রবিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

চকরভাটা থেকে রংপুর

সুনীল শুভ রায়

চকরভাটা থেকে রংপুর

জীবনের প্রথম ভাগে রোহিঙ্গাদের মতো আমিও শরণার্থী হয়েছিলাম। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধ চলাকালের কথা। বয়সটা তখন আমার একেবারে যুদ্ধ-আন্দোলন না বোঝার মতো সময় নয়। ক্লাস সেভেনে পড়ি। সন্ধ্যায় গ্রামের সবার মতো নিয়মিত বিবিসির খবর শুনি। আমাদের ভাগ্যে পরিবর্তন আসছে— সেই অপেক্ষায় আছি কয়েক মাস ধরে। নির্বাচন হয়ে গেছে, আমাদের বিজয় হয়েছে। বয়সের কারণে ভোট দিতে পারিনি, কিন্তু চুঙ্গা ফুঁকিয়ে বলেছি, ‘তোমার নেতা-আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’ ’৭১-এর ২৬ মার্চ বিবিসিতে যা শুনলাম-তাতে গ্রামের সবাই বুঝলাম, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। দু-এক দিনের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা-পাকিস্তানি মিলিটারি— এসব কী এবং কেন তা বুঝে ফেলেছি। এরই মধ্যে দেখি এক ভিন্ন চিত্র। আমার চেনা-জানা কেউ চাচা, কেউ নানা, কেউ ভাই— এমন সব মানুষ আমাদের বাড়িঘর লুটপাট শুরু করল। যাদের সঙ্গে একসঙ্গে মিছিলে চিৎকার করে বলতাম— ‘তোমার নেতা-আমার নেতা...’— তাদের মধ্যেও কেউ কেউ লুট করে নিয়ে গেল আমাদের বাড়ির সহায়সম্বল সবকিছু। এরপর গ্রামে ঢুকল পাকিস্তানি সৈন্য। ঢুকল বলে ভুল হবে— তাদের নিয়ে আসা হলো। কারণ ওরা তো আমাদের গ্রামের রাস্তাঘাট চিনত না। যারা ওদের নিয়ে এলো তাদেরও ‘চাচা-নানা’ বলে ডাকতাম। মিলিটারি এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিল। যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে মেরেছে। তখন বুঝেছিলাম, ওরা শুধু হিন্দু বেছে বেছেই মারবে, হিন্দুদের বাড়িঘর পোড়াবে। আমাদের গ্রাম হিন্দুপ্রধান ছিল বলেই এটা তখন ভেবেছিলাম। কিছু দিনের মধ্যেই দেখলাম মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার কিশোর মনে তখন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন জেগে উঠল। আমাদের বাড়িটা তখনো পোড়ানো হয়নি। লুট হয়ে গেছে মাত্র। ঘরের মধ্যে কিছু নেই। কলা-কচু-কুমড়া-শাক-পাতা সিদ্ধ করে খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি। আমাদের ঘরে দুজন মুক্তিযোদ্ধা এসে আশ্রয় নিয়েছে তখন। সারা দিন ঘরে লুকিয়ে থাকে, রাতে অপারেশনে বের হয়। ওরা কিছু খাবার এনে দিয়েছিল আমাদের। দু-তিন দিন ওদের সঙ্গে রাতে বেরও হয়েছিলাম। এই খবরটা পৌঁছে গেল, যারা আমাদের বাড়িঘর লুট করেছিল তাদের কানে। তারা দল বেঁধে এসে আমাদের বাড়িটা ঘিরে ফেলল। ভাগ্যিস মুক্তিযোদ্ধা দুজন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। ধরে ফেলল আমাকে। প্রাণে রক্ষা পেলাম মায়ের কান্না আর কাকুতি-মিনতিতে। তারপর ছোট বলে ঘেন্না দেখিয়ে আমাকে ফেলে চলে গেল। কিন্তু নিয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা একটি বন্দুক। সেদিন প্রাণে রক্ষা পেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমিও যুদ্ধে যাব। কিন্তু পারলাম না মায়ের একমাত্র সন্তান বলে। বাবাকে হারিয়েছি মাত্র দুই বছর বয়সে। মায়ের আঁচলতলেই বড় হয়ে উঠছি। মা বলেছিল, ‘তোর কি যুদ্ধ করার বয়স হয়েছে?’ এখন তো দেখছি সেই সময়ে মায়ের কোলে উঠেছে এমন কেউও এখন মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় উঠছে। ওই সময় আর বাড়িতে থাকার মতো অবস্থা রইল না। দুই মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছি— এই অপরাধে তিন পুরুষ আগে বাঁধা আমাদের লোহাকাঠের ঘরটি ভেঙেচুরে নিয়ে যাওয়া হলো। এখন কোথায় থাকব, কী খাব, কীভাবে বাঁচব— এই আতঙ্কে মা আমাকে নিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার চিন্তা করলেন। প্রতিবেশী আরও দুটি পরিবার আমাদের সাথী হলো। আজও মনে পড়ে বাপ-দাদার ভিটে-মাটি ছেড়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে পা বাড়ানোর সেই হৃদয়বিদারক স্মৃতিকথা। গভীর রাতে আমরা মা-ছেলে একটা নৌকায় করে যাত্রা করব। আমার পোষা একটা বিড়াল ছিল। বিড়ালটাকে মিনি বলে ডাকতাম। মিনি যে আমার কত প্রিয় ছিল তার কোনো পরিমাপ নেই। যখন আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠতে যাচ্ছি, মিনিও আমার পিছে পিছে চলে এসেছে। আমি যখন নৌকায় উঠেছি, মিনি তখন পাড়ে দাঁড়িয়ে মিউ মিউ করছিল। আর কিছুর জন্য কাঁদিনি, মিনির কান্না আমাকে কাঁদাল। ও যেন মিউ মিউ ডেকে বলছিল, ‘তোমরা আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছ, আমাকেও নিয়ে যাও। আমি কী করে বাঁচব।’ আমার বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তার মুখে, ওই অবোধ প্রাণীটার বাঁচানোর দায়িত্ব সেদিন নিতে পারিনি। গৃহপালিত প্রাণীর মধ্যে বিড়ালই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয়। মিনিকে ফেলে যাওয়ার পর আর আমার কখনো বিড়াল পোষা হয়নি। তারপর জীবন-মৃত্যুর দোলায় চেপে আশ্রয়ের সন্ধানে চললাম ভারতের দিকে। চলতে গিয়ে পথে পথে কত যে লাশ ভাসতে দেখেছি, কত লাশ রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেছি, তার কোনো হিসাব রাখতে পারিনি। এক একটা লাশ দেখেছি আর ভেবেছি, আমি না জানি কখন এভাবে শিয়াল-কুকুরের খাদ্য হয়ে যাব। মোরেলগঞ্জের শৌলখালী গ্রাম থেকে যাত্রা করে কত শত গ্রাম পাড়ি দিয়ে পদে পদে মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কখনো কখনো জঙ্গলে পালিয়ে প্রায় ১৫ দিন সময় পার করে শেষ পর্যন্ত প্রাণটাকে শরীরের মধ্যে রেখে ভারতের হরিদাসপুরে পৌঁছে গেলাম। উহ্, বেঁচে গেলাম, সে যে কত আনন্দের তা বর্ণনার কোনো ভাষা নেই। হয়ে গেলাম শরণার্থী। আশ্রয় পেলাম বনগাঁ থেকে ট্রেনে তিন দিন সময় নেওয়া সুদূর মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুর জেলার চকরভাটা ক্যাম্পে। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে এক কোটি শরণার্থী হওয়া নাগরিকের মধ্যে সেদিন আমিও ছিলাম একজন। মনে পড়ে খুবই যত্নে ছিলাম সেখানে। খাওয়া-পড়া-থাকা কোনো কিছুতেই সামান্যতম ঘাটতি ছিল না। পূজা-পার্বণ-বিনোদন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সবই চলেছে উৎসাহের মধ্যে। রমজানে মুসলিম পরিবারগুলোর জন্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থা। ইফতারির জন্য আলাদা বরাদ্দ। ঈদের নামাজের জন্য সাজানো হয়েছিল একটা প্যান্ডেল। আজও ভুলতে পারি না সেই চকরভাটা ক্যাম্পের কথা। কিন্তু এত যত্নের মধ্যে থেকেও একটা মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারিনি দেশের মাটির কথা। কখন ফিরে যাব মাতৃভূমিতে, কখন খবর আসে দেশ আমার স্বাধীন হয়ে গেছে। একটা আশ্চর্যের কথা। সেই শরণার্থী আশ্রয়শিবিরে বসে জানতাম না কোনটা আমার জাতীয় সংগীত। তখন শরণার্থীদের সেবার কাজে কলেজ-ইউনিভার্সিটি থেকে ছাত্ররা আসত। মনে আছে বোম্বে ইউনিভার্সিটির একজন ছাত্র আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে আমার দেশের অবস্থা জানতে চাইল। একপর্যায়ে সে আমাদের জাতীয় সংগীত শুনতে চাইল। কিন্তু তখনো আমি জানি না, আমাদের জাতীয় সংগীত কোনটা। জানতাম তো ‘পাকসার জামিন’-এর কথা। তখন শুনতে শুনতে শেখা ভুলভাল হিন্দিতে বললাম— ‘হামারা ন্যাশনাল সংগীত রবীন্দ্রনাথ লেখা হ্যায়।’ ছাত্রটি আমার কাছে গানটি শুনতে চাইল। জাতীয় সংগীত জানি না বললে তো আর ইজ্জত থাকে না। বাঙালির সন্তান বলে কথা! কোনটা গাইব ভেবে অগত্যা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটাই গেয়ে শোনালাম। তারপর বিপদ হলো আর একটা। স্বেচ্ছাসেবী সেই ছাত্রটি বলল এই গানের কথাগুলো হিন্দিতে বুঝিয়ে দিতে। তখন যা বুঝিয়েছিলাম তা মনে পড়লে এখনো লজ্জাবোধ করি। বিস্ময়ের বিষয় এটাই যে, মহান বিজয়ের পর দেশে এসে জানলাম ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’— এই গানটাই আমাদের জাতীয় সংগীত! উপলব্ধি করলাম, জাতীয় চেতনাবোধ— সেই জাতির মনের গভীরে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম হয়। একটি নব্য স্বাধীন জাতির জাতীয় সংগীত কী হতে পারে, তা একটি কিশোর মনে জন্ম নিতে পারে— তারই প্রমাণ আমার জাতীয় সংগীত। আমাদের দেশে রোহিঙ্গাদের দেখে আমার সেই শরণার্থী জীবনের কথা মনে পড়ে। আমি যে ওদের সমব্যথী। একই ব্যথায় আমিও ব্যথিত হয়েছি। একই রকম আঘাতে আমিও আহত হয়েছি। ওদের মতো একই যন্ত্রণা, একই নির্যাতন ভোগ করেছি, একইভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসার সময় আমার মতো ওরাও স্বজন হারানো যন্ত্রণা বুকে বয়ে নিয়ে এসেছে। একইভাবে লাশের ভেলা ভাসতে দেখেছে। তাই ওদের সঙ্গে আমার নিজের জীবনের একটি অধ্যায়ের তুলনা করি। অনুভব করি, রোহিঙ্গাদের দুঃখ-যন্ত্রণা, ব্যথা-বেদনা-অত্যাচার-নির্যাতন স্বজন হারানোর শোকের কথা। ওদের সঙ্গে আমাদের শরণার্থী হওয়ার পার্থক্য এইটুকু যে, আমরা আশ্রয়শিবিরে যতটা যত্নে ছিলাম, রোহিঙ্গাদের সেভাবে রাখতে পারছি না। আমাদের নিয়ে ভারত সরকার বা ভারতের জনগণ অস্বস্তিবোধ করেনি, আমরা কোনো ধরনের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করিনি। আমরা যে-সংখ্যক শরণার্থী হয়েছিলাম, ফিরেছি তার চেয়ে কম। বার্ধক্য বা রোগে মারা গেছে অনেক। এখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। তাদের জন্মহার বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আবার এরা অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়ে দেশে ফিরতেও চায় না। তাই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের এখন একমাত্র পথ হতে পারে তাদের জন্য পৃথক এবং স্বাধীন আবাসভূমি। রাখাইন হোক রোহিঙ্গাদের সেই স্বপ্নের স্বাধীন দেশ। রোহিঙ্গা নিয়ে দেশ যখন ব্যস্ত, তার মধ্যে রংপুরে ঘটে গেল চরম অমানবিক এবং অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। একটা ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে সেখানে কোনো এক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর উসকানিতে নিরীহ নিরপরাধ সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো। সে দৃশ্যও বর্ণনাতীত। যা স্বচক্ষে দেখে মনে পড়েছে একাত্তরের বর্বরতাকে। রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় যা ঘটেছে, তা কি মানবতার লঙ্ঘন নয়? এটাকে কি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বলা যাবে? তাহলে একের পর এক কেন এই ঘটনা ঘটছে? রামু থেকে নাসিরনগর, তারপর রংপুর। এ তো একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ধর্মের অবমাননা হলে তার সঙ্গে যে বা যারা জড়িত তাদের বিচার হোক। কিন্তু অহেতুক-অযথা-অকারণে সংখ্যালঘুদের ওপর যে আঘাত আসছে, তা প্রতিরোধের কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে? ফেসবুক এখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের জন্য। আমারও একটা ফেসবুক আইডি আছে। আমি তা নিজে চালাই না, আমার বিশ্বস্ত সহকর্মীর কাছে তার পাসওয়ার্ড নম্বর। ভাবছি এটা বন্ধ করেই দেব। চীনের মানুষ কি ফেসবুক ছাড়া চলে না? আমিও সেভাবে চলব। অ্যানালগ যুগে জন্মেছি, এই ডিজিটাল আর প্রাণে সয় না। যেখানে চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে কানে হাত না দিয়ে চিলের পেছনে দৌড়ানোর মানুষের অভাব নেই, সেখানে ভালো কিছুর ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। রংপুরের ঠাকুরপাড়ায় যেসব হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে কিংবা লুটপাট করা হয়েছে; তাদের হয়তো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কিন্তু মনের ক্ষত দূর হবে কীভাবে?

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ ডাক্তারের পরামর্শে বিশ্রামে থাকার কারণে নিজে যেতে না পেরে পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সেখানে পাঠিয়েছিলেন। তিনি আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সরকারের চারজন মন্ত্রী সেখানে গেছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করেছেন। কিন্তু এই সাহায্য তো সংখ্যালঘুরা নিতে চায় না। যাতে আর এমন সাহায্য দিতে না হয় তারা তো সেই ব্যবস্থাটাই চায়। জীতন বালা জাতীয় পার্টির মহাসচিবকে আকুতি নিয়ে বলেছেন, ‘আমরা এখানে থাকতে চাই।’ অসহায় বৃদ্ধার এটুকু চাওয়ার মধ্যেই তো সব চাওয়া লুকিয়ে আছে। এ কথাটাই বিবেচনা করুন সবাই— সব মহল।

            লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর