সোমবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

এ দুর্গতি ঘুচবে কবে

মো. মতিউর রহমান

বলতে গেলে ঢাকাতেই স্থায়ী বসবাস। তবে গ্রামের সঙ্গে নাড়ির বন্ধন ছিন্ন হয়নি। পারিবারিক ও সমাজ কল্যাণমূলক কাজকর্ম উপলক্ষে মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়িতে যেতে হয়। গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলার সময় কখনো সকাল ৭-৮টায়, আবার কখনো বা বিকাল ৪-৫টায় বই-খাতাসহ স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা হলে সময়টাকে অসময় ভেবে কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করি-এই সময় কোথায় যাচ্ছ? তারা অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে- কোচিংয়ে যাচ্ছি। সময়টা সকালের দিকে হলে বলি-এই সময় তো বাড়িতে বসে পড়ার সময় আর বিকাল বেলা হলে আবার জিজ্ঞেস করি-তোমাদের কোচিং শেষ হবে কখন? জবাবে তারা বলে রাত ১০টায়। তখন তাদের বলি-এখন তো খেলার সময়, সকাল ও বিকাল দুই বেলাই যদি কোচিং ক্লাস থাকে তা হলে তোমরা পড় কখন, আর খেলাধুলাই বা কর কখন? তারা চুপ করে থাকে। হয়তো মনে মনে ভাবে এ ধরনের প্রশ্ন তো কেউ কখনো করেনি।

আমার মনে হয় এ ধরনের কোচিংবাণিজ্য শুধু আমাদের এলাকায়ই নয়, সারা দেশেই এ ধরনের চিত্র দেখা যাবে। আগে দেখা যেত একটা স্কুলে বড় জোর দু-একজন প্রাইভেট পড়ত, তাও যারা অঙ্ক ও ইংরেজিতে দুর্বল শুধু তারা পড়ত। এখন তো সবাই সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়ছে। প্রাইভেট পড়ার আর একটা বড় কারণ সৃজনশীল বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের তীব্র অভাব। এ বিষয়ে শিক্ষকদেরও স্পষ্ট ধারণা নেই। কেননা, আগের দিনে পাস করা, এমনকি হাল আমলে পাস করা অনেক শিক্ষকই এখনো এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ পাননি। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১০-১৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃতি পেলেও এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। অনন্যোপায় হয়ে তারা নিজ ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়িয়ে কায়ক্লেশে জীবনধারণ করছেন। পরীক্ষায় ভালো ফল করানোর লক্ষ্যে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাসিক মডেল টেস্ট গ্রহণ করা হচ্ছে। কোচিং সেন্টারগুলোর প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য কোনো কোনো কোচিং সেন্টার আকর্ষণীয় গিফট দিচ্ছে। শিক্ষকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না পড়িয়ে গালগল্প করে সময় কাটান এবং কোচিংয়ে পড়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন এ ধরনের অভিযোগ এন্তার। এর থেকেই কোচিং সেন্টারগুলোর উদ্ভব। ফলে প্রাইভেট পড়ানো কোচিং সেন্টারগুলোকে ঘিরে সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠছে এবং এটা বিদ্যা-বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষায় বাণিজ্য ঢুকেছে বলে এখন শিক্ষকরা ক্লাসে না পড়িয়ে কোচিংয়ে পড়তে শিক্ষার্থীদের শুধু উৎসাহিতই করছেন না, বাধ্য করছেন। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের দিবসের কর্মসূচি শুরু হয় সাধারণত সকালে মক্তবে পড়ার মধ্য দিয়ে। এর পর স্কুল, বিকাল ৪-৫টায় কোচিং-তাও আবার রাত ১০টা অবধি এবং মাঝখানে স্কুল করায় ছাত্রছাত্রীরা কোনো ফ্রি টাইম পাচ্ছে না। খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের অবকাশ কোথায়?

আজকে স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টার বেশি, আর পাঠ্যবইয়ের চেয়ে নোটবই ও গাইড বইয়ের আকর্ষণ ও গুরুত্ব বেশি। কোচিং সেন্টারগুলোতে এগুলো পড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ফলে মূল বিষয় গভীরভাবে জানা ও শেখা হয় না, ভাসাভাসা জ্ঞান হয়। কোচিং সেন্টারকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে বিজ্ঞপ্তি-ব্যবসা। এসব বাণিজ্য নিয়ে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা গড়ে উঠেছে। তদুপরি ছাত্রছাত্রীদের পিঠে ব্যাগভর্তি এক গাদা বই চাপিয়ে দিয়ে তাদের মেরুদণ্ডের বারোটা বাজিয়েছে। পর্বতারোহীদের মতো পিঠে বইপত্র সংবলিত ব্যাগ বহনকারী শিক্ষার্থীরা প্রায়ই পত্রিকার সংবাদ হচ্ছে। এর একটা কারণ হলো মাধ্যমিক স্তরে পুরনো বিষয়গুলোর পাশাপাশি নতুন নতুন বিষয় প্রবর্তন করা। প্রায় প্রত্যেক বিভাগই চায় মাধ্যমিক স্তরেই তাদের সংশ্লিষ্ট বিষয় যেমন- পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, কম্পিউটার পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে। ফলে বইয়ে সংখ্যা ও আকার বেড়েছে। বেড়েছে পড়ার চাপ তথা মানসিক চাপ। ছেলেমেয়েরা এখন মনোবৈকল্যের শিকার হচ্ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবার ইউনিফর্ম পরা বাধ্যতামূলক এবং এর কারণে শিক্ষার ব্যয় বেড়েছে বহুগুণ। ফলে নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র লোকজন তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যয়ভার বহনে পিষ্ট হচ্ছেন। এতদ্সত্ত্বেও লেখাপড়ার মান কিন্তু বাড়েনি। শুধু জিপিএ ফাইভ-এর ছড়াছড়িই শিক্ষার উন্নয়ন নয়, প্রকৃত শিক্ষা হচ্ছে কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে বরং ক্রমাবনতি লক্ষণীয়।

এহেন প্রেক্ষাপটে সরকার প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং এবং নোটবই ও গাইড বই নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে একটা খসড়া আইন তৈরি করেছে। সরকারের এই মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। সরকার এর আগে এসব কর্মকাণ্ডকে নিষিদ্ধ করার জন্য নির্বাহী আদেশ জারি করেছিল। উচ্চ আদালতও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার তথা ইচ্ছা শক্তির অভাবে তা কার্যকর করা যায়নি। তাই এবার সবার প্রত্যাশা যে সরকার সংশোধিত খসড়া আইনটি বর্তমান অবয়বেই সংসদে পাস করাবে। কিন্তু তাতে কি শিক্ষার দুর্গতি ঘুচবে? কেননা আইন পাস করাই যথেষ্ট নয়। আমাদের দেশে বহু আইন আছে যার প্রয়োগ নেই। ফলে অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না। আইন প্রণয়নের পর হয়তো দৃশ্যমান কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু শিক্ষকরা বিভিন্ন কৌশলে এ ধরনের কাজ চালিয়ে যাবে। সুতরাং এসব নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য আইনের কঠোর বাস্তবায়ন অতি জরুরি। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে (শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়) কিংবা অধিদফতরগুলোতে মনিটরিং ও পরিদর্শন সেল গঠন করা আবশ্যক। শহর ও গ্রামের বিভিন্ন এলাকা ক্লাস শুরুর আগে ও পরে (বিশেষ করে রাতের বেলা) পরিদর্শন করে কোচিং সেন্টার সম্পর্কে গোপনে খোঁজখবর নিয়ে পরিস্থিতি জানবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট করবে। আমার মনে হয় এই সেলে একটা গোয়েন্দা শাখা বা ইউনিটও থাকতে পারে। আইন পাস ও কার্যকর হলে শিক্ষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও লাভবান হবে জাতি। লেখাপড়া কোচিং থেকে ফিরে আসবে স্কুলে। 

পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে নীতি নৈতিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, শিক্ষকদের জন্যও। কেননা, শিক্ষকতা অন্যান্য পেশার মতো নয়। এটা একটা মহৎ পেশা যে পেশায় মানুষ গড়ার কারিগররা নিয়োজিত থাকেন। এটাকে একটা মহান ব্রত হিসেবে মান্য করে এর সঙ্গে হতে হবে একান্তকরণ।

তাদের হতে হবে নীতিনৈতিকতার কাণ্ডারি। আর নীতিনৈতিকতা তথা শিক্ষার শাশ্বত মূল্যবোধের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জাগ্রত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে এবং প্রণোদনা দিতে হবে। তা হলে হয়তো শিক্ষার এই দুর্গতি ঘুচতে পারে।

লেখক : সাবেক সচিব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর