শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

ফিরে চলো মাটির টানে : কৃষিকে সবার করে তুলি

শাইখ সিরাজ

ফিরে চলো মাটির টানে : কৃষিকে সবার করে তুলি

বহুদিন টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার সুবাদে আমি কৃষকের মাঠে যাই। যেতেই হয়। কৃষকের মতোই আমার মাঠে যাওয়ার বিষয়টিও প্রায় নিত্যকার। প্রতি সপ্তাহে তিনটি অনুষ্ঠানের জন্য মাঠ আর কৃষিই আমার সম্বল। মাঠের ফসল, গ্রামীণ জীবন, কৃষকের ভালোমন্দ, দেশের খাদ্যপণ্যের বাজার, আধুনিক প্রযুক্তি আর সব মানুষের আশা-নিরাশার জায়গাটি তুলে আনাই আমার কাজ। বাংলাদেশের গ্রামীণ  জীবন ব্যবস্থার সব জায়গাই আমার মোটামুটি দেখা।  তারপরও গ্রামের প্রতি আমার কৌতূহল যায়নি। কয়দিন পেরিয়ে গেলেই মনটা বড় টানে, গ্রামে যাই। গ্রামে যেতে যেতেই আমার বার বার মনে হয়েছে শুধু আমি গ্রামে গেলে তো হবে না, সব শ্রেণি-পেশার মানুষকেও গ্রামে যাওয়া দরকার। বিশেষ করে শহরের সব শ্রেণিরই গ্রামমুখী হওয়াটা খুবই দরকার। দীর্ঘদিন নগরমুখী চিন্তা আর ইট-পাথরের নাগরিক জীবনের আধুনিকতা খুঁজে খুঁজে আমরা অন্তঃসারশূন্য এক জীবনে এসে পৌঁছেছি। এই জীবনের কোনো রস নেই। আমরা যেন শিকড়হারা হয়ে যাচ্ছি। মানুষ মানুষ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে শহরের বুকে যাদের অধিকাংশই মাটির স্পর্শ পায়নি। তারা জানে না, মাটি যখন ফলে-ফসলে পূর্ণ হয় তখনই রচিত হয় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সেখানে রয়েছে কৃষকের লালিত স্বপ্ন। তাদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে উৎপাদন হচ্ছে দেশের মানুষের খাদ্য। তারা নীরবে ঘুরিয়ে যাচ্ছে আমাদের উন্নয়নের চাকা। নতুন প্রজন্ম এগুলো না জানা মানে, আমরা যে ভবিষ্যৎ রচনা করছি তা অপূর্ণাঙ্গ। আজকের প্র্রজন্মই একদিন রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশ নেবে। তারা জানবে না কী করে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কৃষক কেন তার জীবনকে নিবেদন করে কৃষিকাজে! শহর-নগরের আধুনিক কিশোর-তরুণদের কাছে পেলেই এই ভাবনাগুলো ওদের মাঝে তুলে ধরি। মনে আছে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে গিয়ে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের একঝাঁক শিক্ষার্থীর মাঝে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিই, আমার সঙ্গে গ্রামে যেতে রাজি আছ কে? দেখি অনেকেই সাহস করে হাত তুলেছে। তখনই তাদের ভিতর থেকে বাছাই করে চারজনকে গ্রামে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিই। এভাবেই শুরু ‘ফিরে চলো মাটির টানে’ কার্যক্রমের। আজ শহরের ছেলেরা কম্পিউটার আর মোবাইলে বুঁদ হয়ে ভার্চুয়াল পৃথিবীর মানুষ হয়ে আছে। শহর-নগরে তাদের ছোটাছুটি করার জায়গা নেই। পর্যাপ্ত মাঠ নেই খেলাধুলা করার। আমার চিন্তা ছিল এই তরুণদেরই যদি একজনকে কৃষক বা কৃষি শ্রমিকের ভূমিকায় কয়েক দিনের জন্য নিয়োজিত করা যায়, তাহলে তার মধ্য দিয়ে ভালো কিছু আসতে পারে। অর্থাৎ তার মাথায় এমন কিছু ঢুকবে, এমন এক পরিবেশে সে সিক্ত হবে, যা তার সারা জীবনের এক অনন্য শিক্ষা হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গ্রামে গিয়ে একেবারে আত্মহারা হতে থাকল। তাদের অভিজ্ঞতাগুলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে কয়েক বছরের মধ্যে সারা দেশেই শিক্ষার্থীদের গ্রামে যাওয়ার প্রবণতা ও আগ্রহ দেখতে পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাচ্ছেন, কৃষকের মাঠে গিয়ে তাদের সঙ্গে মিশে কৃষি কাজটা ব্যবহারিকভাবে শেখার জন্য। এমনকি তিনি অন্য পেশাজীবীকেও গ্রামে যাওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন, বিষয়টি আমার যারপরনাই ভালো লেগেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাবনা-চিন্তায় অনেকটা পরিণত। এই বয়সের মধ্যে তাদের জীবনের একটি লক্ষ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। সে কারণে কৃষকের মাঠে গিয়ে কৃষকের প্রতি তাদের একটি সহমর্মিতা ও আন্তরিকতা তৈরি হলেও তারা সেটিকে গভীরভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ পায় কম। বড় জোর তারা তাদের একাডেমিক অর্জনটাকে কৃষির পক্ষে কাজে লাগানোর একটি লাভজনক সুযোগ খুঁজতে পারে। কিন্তু শিশুদের মাঠে নিয়ে যেতে পারলে তাদের মনের গভীরে কৃষি কৃষক ও গ্রাম একটি স্থায়ী আসন নিয়ে নিতে পারে। এই চিন্তা থেকেই ২০১১ সালে শুরু করেছিলাম ফিরে চলো মাটির টানে জুনিয়র। পঞ্চম শ্রেণির ২০ জন ছেলেমেয়েকে কৃষকের খেতে নিয়ে আলু রোপণ ও আলু তোলার কাজে যুক্ত করে দেখলাম, এর ফলাফল দারুণ। শিশুরা একদিনেই তার মাথার মধ্যে এঁকে ফেলে কৃষকের ভালোমন্দ। আমাদের শিশুদের গ্রামে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ফসল রোপণ ও ফসল তোলার যে আনন্দ তা যদি তারা বুঝত তাহলে ব্যক্তিজীবনে ওদের কোনো ব্যর্থতা থাকত না। কৃষকের পরিশ্রমকে ওরা যদি আবিষ্কার করতে পারত, তাহলে বুঝত জীবনে কোনো কিছুই সহজে আসে না। এর জন্য প্রয়োজন হয় কঠোর পরিশ্রম ও সাধনার। ১৫১৬ সালে থমাস ম্যুর কৃষির গুরুত্ব অনুধাবন করে কল্যাণ রাষ্ট্রের যে রূপরেখা ও পরিকল্পনা এঁকেছিলেন, তার গুরুত্ব ফুরিয়ে যায়নি। যে রাষ্ট্রের নাগরিকরা সুখী ও সুন্দর। সেখানে নারী-পুরুষ সবার আছে কৃষিবিষয়ক সাধারণ জ্ঞান। পেশা যাই হোক না কেন, ফসল তোলার মৌসুমে যেতে হবে ফসলের মাঠে। সভ্যতার উত্তরণ যতই ঘটুক না কেন, যতই আমরা আধুনিক পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাই না কেন, কৃষির বিকল্প কিছু নেই। সভ্যতার সূচনা তো কৃষি থেকেই। দিন শেষে আমাদের ফিরে যেতে হবে কৃষির কাছেই।

রবীন্দ্রনাথের গানের সেই কথাগুলো ‘যার বুক ফেটে এই প্রাণ উঠেছে, হাসিতে যার ফুল ফুটেছে রে/ ডাক দিল যে গানে গানে/ ফিরে চলো ফিরে চলো ফিরে চলো মাটির টানে’। এ তো কৃষিরই টান। মাঠের বুক ফেটে যে প্রাণ জাগে, যার হাসিতে ফুল ফোটে, সে তো ফসলের হাসিই। যার ঘ্রাণ প্রোথিত মানুষের সত্তার ভিতর। সে টানেই মানুষকে ফিরতে হবে, ফেরা উচিত।

দেখতে দেখতে অনেক দিন হয়ে গেল। ২০১১ সালে শুরু হয়েছিল ফিরে চলো মাটির টানে জুনিয়র। শুরুতে অংশ নিয়েছিল রাজধানীর সি ব্রিজ স্কুল। ইংরেজি মাধ্যম বা ভার্সনের শিশুদের নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এদের চিন্তা-চেতনায় বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতির চেয়ে বেশি প্রাধান্য পায় ইংরেজি ভাষা আর পশ্চিমা সংস্কৃতি। পর্যায়ক্রমে রাজধানীর ভালো ভালো ইংলিশ মিডিয়ামের শিশুদের নিয়ে গেছি মাঠে। অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল, স্কলাসটিকা, মারিকুরি স্কুল, বারিধারা স্কলার্স অ্যাসোসিয়েশন ও আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এতে অংশ নিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, যে শিশুরা এই কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে জীবনের সেরা এক অভিজ্ঞতা হিসেবে তারা লালন করছে কৃষকের মাঠে যাওয়ার দিনটিকে। এবার গত ৩ ডিসেম্বর রাজধানীর উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ২১ জন শিশু শিক্ষার্থীকে নিয়ে যাই মুন্সীগঞ্জের বাগেশ্বর গ্রামে। কৃষক আজিজুল শেখের আলুর খেতে হবে আলু রোপণ। সাধারণত এত ভোরে শহরের এই শিশু-কিশোর কখনো ঘুম থেকে জাগে না। ঘুম ঘুম সকালে অন্যরকম এক কৌতূহল থাকে তাদের মধ্যে। কৃষি ও কৃষক নিয়ে তাদের মনে থাকে হাজার প্রশ্ন, অনন্ত জিজ্ঞাসা। এই বয়সে স্কুল, ক্লাস, বাসা আর গেমসের বাইরে অন্য এক ভুবন তাদের জন্য। গাড়িতে চলতে চলতে তারা দেখছে দূর গ্রামের আড়াল থেকে সূর্য ওঠা।

মুন্সীগঞ্জে যাওয়ার প্রচলিত রাস্তাটি সেদিন ছিল বন্ধ। রাজ্যের পথ ঘুরে কৃষক আজিজুল শেখের বাড়িতে পৌঁছতে চার ঘণ্টা লেগে গেল। পথটি দীর্ঘ হওয়াতে ওরা তেমন বিরক্ত হয়নি, বরং আরও মজা পেয়েছে। বাসের জানালা দিয়ে দেখেছে অনেক কিছু। কৃষক আজিজুল শেখ শিশুদের জন্য বাড়িতে তৈরি করে রেখেছিলেন নানা রকমের পিঠা। সকালে মিষ্টি রোদে নবান্ন উৎসব। পাটিশাপটা, ভাঁপা, পোয়া, চিতই, পুলি কোনটার কী নাম তাদের জানা নেই। কিন্তু এত পিঠা একসঙ্গে দেখে তারা উচ্ছ্বসিত। উঠোনে পাতা টেবিলে এতসব পিঠার আয়োজনে তারা মোহিত। তারা দেখল গ্রামের মানুষের আতিথেয়তা।

তারা পর্যায়ক্রমে শিখল আলু রোপণের জন্য আলুবীজ প্রস্তুতির কাজ। কীভাবে আলুবীজ কাটতে হয় চাক্ষুস শিখে নিল দুই চাষি বউয়ের কাছ থেকে। কৃষক আজিজুল হক শিখিয়ে দিলেন কীভাবে রোপণ করতে হয় আলুর বীজ।

কৃষকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আদিগন্ত খোলা মাঠ দেখে কী উচ্ছলতা তাদের ভিতর! কেউ কেউ গেয়ে উঠল গান। শুরু করল দৌড়াদৌড়ি, ধানের নাড়ায় লাফিয়ে পড়া। এ আনন্দের উৎস মাটি, গ্রাম, গ্রামের প্রকৃতি, কৃষি, কৃষক। যেখানে জটিলতা নেই, এক সহজ আনন্দ অথচ গভীর ভাষাময়। দলবেঁধে তারা নিয়ম মেনে নিজের হাতে আলু রোপণ করল। গায়ে মাটি মাখাল। দেখলাম মাটির স্পর্শে তারা কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছে কৃষকের শক্তি। পঞ্চম শ্রেণির এই শিক্ষার্থীরা জীবনের প্রথম কৃষকের মাঠে কৃষকের ভূমিকায় কাজ করল। যে শিশুদের নিয়ে সকালে রওনা হয়েছিলাম, এ যেন তারা না, মাটি ভিতরে কিছু একটা পাল্টে দিয়েছে তাদের। আলু রোপণ করতে করতে একজন গেয়ে উঠল ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি আমার দেশের মাটি’।

শিক্ষার্থীরা সরাসরি কথা বলল কৃষকের সঙ্গে। কীভাবে ফসল ফলায়? কী পরিমাণ লাভ? কী কী অসুবিধার ভিতর দিয়ে কৃষকদের যেতে হয়? এসবই ছোট্ট শিশুরা জানতে চাইল। এর ভিতর দিয়ে জানা গেল, আলু চাষিরা রয়ে গেছেন লোকসানে। বাজারে আলুর দাম নেই। কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু তুলছেন না কৃষক। উঠছে না কৃষকের উৎপাদন খরচও। জানা গেল কৃষি ও কৃষকের নানা সংকট।

আলু রোপণ শেষে আমরা ফিরে আসলাম। আবার আলু ফলনের পর মার্চের প্রথম সপ্তাহে ওদের নিয়ে যাব আলু তুলতে। এই শিশু-কিশোরের কেউ হয়তো কৃষক হবে না। কেউ হয়তো প্রকৌশলী হবে, কেউ চিকিৎসক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ শিল্পোদ্যোক্তা, কেউ চিত্রকর, কেউ চিত্রনির্মাতা।  নানান পেশায় তারা চলে যাবে। যে যেখানেই যাক, যে পেশায় যুক্ত হোক।  এদের ভিতর কেউ যদি কৃষির এই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা মনে রেখে কৃষির উন্নয়নে সামান্যতম কাজ করে তাদের নিজ নিজ জায়গা থেকে।  কিছু না হোক, ফল ফসল উৎপাদনকারী কোনো কৃষকের হাতে হাত রেখে এটুকু যদি বলে, ‘আমি জানি, কৃষি খুব কষ্টের কাজ, এক মহান কাজ।’  তাহলেই সফল হবে এ উদ্যোগ। এটাই হবে সার্থকতা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর