সোমবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আইসিস ভূত কি কোনো দিন মরবে?

তুষার কণা খোন্দকার

আইসিস ভূত কি কোনো দিন মরবে?

একটি বীভৎস খবর দিয়ে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসের শুরু। অক্টোবর মাসের দুই তারিখে আমেরিকার লাস ভেগাস শহরে নরক নেমে এসেছিল। সেদিন ২২ হাজার সংগীতপ্রেমী লাস ভেগাসের মান্দালা বে রিসোর্ট অ্যান্ড ক্যাসিনোর পাশে তিন দিনব্যাপী লোকজ সংগীত সম্মেলন রুট নাইনটি ওয়ানে জড় হয়েছিল। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী জ্যাসন অ্যালডিন যখন মঞ্চে গান গাইছেন তখনই সেখানে বৃষ্টির মতো গুলি শুরু হলো। নেভাদা রাজ্যের বাসিন্দা ৬৪ বছর বয়সী স্টিফেন ক্রেগ প্যাডক সংগীত সম্মেলনের পাশে তার হোটেলের ৩২ তলার রুম থেকে গুলি চালিয়ে তাত্ক্ষণিক ৫৯ জন মানুষকে হত্যা করেছে। সোয়াট টিম তার হোটেল রুমের দরজা না ভাঙা পর্যন্ত সে অবিরাম গুলি চালিয়ে গেছে। পুলিশ লোকটার হোটেল রুমে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ভাণ্ডার খুঁজে পেয়েছে। নেভাদা রাজ্যের ম্যাসকুইটে প্যাডকের বাড়িতে আরও অস্ত্র জড় করা আছে। ঘটনার পরপর এ বীভৎস হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বললেন, ‘অ্যান অ্যাক্ট অব পিউর এভিল’ অর্থাৎ এটা শক্ত শয়তানের কীর্তি। সংবাদ মাধ্যমগুলো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, লাস ভেগাসের গণহত্যার ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসলাম কিংবা জিহাদকে দায়ী করে মনগড়া কিছু বলেননি সেটি বড় কথা। আমেরিকান পুলিশও এ ঘটনার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কোনো গ্রুপের কোনো যোগসূত্র এখনো খুঁজে পায়নি। খুনি প্যাডকের আপন ভাই এরিক প্যাডক বলছে, ‘আমি আমার ভাইয়ের এমন নৃশংস কাজ ব্যাখ্যা করার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কোনো ধর্ম কিংবা রাজনীতির সঙ্গে আমার ভাইয়ের কখনো কোনো সম্পর্ক ছিল বলে আমি জীবনেও শুনিনি। আমার ভাইয়ের মানসিক অসুস্থতার কোনো ইতিহাস নেই। সে পেশাদার বন্দুকবাজ নয়। আমার ভাইয়ের একটি নেশা, সে জুয়া খেলত।’ খুনির ভাইয়ের দেওয়া এ তথ্য ইঙ্গিত করে লোকটি জুয়া খেলায় বারবার হেরে গিয়ে হতাশা থেকে এমন জঘন্য কাজ করেছে। হোটেলের যে রুম থেকে প্যাডক গুলি চালিয়েছে সেই রুমের মিনি বার থেকে সে কড়া মদ রাম পান করেছে। হোটেল রুমে মদের খালি বোতল পাওয়া গেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে আইসিসের জিহাদি সৈন্য স্টিফেন শুধু জুয়াড়ি নয়, সে মদ্যপ বটে। খুনি প্যাডককে লোন উলফ অর্থাৎ নিঃসঙ্গ নেকড়ে বলার উপায় নেই। তার একজন বান্ধবী আছে যে তার সঙ্গেই বসবাস করে। প্যাডকের বান্ধবী ৬২ বছর বয়সী মারিলাও ড্যানলি ফিলিপাইনের নাগরিক। ঘটনার এক সপ্তাহ আগে মহিলা ফিলিপাইনে চলে গিয়েছিল। ঘটনার পরে ইতিমধ্যে সে তড়িঘড়ি করে আমেরিকায় ফিরে গিয়ে আমেরিকার ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোর (এফবিআই) কাছে জবানবন্দি দিতে শুরু করেছে। স্টিফেন প্যাডক লাস ভেগাসে গণহত্যা শুরু করার আগে তার বান্ধবী ড্যানলির ফিলিপাইনের ব্যাংক হিসাবে এক লাখ ডলার পাঠিয়ে দিয়েছে। স্টিফেনের ভাই এরিক বলছে, স্টিফেন জানত সে শিগগিরই কি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতে চলেছে। সে হয়তো এমন মরণঘাতী ঘটনার সঙ্গে মহিলাকে জড়াতে চায়নি। সে জন্য ঘটনা ঘটানোর আগেই ড্যানলিকে আমেরিকা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ড্যানলি যাতে বাকি জীবন স্বচ্ছন্দে চলতে পারে সেই দায়িত্ববোধ থেকে তার ভাই মরার আগে তার নামে এক লাখ ডলার পাঠিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এরিকের ভাষ্যে কোথাও জড়তা নেই। লোকটির বিবেক এবং ন্যায়বোধের প্রতি সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। লাস ভেগাসের নারকীয় ঘটনার আগে পরের যা বর্ণনা এ পর্যন্ত গণমাধ্যমে এসেছে তাতে লোকটিকে মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনি বলে মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, আমেরিকার পুলিশ এবং স্টিফেন প্যাডকের মার পেটের ভাই এরিক কেউ গণহত্যাকারী স্টিফেনের সঙ্গে ইসলাম কিংবা জিহাদের যোগসূত্র খুঁজে পায়নি। ঘটনা সংশ্লিষ্ট কেউ লাস ভেগাসের নারকীয় ঘটনার সঙ্গে ইসলামের যোগসূত্র খুঁজে না পেলেও আইসিসের মুখপত্র ‘আমাক’ বলেছে, ‘মারহাবা! স্টিফেন প্যাডক একজন জিহাদি সৈনিক। কয়েক মাস আগে সে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে।’ সংবাদ মাধ্যম বলছে, আইসিসের মুখপত্র আমাক কোন সূত্রে এ তথ্য পেয়েছে সেটি কেউ জানে না। আমাক নিজেও তাদের দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করেনি। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আইসিসের মুখপত্র আমাকের কোনো তথ্য প্রমাণের প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর যেখানে যত খুনি আছে তারা সবাই মুসলমান এটি দাবি করাই আইসিস এবং আমাকের মিশন। এর আগেও বহুবার আইসিস এ কাজ করেছে। আইসিস একটি উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন। যেহেতু উগ্রবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনের লোকজন অন্ধকার দুনিয়ার বাসিন্দা সেই কারণে তাদের দেওয়া কোনো তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। তবুও আইসিস কিংবা আমাকের প্রচার প্রচারণার ধরন দেখে মনে হয় তারা মুসলমানের গায়ে নরহত্যাকারী ছাপ লাগানোর মিশন নিয়েছে। জন্মসূত্রে যারা মুসলমান আইসিস তাদের দিয়ে নরহত্যাকারীর তালিকা আর লম্বা করতে পারছে না। সে জন্য বোধ হয় অন্য ধর্ম পরিচয়ের খুনি লোকজনকে নও মুসলমান বলে চালিয়ে দিচ্ছে। আইসিসের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, আইসিস মনে করে, দুনিয়ায় যেখানে যত মানুষ হিংস্র খুনখারাবির ঘটনা ঘটাচ্ছে সেটি তারা স্বভাবগত খুনি বলে করছে না; বরং তারা মুসলমান বলে মানুষ খুন করছে। আইসিসের ভাবখানা, মুসলমান না হলে কেউ ঠাণ্ডা মাথার খুনি হতে পারে না! আইসিসের কাজ দেখে আমার কৈশোরে পড়া ওয়েস্টার্ন গল্পের ভিলেনদের কথা মনে পড়ছে। ওয়েস্টার্ন গল্পের ভিলেনরা কোমরে জোড়া পিস্তল ঝোলাত। তারপর বদ মতলবে খুনের নেশায় একজন মানুষ খুন করে কোমরে ঝোলানো পিস্তলের বাটে ছুরির ফলা দিয়ে আঁচড় কেটে খুনের হিসাব রাখত। আইসিসের চোখে আমরা মুসলমানরা ওয়েস্টার্ন গল্পের ভিলেনের মতো মানুষ শিকারি খুনি। আইসিসের সংবাদ মাধ্যম আমাক আমাদের খুনের হিসাব রাখার দায়িত্ব নিয়েছে। আইসিস এবং তাদের পত্রিকা আমাকের মতলব কত খারাপ হলে তারা এমন জঘন্য প্রোপাগান্ডা চালাতে পারে! এবারের লাস ভেগাসের গণহত্যাকারী স্টিফেন প্যাডককে নও মুসলিম বলে চালিয়ে দেওয়ার জবরদস্তি চেষ্টা দেখে আমি দুনিয়ার সব মানুষকে চোখ-কান খুলে পরিস্থিতি বিচার করার অনুরোধ করব। তর্কের খাতিরে আমি কল্পনা করে নিলাম, আইসিসের দাবি সত্য। তাদের প্রোপাগান্ডা অনুযায়ী গণহত্যাকারী স্টিফেন প্যাডক কয়েক মাস আগে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। মুসলমান হওয়া মানে কি সালাফিস্ট জিহাদি হওয়া? জন্মসূত্রে যারা মুসলমান তাদের মধ্যে কয়জন আইসিস কিংবা আল-কায়েদার দার্শনিক ভিত্তি সালাফি মতবাদ গ্রহণ করে খুন খারাবিতে মেতে ওঠেছে? এমনকি সালাফি মতবাদের যে তিনটি শাখা তার মধ্যে জিহাদি শাখা সবচেয়ে ছোট। পৃথিবীর বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠীর অণু পরিমাণ সংখ্যাও সালাফি জিহাদি নয়। আরবিতে সালাফ শব্দের অর্থ পূর্বপুরুষ। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের বিধিবিধান চৌদ্দ শত বছর আগে আরব দেশে যেভাবে পালন করা হতো ঠিক সেভাবে যারা পালন করতে চায় তারাই সালাফি। সেই সালাফিদের একটি অংশ জিহাদি যারা নরহত্যা, গণহত্যা কিংবা আত্মঘাতী আক্রমণের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে চৌদ্দ শত বছর আগে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়েছে। যারা জন্মসূত্রে মুসলমান তারা কেউ যখন চৌদ্দ শত বছর আগে আরব দেশে চালু হওয়া শাসন ব্যবস্থা, আইন ও বিচার ব্যবস্থা কিংবা সামাজিক বিধি-বিধানের মধ্যে ফিরে যাওয়ার কথা কল্পনা করে না সেখানে একজন নও মুসলমান, যার পূর্বপুরুষের ধর্ম ইসলাম নয় সে কোন সালাফকে স্মরণ করে গণহত্যার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হবে এটি একটি বিস্ময়কর প্রশ্ন! ইরাকি সৈন্যরা যখন আইসিসের হাত থেকে ইরাকের মসুল শহর উদ্ধার করল তখন সেখানে জার্মানির ১৬ বছর বয়সী মেয়ে লিন্ডাকে পাওয়া গেল। জার্মানিতে বসবাসরত এক জর্দানি পরিবার লিন্ডাকে আইসিসে যোগ দেওয়ার জন্য প্ররোচনা দিয়েছিল। তাদের ফুসলানিতে পড়ে কিশোরী মেয়েটি এক আলজিরিয়ান জিহাদিকে বিয়ে করে মসুলে গিয়েছিল। আদি জার্মান কিশোরী লিন্ডার চোখে সালাফি জিহাদ ছিল দারুণ কোনো রোমাঞ্চকর আরব্য রজনীর গল্প। দুরন্ত স্বভাবের কিশোর কিশোরী রোমাঞ্চকর কাজ করতে গিয়ে বিপদে পড়ে এটি নতুন কোনো তথ্য নয়। জার্মান কিশোরী লিন্ডা হয়তো রোমাঞ্চের সন্ধানে ফিরছিল। জর্দানি পরিবার সহজেই তার ব্রেন ওয়াশ করে সালাফি জিহাদি বানিয়ে মসুলের যুদ্ধক্ষেত্রে টেনে নিয়ে গিয়েছে। ১৬ বছর বয়সী কিশোরী মেয়ের কল্পনার রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কিন্তু স্টিফেন প্যাডক ৬৪ বছর বয়সের একজন শিক্ষিত অ্যাকাউন্ট্যান্ট। প্যাডকের উড়োজাহাজ চালানোর পাইলটের লাইসেন্সও আছে। এমন একজন মানুষ নিশ্চয়ই কল্পনার রাজ্যে বাস করতে পারে না। প্যাডকের মতো শিক্ষিত পরিণত বয়সের কোনো লোককে কেউ ব্রেন ওয়াশ করে জিহাদি বানাতে পারে এটি কি বিশ্বাসযোগ্য দাবি? কিন্তু তারপরও আইসিস এবং আমাক খুনি প্যাডককে মুসলমান সাজানোর চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। 

কোনো মুসলমান তার নিজ ধর্ম পালন করুক কিংবা নাই করুক শুধুমাত্র মুসলমান পরিচয়ের কারণে তাদের দুনিয়ার ঘাটে ঘাটে এখন অপদস্ত হতে হচ্ছে। আইসিস, আল-কায়েদা পয়দা হওয়ার আগে পরিস্থিতি এমন ছিল না। আমেরিকায় টুইন টাওয়ার ভাঙার আগে যে সব মুসলমান ইউরোপ আমেরিকায় স্বাধীনভাবে যাতায়াত করেছে তারা দুই জমানার ফারাক স্পষ্ট অনুভব করে। টুইন টাওয়ার ভাঙার আগে ইউরোপ আমেরিকার এয়ারপোর্টগুলোতে মুসলমানদের এত হেনস্তার মুখোমুখি হতে হতো না। ভুক্তভোগী মুসলমানরা তাদের বর্তমান দুরবস্থার জন্য কাকে দুষবে? আইসিসকে না পশ্চিমা দুনিয়াকে? আমি বিশ্বাস করি, পশ্চিমা দুনিয়া মুসলমানদের হেনস্তা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে তারপর আইসিস পয়দা করেছে। আইসিসের ছুতা ধরে মুসলমানদের হত্যা করা এখন পুতুল খেলার শামিল। আইসিস নিধনের নামে পশ্চিমারা যেখানে নির্বিচার গণহত্যা চালিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে সেখানে অপদস্থ মুসলমানের অপমান গায়ে মাখা রীতিমতো বিলাসিতা। আইসিস এবং পশ্চিমা দুনিয়ার স্বার্থ এক ্তুসুতায় গাঁথা। পশ্চিমা দুনিয়া আইসিস পয়দা করেছে, লালন করছে এবং তাদের যতদিন প্রয়োজন থাকবে ততদিন আইসিস ভূত পৃথিবীর ঘাড় থেকে নামবে না। কাজেই পশ্চিমা শান্তি মিশনের ভণ্ডামি দিয়ে মুসলমানের সমস্যার সমাধান হবে না। দুনিয়াব্যাপী মুসলমানরা যদি ঘৃণা এবং অনাস্থার গ্যাঁড়াকল থেকে মুক্তি পেতে চায় তাহলে তাদের নিজেদের উদ্যোগে বৈরী পরিস্থিতি বদলানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

            লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর