ধুদের আবদারও কম ছিল না। হরহামেশাই অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। ১৯৬২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের মুখে আমার নামে হুলিয়া জারি হলে মাঝরাত ৩টায় গ্রেফতার হয়ে গেলাম। ঘরে দীপ্তি একা, আমাদের মাত্র তেরো দিনের প্রথম সন্তান সাগর। গোয়েন্দা বিভাগের কী জ্বালাতনই না প্রতিদিন সইতে হয়েছে তাকে। মাঝে অনেক কথা, ছেড়েই দিলাম সেসব। ১৯৬৯ সালে প্রচণ্ড গণবিস্ফোরণ।

আসাদ-মতিয়ুর হত্যা। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা আইয়ুবী শাসকগোষ্ঠীর ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় আগুন দেবে। কেরোসিন চাই। আমাদের নয়াপল্টনের বাসা থেকে একটি জেরিক্যানে তা সরবরাহ করলেন দীপ্তি আর আমার শাশুড়ি। আর সব কথা বাদে ১৯৭১ সালে তার সাহসী ভূমিকার কথা না বললেই নয়। আমি তো চলে গেছি বাসা ছেড়ে অনিশ্চিতের পথে কবে মুক্তিযুদ্ধে। দীপ্তির বড় ভাই সৈয়দ মনজুর হোসেন আমার শাশুড়ি ও সাগর-বন্যা দুই শিশুকে নিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন আগরতলায়। দীপ্তি আর ছোট মেয়ে উর্মি তখন মতিঝিল কলোনির বাসায় একা, স্কুলে যায়-আসে। আচানক মতিঝিল সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলে মিলিটারির হানা দীপ্তির খোঁজে। কিন্তু দীপ্তির স্কুল শুরু ১১টার পর। তাই আর্মি ওকে পায়নি, তবে হেড মিস্ট্রেস রওশন সালেহাকে বলে গেছে, এলেই খবর দিতে। দীপ্তি মেয়েকে নিয়ে স্কুলে পৌঁছলে বললেন, ‘তুমি এখনই স্কুল ছেড়ে পালাও, বাসায় যেও না, অন্য কোথাও থাকার ব্যবস্থা করো’।... দীপ্তি তখন ক্রান্তির শিল্পী আনজুম-কুসুমদের বাড়ি চলে গেলেন এবং আত্মগোপনে থাকলেন ২-৩ সপ্তাহ।

কেন তাকে খুঁজল সেনাবাহিনী? তার কারণ হলো, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, যারা ‘বিচ্ছু’ নামে পরিচিত তাদের মধ্যে বিনু, ফেরদৌস, স্বপন ক’জন তরুণ তো বটেই, আরও কেউ কেউ দিনের বেলা নিজেদের সব অস্ত্র কলোনির তিনতলায় ‘ডাম্প’ করে বেরিয়ে যেত ‘র‌্যাকি’ করতে। সূর্যাস্তের পর রাতের অন্ধকারে ওই দুরন্ত তরুণরা টার্গেট অনুযায়ী অভিযান চালানো শেষে ফিরে আসত এই ডেরায়।... কলোনির ফ্ল্যাটের পাশেই থাকতেন সরকারি কর্মচারী, তিনি এই খবরটি দিয়েছিলেন বলেই বিপর্যয়ে পড়তে হয়েছিল।... অবশেষে দীপ্তি লোহানী ছোট মেয়েকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দাদাও এবার তাকে সহযোগিতা করে আগরতলা পৌঁছে দেন। সিপিএমের নেতা নৃপেন চক্রবর্তীর বাসায় আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রবের সহায়তায় কলকাতা পৌঁছান। এখানে তিনি তার নতুন প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি কথিকা রচনা ও পাঠের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখযোগ্য দুটি কথিকার কথা মনে পড়ছে আজ। একটি ১৬ ডিসেম্বর সকালের অধিবেশনে প্রচারিত হয়েছিল। শিরোনামটি কাকতালীয়ভাবে দিনের সফলতার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। শিরোনাম ছিল ‘ঢাকায় স্বাধীনতার সূর্য’। এই দিন বিকালেই তো পাকিস্তানি ‘দুর্ধর্ষ’ সেনাবাহিনীর হায়েনারা মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এর কদিন পর দীপ্তি আবার লিখলেন : ‘নেতাকে ফিরিয়ে আনবই’। দুটি লেখাই সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে ছিল বলে মানুষের মনে দাগ কেটেছিল। বোধ হয় একেই বলে নীরব বন্ধু কর্মীর দুঃসাহসী কর্মপ্রয়াস। মনে পড়ে, আমি ঢাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদসহ ১০-১২ জন কলোনির বাড়িতে উঠেছিলাম। কী করে যে তিনি সামাল দিয়েছিলেন ওই ছোট ঘরে ভেবে অবাক হই। সবটা সময় তাকে কিন্তু সংকটে-সমস্যায় একা সাহস নিয়ে মোকাবিলা করতে হয়েছে। কারণ যাওয়ার সময় তাদের ফেলেই আমি চলে গিয়েছিলাম। আবার আসার সময়ও কলকাতায় পরিবারকে একাকী ফেলে চলে এসেছিলাম উল্লাসে-দায়িত্বে। সবার ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমার সঙ্গে ঘর বাঁধায় দীপ্তিকে কত যে বিড়ম্বনা ও যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আর আজ সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার খানসন্তলা গ্রামে আমাদের অঞ্চলের একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শায়িত রয়েছেন। তার প্রতি আমাদের চিরন্তন শ্রদ্ধা।

সর্বশেষ খবর