শনিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

লোকটি যে ধামাধরা তা বুঝবেন কীভাবে

গোলাম মাওলা রনি

লোকটি যে ধামাধরা তা বুঝবেন কীভাবে

আরও অনেক সমার্থক শব্দের সঙ্গে আমরা ধামাধরা নামক অতি আশ্চর্য শব্দটিকে প্রায়ই গুলিয়ে ফেলি। মোসাহেব, দালাল, চাটুকার, ভাঁড় ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে ধামাধরার যেমন বৈশিষ্ট্যগত অমিল রয়েছে তেমনি টাউট, বাটপাড়, লুটেরা ইত্যাদির সঙ্গে শব্দটির কোনো মৌলিক মিল নেই। বাংলা ব্যাকরণমতে, ধামাধরা শব্দটি একাধারে ক্রিয়াপদ ও বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার আগে ধামার অর্থ নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা প্রয়োজন। আবহমান বাংলায় বেতের তৈরি বিশেষ আকৃতির পাত্রকে ধামা বলা হয়। বাঁশের তৈরি একই আকৃতির পাত্রকে বলা হয় সাজি। ধামা সাধারণত দুটি প্রধান উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো। প্রথমত, পণ্যের পরিমাণ পরিমাপ করার একক হিসেবে এবং দ্বিতীয়ত, পণ্য আনা-নেওয়া, ধারণ ও পরিবহনের জন্য। গ্রাম বাংলায় ধামার আকৃতির বিশালত্ব দ্বারা গৃহস্থের সংগতি ও আর্থিক জৌলুস বোঝা যেত।

ধামাধরা শব্দটি বাংলা ভাষায় বাগ্ধারা রূপে কখন এবং কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হলো তার কোনো হদিস ভাষাবিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি। ক্রিয়াপদ রূপে ধামাধরার ব্যবহার খুবই সীমিত। অন্যদিকে ব্যঙ্গাত্মক শব্দ হিসেবে এটির ব্যাপ্তি রীতিমতো বিস্ময়কর। গ্রাম বাংলায় যদি অসম কিছু দৃশ্যমান হতো তবে লোকজন ব্যঙ্গ করে ধামাধরা শব্দটি ব্যবহার করত। যেমন ধনবান লোকের যদি চর্বিবহুল বিরাট আকৃতির পেট হতো তবে বলা হতো লোকটির নুন্দি হইছে! অন্যদিকে গরিব মানুষের বড় পেট দেখলে লোকজন মশকরা করে বলত কীরে ব্যাডা! ধামার মতো প্যাট নিয়া যাস কই! কালের বিবর্তনে ধামা নিয়ে প্রমিত বাংলায় কতগুলো শব্দ দ্ব্যর্থবোধক অর্থ নিয়ে বাগ্ধারা রূপ স্থান করে নেয়। ধামাচাপা দেওয়া, ধামাধরা, ধামী, ধামালী, ধামাল, ধামার ইত্যাদি শব্দমালা ধামা থেকে সৃষ্টি হয়ে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যভাণ্ডারকে বেশ সমৃদ্ধ করে তুলেছে।

এবার আজকের প্রসঙ্গে আসা যাক। ধামাধরা প্রকৃতির মানুষ বলতে সাধারণ অর্থে মোসাহেব, দালাল বা চাটুকার বোঝালেও আদি ও আসল ধামাধরার কতগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ধামাধরারা সাধারণত হিসাব করে চলেন এবং তারা তাদের কর্মের ফলাফল কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে ছাড়েন। কোনো ছোটখাটো স্বার্থের জন্য ধামাধরারা যেমন পণ্ডশ্রম করেন না তেমনি অল্প প্রতিদানের আশায় তারা কারও কাছে নিজেদের ধামাটি মেলে ধরেন না। তারা চোর নন, কিংবা ডাকাতও নন। তবে সাধু-সন্ন্যাসীও নন। তারা যথেষ্ট ক্ষমতাশালী হয়ে থাকেন। তবে ধামাধরা চরিত্রের কারণে রাজা-উজির, সেনাপতি বা কোতোয়াল পদে টিকতে পারেন না। ধামাধরারা কোনো দিন দরিদ্র, অসহায়, কিংবা ছিন্নমূল প্রকৃতির হন না। তারা বিত্ত ও বৈভবের মাঝে থেকেই দরিদ্রের মতো নিচু মন ও অপরাধীর মতো পলায়নপর প্রকৃতির হয়ে থাকেন। তারা কাউকে বিশ্বাস করেন না, আবার তাদেরও কেউ বিশ্বাস করেন না। অথচ লেগে থাকার অসম্ভব অভ্যাস ও সীমাহীন নির্লজ্জ বেহায়াপনার জন্য তাদের বাদ দিয়ে সমাজ, সংসার ও রাষ্ট্র একদম চলতে পারে না।

ধামাধরারা সাধারণত গ্রহীতা হয়ে থাকেন। দয়া-দাক্ষিণ্য, সাহায্য-সহযোগিতা ইত্যাদি তাদের ডিকশনারিতে থাকে না। তারা কখনো দাতা হতে না পারলেও বড় বড় দাতা ও দাতব্য কাজ তাদের ভারি পছন্দ। সময় ও সুযোগমতো ধামাটি এগিয়ে ধরে তা পূর্ণ করে নিরাপদে সরে পড়ার আগে তারা দাতা ও দাতব্য কাজের সর্বনাশ করে ছাড়েন। মানুষের রোগ-বালাইয়ের মধ্যে ক্যান্সার ও প্লেগের সঙ্গেই ধামাধরাদের মোটামুটি তুলনা করা চলে। তারা ক্যান্সারের মতো প্রভাবশালী ধনাঢ্য অথবা ক্ষমতাশালী, রাজা-বাদশাহ, উজির-নাজির, সেনাপতি, কোতোয়াল, আমির-ওমরাহ প্রমুখের শরীরে বাসা বাঁধেন। তারা ধীরেসুস্থে ক্যান্সারের মতো ভর করা ব্যক্তির প্রাণরস খেয়ে ফেলেন এবং তাদের যমদূতের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে তারপর ধামা নিয়ে আপন আলোয় ফিরে আসেন।

ধামাধরারা প্লেগের মতোই তাদের আরাধ্য লোকটির ওপর ভর করেন। তারপর ধীরে ধীরে লোকটির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে এমনভাবে মিশে যান যাতে শয়নে, স্বপনে, আহারে-বিহারে ধামাধরা ছাড়া তার জীবনটি অচল হয়ে যায়। প্লেগের জীবাণু যেভাবে নাক দিয়ে ফুসফুসে ঢোকে তদ্রূপ ধামাধরারাও নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে দানবদেহের ফুসফুস, রক্তনালি, মন ও মস্তিষ্কে ঢুকে পড়েন। ফলে লোকটির শরীর-মন মস্তিষ্কে ধামাধরার অসংখ্য প্রতিচ্ছবি এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মূর্তি বা পুতলি ঢুকে পড়ে। পরবর্তীতে প্লেগের মতো ফুসফুসকে ছিদ্র করার পাশাপাশি ধমনীর রক্ত চলাচলের পথে আপন পুতলি স্থাপন করে জীবনকে স্তব্ধ করে দেন। তারা মানুষের মনের মধ্যে শয়তানের মতো দাপিয়ে বেড়ান এবং মস্তিষ্কে লম্ফঝম্ফ করে মানুষের চাহিদা ও আচরণকে সর্বগ্রাসী রাক্ষুসে বানিয়ে ফেলেন।

ধামাধরাদের কোনো মানবিক সত্তা থাকে না। দয়া-মায়া-প্রেম-ভালোবাসা, দায়িত্ব-কর্তব্য নীতি-নৈতিকতা প্রভৃতি মানবিক গুণকে তারা ধামার নিচে চাপা দিয়ে স্বার্থ উদ্ধারে ধামা নিয়ে এগিয়ে যান কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে। তারা নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য এতটাই নিষ্ঠুর ও নির্মম হতে পারেন যার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কোনো নিকৃষ্ট জন্তু-জানোয়ার, কীট-পতঙ্গ বা অদৃশ্য প্রাণী ত্রিভুবনে পয়দা হয়নি। তারা যার বরাবরে ধামা ধরে থাকেন তার রক্ত-মাংস এবং হৃপিণ্ড যদি ধামার মধ্যে সমর্পণ করা হয় তবুও ধামাধরার মন ভরবে না। লোকটির প্রাণবায়ু যতক্ষণ পর্যন্ত ধামার মধ্যে সমর্পিত হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ধামাধরারা তাদের নিষ্কৃতি দেন না।

ধামাধরা শ্রেণির মানুষ কোনো দিন দুর্বল ও অসহায় থাকেন না। আবার সত্যিকার অর্থে তারা শক্তিশালীও নন। অন্যের ওপর ভর করে তারা সুকৌশলে হম্বিতম্বি করেন এবং ক্ষমতার দাপট দেখান। তাদের অবস্থা অনেকটা হৃষ্টপুষ্ট পরগাছার মতো সেটি কিনা বৃহৎ কোনো বটবৃক্ষ অথবা অট্টালিকার ওপর জন্ম নিয়ে অবাধে জন্মস্থানের রস হরণ করে অবলীলায় বেড়ে ওঠে। তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান এবং মিথ্যার বেসাতি করতে অতিশয় দক্ষ হয়ে থাকেন। আপন প্রভুর মনোরঞ্জনের সব কৌশল যেমন তাদের মুখস্থ তেমনি প্রভুর দুর্বলতা, অক্ষমতা এবং গোপন লীলাখেলা সম্পর্কে সম্যক অবগত থাকেন। মোসাহেব, দালাল ও চাটুকারদের সঙ্গে ধামাধরার মৌলিক পার্থক্য হলো ধামাধরারা সর্বদা তাদের মালিককে জিম্মি করে ফেলেন এবং মালিকের দুর্বলতাকে পুঁজি বানিয়ে ফায়দা লুটে নেন। অন্যদিকে মোসাহেব, দালাল ও চাটুকাররা কোনো দিন আপন মালিককে জিম্মি করে না; মালিকের স্বার্থ বিক্রি করে না কিংবা মালিকের সঙ্গে বেইমানি ও মোনাফেকি করে না। তারা কেবল মালিকের মনোরঞ্জন করে আপন স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালান।

ধামাধরারা কোনো দিন ইতিহাস গড়তে জানেন না। তারা কোনো দিন কিংবা কোনোকালে ইতিহাসের অংশ হতে পারেন না এবং অনাগত দিনেও পারবেন না। ফলে উল্লেখ করার মতো কোনো ঐতিহাসিক ধামাধরার চরিত্র ইতিহাসে নেই। বেইমান, মোনাফেক, বিশ্বাসঘাতক, মোসাহেব, চাটুকার প্রভৃতি অনেকের নাম ইতিহাসে লিখিত থাকলেও এই তালিকায় ধামাধরারা নেই। কারণ তারা ইতিহাসকে পাড়িয়ে ধারণ এবং চলমান ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেন। অনাগত ইতিহাস রুখে দিয়ে ফলবানকে নিষ্ফল, উর্বরকে অনুর্বর এবং উচ্ছল প্রাণবন্ত প্রাণীকে প্রাণহীন করে দেন। ফলে তাদের নির্ভর করা নিঃশেষিত মানুষটির নাম ইতিহাসে থাকলেও ধামাধরারা সর্বদা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যান। কারণ, মানুষ তাদের অভিশাপ দেওয়ার জন্যও মনে রাখে না।

আমরা এতক্ষণ ধামাধরার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করলাম। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে ধারণা দিয়ে ধামাধরার একটি বাস্তব অবস্থা বর্ণনার জন্য ব্রিটিশ আমলের একটি গল্প বলে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানব। আপনার আশপাশের লোকজনের মধ্যে কে ধামাধরা প্রকৃতির তা বোঝার জন্য প্রথমেই আপনি বিত্তবান ও ক্ষমতাবান লোকদের দিকে তাকান। যারা খুব সহজে এবং দ্রুততম সময়ে হঠাৎ করেই প্রচুর অর্থকড়ির মালিক বনে গিয়েছেন কিন্তু অর্থকড়ি খরচের বিষয়ে শিক্ষা-দীক্ষা ও সংযম অর্জন করেননি তাদের কাছে সহজেই ধামাধরারা পৌঁছে যেতে পারেন। তারা লোকটির চরিত্র নষ্ট করার জন্য মদ, যৌবনতা এবং জুয়ার আয়োজনের পাশাপাশি তার মনে এক ধরনের ভীতি, আত্মতৃপ্তি ও অহংকার ঢুকিয়ে দেন। এই শ্রেণির ধামাধরারা সাধারণত শিক্ষিত, রাষ্ট্রীয় পদ-পদবিধারী অথবা প্রভাবশালী সমাজপতি প্রকৃতির হয়ে থাকেন।

নতুন টাকাওয়ালাদের জিম্মি করা ধামাধরারা সাধারণত চরিত্রহীন, চটপটে ও আকর্ষণীয় প্রকৃতির মানুষ হয়ে থাকেন। নিজেদের মন্দ কর্মের দক্ষতা এবং অবৈধ ভোগ-বিলাসের রসাল গল্প বলে তারা নব্য ধনীদের মনে লোভ, লালসা, কামনা-বাসনা ও ঈর্ষা জাগিয়ে তোলেন। ফলে ধনীরা অকাতরে তাদের ধন-সম্পত্তি কুকাজে ব্যয় করতে করতে কখন যে ধামাধরাদের ধামা পূর্ণ করে নিজেরা নিঃস্ব, রিক্ত ও অসহায় হয়ে পড়েন তা বুঝতে পারেন না। বড় বড় ধামাধরারা সাধারণত রাষ্ট্রক্ষমতাধারীদের ওপর ভর করার জন্য চেষ্টা তদবির চালান। এরা কেউ বা পরিচয়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং অর্থবিত্তে বেশ উঁচু স্থানে অবস্থান করেন। চমক সৃষ্টি করা অভিনব পরিকল্পনা, নিত্যনতুন ফন্দি ও লুটপাট করার বিস্ময়কর মন্ত্রণা প্রদান করে তারা ক্ষমতাধারী ব্যক্তির মাথা খারাপ করে দেন এবং তার ভিতরকার লোভী মানুষটির বিষাক্ত লিকলিকে জিহ্বাটি টেনে হিঁচড়ে জনসম্মুখে বের করে নিয়ে আসেন। ফলে সব বদনাম গিয়ে পড়ে ক্ষমতাধারীর ওপর এবং মাঝখান থেকে ধামাধরার ধামা পূর্ণ হতে থাকে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে। ক্ষমতাবানরা সব সময়ই তাদের ধামাধরাদের আপন চাদরে ঢেকে রাখেন অথবা অস্তিত্বের ভিতর পরানের একদম কাছাকাছি জায়গায় স্থান করে দেন।

ক্ষমতাধারীরা স্বউদ্যোগী হয়ে তাদের ধামাধরাদের গোপন রাখার চেষ্টা করেন। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে তারা ধামাধরাদের আড়াল করেন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। আপন ক্ষমতা তুলে দেন ধামাধরাদের হাতে এবং তাদের হাতের পুতুল হয়ে কাজকর্ম চালাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে চলতে চলতে এমন একটি পর্যায় এসে যায় যখন নব্য ধনীরা বা ক্ষমতাধারীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন নিজেদের কুকর্মের জন্য যা তারা মূলত করে থাকেন ধামাধারীদের প্ররোচনায়। ধামাধরারা অত্যন্ত সুকৌশলে নব্য ধনীদের অভিজাত বানানোর কলাকৌশল শিক্ষা দেন এবং সমাজের উঁচু তলায় স্থান করে দেওয়ার জন্য পথ দেখানোর চেষ্টা করেন। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীনদের তারা অমরত্ব লাভের জন্য নানান প্রতারণামূলক দুরভিসন্ধির প্ররোচনা দেন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান বুদ্ধি-শুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের নিকৃষ্ট ও নকল পথটির অনুসন্ধান করে দেন। ধামাধরা নিয়ে আজ আর এগোবো না। এবার গল্পটি বলে যথারীতি নিবন্ধের ইতি টানব।

আজকের গল্পটি ১৮৩৩ সালের প্রথম দিকের। ভারতে তখন ব্রিটিশদের রাজত্ব চলছে। লর্ড উইলিয়াস বেন্টিক তখনো পুরো ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল হতে পারেননি। তিনি তখনো বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি হিসেবে খ্যাত ফোর্ট উইলিয়াম প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ন্যায়বিচারক ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে বাঙালি সমাজে তখন তার ভারি নামডাক। বাঙালি জ্ঞানী, গুণী, কবি-সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক থেকে শুরু করে টাউট-বাটপাড় ও ধামাধরারা অবাধে তার দরবারে প্রবেশ করে নিজ নিজ মতবাদ প্রচার করে আসতে পারতেন। তার এই গণমুখী আচরণের যেমন সুফল ছিল তেমনি কুফলও কোনো অংশে কম ছিল না।

বেন্টিকের সময়ে নদীয়া জেলায় শিবরাম নামে ধুরন্ধর প্রকৃতির এক লবণ ব্যবসায়ী হঠাৎ করেই মস্তবড় এক জমিদারি কিনে বসেন। জমিদারির খাজনাপাতি নিয়ে জেলার দায়িত্বরত ইংরেজ কালেক্টরের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব-সংঘাতের উপক্রম হলে তিনি কৌশলে বিষয়টি আপাত ধামাচাপা দিয়ে কালেক্টর রবিনসনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। দামি দামি উপহার, সুন্দরী রমণীর জোগান এবং কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উেকাচ দিয়ে শিবরাম ইংরেজ কালেক্টরের মাথা নষ্ট করে দেন। এরই মধ্যে শিবরাম কলকাতা গিয়ে কোনো এক সুযোগে গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিকের সঙ্গে দেখা করে আসেন এবং ফিরে এসে হাতি-ঘোড়া বানিয়ে বিরাট এক গল্প ফেঁদে কালেক্টর রবিনসনের মনে রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দেন।

শিবরামের পাল্লায় পড়ে রবিনসনের লোভ-লালসা দিন দিন বেড়ে একপর্যায়ে তা বেপরোয়া আকার ধারণ করে। অন্যদিকে শিবরাম রবিনসনকে দিয়ে তার আশপাশের ছোট ছোট জমিদারের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলেন এবং দু-একটা জমিদারি নিলামে উঠিয়ে পানির দরে কিনে নেন। শিবরাম যখন অনুমান করলেন যে, রবিনসনের বদলির সময় ঘনিয়ে এসেছে ঠিক তখনই অতীত অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সুগভীর এক চক্রান্তের আশ্রয় নিলেন। শিকারের নাম করে রবিনসনকে একদিন নিজ জমিদারিতে নিমন্ত্রণ করে আনলেন। নিজ প্রাসাদে না উঠিয়ে বিশাল এক জঙ্গলের পাশে রবিনসনের পছন্দ ও রুচি মোতাবেক সুবিশাল ও মনোরম তাঁবুর ব্যবস্থা করলেন। তারপর সারা দিন শিকার। রাতে বারবিকিউ, ক্যাম্প ফায়ার ও জাঁকজমকপূর্ণ জলসার আয়োজন করে কালেক্টর রবিনসনকে চমকিত করে দিলেন। রাতে শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে আনন্দদানের জন্য গ্রামের সুন্দরী কুলবধূ হরিদাসীকে অপহরণ করিয়ে আনলেন। অন্যদিকে, ঘটনার দায়দায়িত্ব ইংরেজদের ওপর দিয়ে পুরো গ্রামবাসীকে খেপিয়ে তুললেন।

রবিনসন যাতে ঘটনা আন্দাজ করতে না পারেন এজন্য হরিদাসীকে জোরপূর্বক অফিসের শরবত পান করালেন তারপর পেয়াদা দিয়ে তাঁবুর খাটিয়ায় শুইয়ে দেওয়ার আগে নিজের পাশবিক সাধ মিটিয়ে নিলেন। এদিকে মদ্যপ রবিনসন তার তাঁবুতে ঢুকে অবচেতন হরিদাসীকে আপন খাটিয়ার ওপর শোয়া অবস্থায় দেখে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হরিদাসীর অপহরণ ঘটনা ছড়িয়ে পড়ার কারণে বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী রবিনসনের তাঁবু আক্রমণ করেন। ফলে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে কয়েকজন গ্রামবাসী নিহত হন। দুর্ঘটনার এ খবর কলকাতার পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক রবিনসনকে পদচ্যুত এবং গ্রেফতার করতে বাধ্য হন। অন্যদিকে, গ্রামবাসীকে নিয়ে এত্তবড় একটি জুলুম প্রতিরোধ করে হরিদাসীর সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য ইংরেজ সরকার শিবরামকে রায় বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করে।

 

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর