বৃহস্পতিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সন্ত্রাসীরা কি দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে?

তসলিমা নাসরিন

সন্ত্রাসীরা কি দেশের মুখ উজ্জ্বল করছে?

বিশ্বে বড় দুটো সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছিল দুটো বাংলাদেশি যুবক। নাইমুর জাকারিয়া রহমান আর আকায়েদ উল্লাহ। নাইমুর হত্যা করতে চেয়েছিল ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে-কে। আর আকায়েদ হত্যা করতে চেয়েছিল নিউইয়র্কের নিরীহ মানুষদের। ভালো যে তারা সফল হয়নি। কুড়ি বছর বয়সী নাইমুর সুইসাইড ভেস্ট, ছুরি আর পেপার স্প্রে ব্যবহার করতে চেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার জন্য। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের দরজায় বোমা রেখে দেওয়ার পরিকল্পনাও ছিল। পরিকল্পনা কাজে লাগানোর আগেই অবশ্য ধরা পড়ে। ধরা পড়ে ইমরান নামের এক পাকিস্তানি বন্ধুসহ। ইমরানের আইসিসে যোগ দিতে লিবিয়া যাওয়ার কথা। নাইমুর সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি কিছু জানতে পারিনি।

আকায়েদ উল্লাহ পেটে বেঁধেছিল ঘরে বানানো পাইপ বোমা, দাঁড়িয়েছিল নিউইয়র্কের টাইম স্কোয়ার সাবওয়ে স্টেশনের কাছে। সকালে অফিসমুখী যাত্রীদের ভিড়ে বোমা ফোটাবে, এই ইচ্ছে। নিজে মরবে, মারবে অসংখ্য নিরীহ মানুষ। বোমা ভালোভাবে ফোটাতে পারেনি। পারলে তার উদ্দেশ্য সফল হতো। লোকটি বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে এসেছিল বৈধভাবেই, আত্মীয়স্বজন যারা আমেরিকার নাগরিক তাদের আমন্ত্রণে। থাকতো ব্রুকলিনে। সোনার হরিণ ধরবে এই স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ আমেরিকায় আসে। কিন্তু আকায়েদ উল্লাহ আমেরিকায় আসার পর ট্যাক্সি চালাতো, ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করতো। আর ইন্টারনেটে আইসিসের কার্যকলাপ দেখে মুগ্ধ হতো। আইসিস বলে দিয়েছে যার যার এলাকায় যে যেভাবে পারো অমুসলিমদের আর অবিশ্বাসীদের হত্যা করো, তাই করেছে আকায়েদ। নেট থেকেই শিখেছে ঘরে বসে কী করে বোমা বানাতে হয়। বোমা বানিয়ে সেই বোমা নিয়ে গেছে নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করতে। তাদের হত্যা করলে বিনাবিচারে সে বেহেস্তে যাবে, সবচেয়ে ভালো বেহেস্তটিতে তার জায়গা হবে, সেখানে ভালো ভালো সব খাবার পাবে, সুস্বাদু পানীয় পাবে, আর পাবে অপূর্ব সুন্দরী সব কুমারী মেয়ে, যাদের সঙ্গে অবাধে হবে মিলন। বেহেস্তের বর্ণনা নিশ্চয়ই আকায়েদ দেশেই শুনে এসেছে। বাংলাদেশে যে সব মুফতি মওলানা এবং অশিক্ষিত ধর্ম ব্যবসায়ী গ্রামেগঞ্জে শহরে বন্দরে ওয়াজ করার লাইসেন্স পেয়েছে তারা অনর্গল দিচ্ছে বেহেস্তের হুরদের রূপের বর্ণনা, বেহেস্তে যাওয়ার সহজ রাস্তা, দিচ্ছে অমুসলিমদের ঘৃণা করার, হিন্দু-বৌদ্ধদের মন্দির আর মূর্তি ভাঙার, আমেরিকা আর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উপদেশ, দিচ্ছে সন্ত্রাসী হওয়ার পরামর্শ, বাঙালি সংস্কৃতিকে বিদেয় করে দেশে জঙ্গি সংস্কৃতিকে বরণ করার আদেশ। তারাই যথেষ্ট যুবসমাজকে নষ্ট করার জন্য। তারাই যথেষ্ট দেশজুড়ে অগুনতি আকায়েদ উল্লাহ তৈরি করার জন্য। বাংলাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি সব সংস্থা যেভাবে জনগণকে ধর্ম পালন করার জন্য চাপ দিচ্ছে, যেভাবে ইস্কুল কলেজ মসজিদ মাদ্রাসা গোটা যুবসমাজকে ধর্ম দিয়ে মগজধোলাই করছে, তাতে সাধারণ মানুষের অতি-ধার্মিক হওয়ার আশংকা বাড়ছে। অতি-ধার্মিকদের নিয়ে বিপদ এই— তারা আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব চেনা পরিচিত সবাইকে ছলে বলে কৌশলে নিজেদের মতো অতি-ধার্মিক বানানোর চেষ্টা করে। ধর্মীয় সন্ত্রাসকে তাদের মোটেও সন্ত্রাস বলে মনে হতে থাকে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেও মূল্যবান কিছু বলেও মনে হয় না। নিজের ছাড়া অন্যের বিশেষ করে ভিন্ন মতাবলম্বীদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে মোটেও মানতে ইচ্ছে করে না। গণতন্ত্র ব্যাপারটাকেও ছুড়ে ফেলে দিয়ে ধর্মতন্ত্র আমদানি করতে ইচ্ছে করে। এই অতি-ধার্মিকদের সমাজে আকায়েদ উল্লাহ জন্ম নেবে না তো আইনস্টাইন জন্ম নেবে? আকায়েদের কারণে ‘চেইন মাইগ্রেশন’ পলিসি বন্ধ হতে যাচ্ছে আমেরিকায়। চেইন মাইগ্রেশন মানে কেউ আমেরিকায় গিয়ে নাগরিকত্ব পেল, সেই নাগরিক এক এক করে দেশে থেকে তার আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে গেল। চেইন মাইগ্রেশন বন্ধ হলে শুধু বাংলাদেশের নয়, অন্য দেশের অভিবাসীদেরও আমেরিকায় স্বজনহীন বাস করতে হবে। কী ভালো কাজটা করেছে আকায়েদ? বাংলাদেশের মুখ কি উজ্জ্বল করেছে? নাইমুর করেছে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল? যে দেশকে মোডারেট মুসলিমদের দেশ বলে গণ্য করা হতো, সেই দেশটিকে, গুলশানের আর নিউইয়র্কের সন্ত্রাসী হামলার পর চরমপন্থি বা অতি ধার্মিকদের দেশ বলে গণ্য করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা তাদের দেশের কিছু কি ভালো করেছে? সবচেয়ে দুঃখের কথা, অতি-ধার্মিক হয়ে গেলে দেশ এবং দশের মূল্য তাদের কাছে আর থাকে না। তাদের কাছে সবচেয়ে মূল্য তাদের ধর্মের। তারা যে ধর্মে বিশ্বাস করে, সেই ধর্মের বিশ্বাসীরাই তাদের কাছে আপন, তারাই তাদের সবচেয়ে বড় স্বজন। কৃষ্টি, সংস্কৃতি এসব মূল্যহীন হয়ে পড়ে। সে কারণে গাজার মুসলমানদের ওপর হামলা হলে আকায়েদ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে, কিন্তু তার নিজের দেশের হিন্দুদের ওপর হামলা হলে তার কিছু যায় আসে না। অমুসলিমদের এত বেশি ঘৃণা করতে শিখেছে যে সে নিউইয়র্কের অমুসলিমদের ওপর হামলা করেছে, দেশে থাকলে সেও শামিল হতো সেইসব হিন্দুবিদ্বেষী লোকদের মন্দির ভাঙায়, শামিল হতো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায়, কারণ রোহিঙ্গারা যে ধর্মে বিশ্বাস করে, সে ধর্মে সেও বিশ্বাস করে। ধর্ম ছাড়া আর কোনও পরিচয়ে আকায়েদ বিশ্বাস করে না।

আকায়েদের মতো অতি-ধার্মিক বাংলাদেশি লন্ডনে, নিউইয়র্কে তো বটেই, ইউরোপ আমেরিকার প্রায় প্রতিটি শহরেই গিজগিজ করছে। ইউরোপ আমেরিকায় সন্ত্রাসী আক্রমণ ঘটলে তাদের অনেকে আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে, তবে গোপনে, কারণ পুলিশের চোখে পড়লে ওসব দেশে তাদের বসবাসে সমস্যা হতে পারে। সমস্যা যদি না হতো, তাহলে তারাও ঝাঁপিয়ে পড়তো সন্ত্রাসে। সন্ত্রাসী হওয়ার পেছনে শুধু শর্টকাটে বেহেস্তে যাওয়ার উদ্দেশ্য কাজ করে না। রাগও কাজ করে। ইসরায়েল বা আমেরিকা মুসলিম দেশে বোমা ফেললে, বোমায় মুসলিম মারা গেলে তাদের রাগ হয়। যেহেতু তাদের রাগ হয়, তারা মনে করেছে এই রাগ মেটাতে নিজে মরে হলেও মানুষ মারতে হবে, যারা বোমা ফেলেছে তাদের মারার প্রয়োজন নেই, নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে মারতে হবে। সন্ত্রাসীগুলোর রাগ খুব অদ্ভুত। মুসলিমরা কোনও অমুসলিমকে মেরে ফেললে তারা রাগ করে না, ধনী মুসলিমরা গরিব মুসলমানদের নির্যাতন করলে রাগ করে না, মুসলিমরা মসজিদে বোমা ছুড়ে নামাজরত মুসলিমদের মেরে ফেললেও তারা রাগ করে না, মুসলিম ইমাম মাদ্রাসার ছাত্রীদের ধর্ষণ করলেও তারা রাগ করে না।

বাংলাদেশের ভেতরে কি নাইমুর আর আকায়েদকে সমর্থন করার লোক নেই? প্রচুর আছে। আছে বলেই যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করছে তাদের একে একে কুপিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসীরা। এখন একই কাজ করবে দেশের বাইরে বসে। আইসিস নামের সন্ত্রাসী সংগঠনে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা তো ভিড়েছিলই, দূর থেকে ওই সংগঠনকে সমর্থন করার লোকও নেহাত কম নয়। আইসিস যদি নিশ্চিহ্ন হয়েও যায়, আইসিসের আদর্শ বেঁচে থাকবে। অতি-ধার্মিকরা সেই আদর্শ যুগে যুগে লুফে নেবে— এই আশংকা থেকেই যায়। যে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ হবে বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, সেই বাংলাদেশ এখন অতি-ধার্মিকতার গর্ভ থেকে জিহাদি জন্ম দিচ্ছে। এই জিহাদিদের হাত থেকে দেশ এবং বিশ্বকে বাঁচানোর জন্য প্রগতিশীলতার আন্দোলন অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশই না হয় শুরু করুক এই আন্দোলন। শুধু সরকারের দায়িত্ব নয় দেশকে জঙ্গিমুক্ত করা, সমাজের সবারই দায়িত্ব জঙ্গি বা জিহাদি যেন আর কখনো উৎপন্ন না হতে পারে, এমন সুশিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। বিষবৃক্ষের শেকড় না ওপড়ালে শুধু ডালপাতা কেটে বিষ বিদেয় করা যায় না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর