শিরোনাম
বুধবার, ৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

পরিচালন মুনাফা থেকে যায় না বোঝা ব্যাংকের ভালো-মন্দ

তপন কুমার ঘোষ

পরিচালন মুনাফা থেকে যায় না বোঝা ব্যাংকের ভালো-মন্দ

শুরু হয়েছে নতুন একটি বছর। ব্যাংকগুলো এখন বিদায়ী বছরের হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করতে ব্যস্ত। সারা বছরের লাভ-লোকসানের হিসাব এবং বর্ষশেষে সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ চূড়ান্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংকে আর্থিক প্রতিবেদন পাঠাতে হবে দুই মাসের মধ্যে। তার আগে চূড়ান্ত হিসাব দুটি স্বীকৃত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম দিয়ে অডিট করাতে হবে। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি, দেশি-বিদেশি, বাণিজ্যিক-বিশেষায়িত মিলিয়ে মোট সাতান্নটি তফসিলি ব্যাংক রয়েছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা পঞ্চান্ন। বিশেষায়িত দুটি ব্যাংক বাদে অন্য প্রায় সব ব্যাংকের হিসাব বছর শেষ হয় ৩১ ডিসেম্বর। বিশেষায়িত দুটি ব্যাংক বার্ষিক হিসাব চূড়ান্ত করে ৩০ জুন। ব্যাংকগুলোর বিদায়ী বছরের পরিচালন মুনাফার খবর এরই মধ্যে সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতি বছরই এটা করা হয়। খবরে প্রকাশ, বেশিরভাগ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বেড়েছে। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার খবর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। অনেক বিনিয়োগকারী তথা স্টেকহোল্ডার ভুল বার্তা পান। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা প্রকৃত মুনাফা নয়। এটি একটি অসম্পূর্ণ হিসাব এবং অনিরীক্ষিত। প্রকৃত মুনাফা হচ্ছে কর-পরবর্তী নিট মুনাফা যা লাভ ও লোকসান হিসাবের নিচের লাইনে দেখানো হয়। এর পোশাকি নাম হচ্ছে ‘বটম লাইন’। কোনো ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট সময়ে সব ধরনের আয় থেকে সব ধরনের ব্যয়, প্রভিশন ও কর পরিশোধ শেষে যে মুনাফা করে এটাই হচ্ছে ওই ব্যাংকের কর-পরবর্তী নিট মুনাফা। কোনো একটি ব্যাংক ভালো পরিচালন মুনাফা করলেও শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ বেশি হলে শেষ বিচারে লোকসানি ব্যাংকের তালিকায় তার ঠাঁই হতে পারে। ব্যাংক লাভ করলে তার ভাগ শেয়ারহোল্ডাররা পান। ব্যাংকের কর-পরবর্তী নিট আয় ভাগ-বাটোয়ারা হয়; পরিচালন মুনাফা নয়। পরিচালন মুনাফা হচ্ছে কোনো ব্যাংকের একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরিচালন আয় ও পরিচালন ব্যয়ের পার্থক্য। নিট সুদ, বিনিয়োগ আয়, কমিশন, এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারেজ- এ কয়েকটি হচ্ছে ব্যাংকের প্রধান আয় খাত। বেতন-ভাতা, বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুৎ, মনিহারি, বিজ্ঞাপন, অডিট ফি, অবচয়, আইন খরচ, ব্যাংকের সম্পত্তি মেরামত ইত্যাদি পরিচালন ব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত। পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের আয় বিবরণীতে প্রভিশন-পূর্ব মুনাফা হিসেবে দেখানো হয়।

ব্যাংকের নিট মুনাফা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ঋণ, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে সঞ্চিতি বা প্রভিশন গুরুত্বপূর্্ণ। সম্পদের সম্ভাব্য ক্ষতির বিপরীতে অর্থের সংস্থান রাখা হচ্ছে প্রভিশনিং। ব্যাংকের আয় তথা পরিচালন মুনাফা থেকে অর্থ স্থানান্তর করে প্রভিশন হিসেবে জমা করা হয়। ঋণের ঝুঁকি বিবেচনায় ও ঋণের প্রকারভেদে বিভিন্ন হারে প্রভিশন রাখতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুসারে শ্রেণিকৃত ঋণের তিনটি পর্যায় রয়েছে— নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ বা কুঋণ। নিম্নমান ঋণের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ হারে, সন্দেহজনক ঋণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ হারে এবং মন্দ বা কুঋণের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। অশ্রেণিকৃত অর্থাৎ ভালো ঋণের বিপরীতে ক্ষেত্রভেদে দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে সাধারণ প্রভিশন রাখার বাধ্যবাধকতা আছে। পরিচালন মুনাফা অর্থাৎ প্রভিশন-পূর্ববর্তী মুনাফা থেকে আবশ্যকীয় সব ধরনের প্রভিশন বাদ দিয়ে কর-পূর্ববর্তী নিট মুনাফা বের করা হয়। এ থেকে প্রদেয় কর বাদ দিলে কর-পরবর্তী নিট মুনাফা পাওয়া যায়। ব্যাংকের আয় সক্ষমতা পরিমাপ করার জন্য যেসব রেশিও বা অনুপাত বহুলভাবে ব্যবহৃত হয় সেগুলো হচ্ছে— শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস, সম্পদের ওপর আয় অনুপাত বা রিটার্ন অন অ্যাসেটস ও সাধারণ শেয়ার মূলধনের ওপর আয় অনুপাত বা রিটার্ন অন ইকুইটি। সব ক্ষেত্রেই কর-পরবর্তী নিট মুনাফা বিবেচনায় আনা হয়। ঋণ নিয়ে সময়মতো পরিশোধ না করলে তা শ্রেণিকৃত হয়ে যায়। শ্রেণিকৃত ঋণ হচ্ছে ব্যাংকের নন-পারফর্মিং অ্যাসেট বা নিষ্ফল সম্পদ।  শ্রেণিকৃত ঋণের সুদ, আদায় না হওয়া পর্যন্ত, আয় খাতে জমা না করে ‘স্থগিত সুদ’ হিসেবে জমা রাখা হয়। আবার মন্দ বা কু মানে শ্রেণিকৃত ঋণের ওপর সুদ আরোপ স্থগিত থাকে। শ্রেণিকৃত ঋণ বেড়ে যাওয়ার অর্থ ব্যাংকের আয় তথা মুনাফা কমে যাওয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুসারে সুদ মওকুফ করে দীর্ঘদিনের অনাদায়ী ঋণ আদায়ের প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। অন্যদিকে আদায়ের সব চেষ্টা বিফলে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনের আওতায় কু বা মন্দ ঋণ অবলোপন বা রাইটঅফ করা হয়। নিষ্ফল ঋণ অবলোপন করে ব্যালেন্স শিটে সম্পদের স্ফীত অংশটুকু ছেঁটে ফেলা হয়। বিষয়টি শরীরের অপ্রয়োজনীয় মেদ ঝরিয়ে ফেলার মতো। উদ্দেশ্য, হিসাবের খাতা পরিচ্ছন্ন করা। তবে ঋণ অবলোপন মানে ঋণ মওকুফ নয়। কোনো অবস্থাতেই এটা ঋণের দায়মুক্তি নয়। অবলোপন করা হলেও ঋণগ্রহীতা যথারীতি ঋণখেলাপি হিসেবেই চিহ্নিত হন। জীবদ্দশায় ঋণ পরিশোধ না করলে ঋণের দায় উত্তরাধিকারীদের ওপর বর্তায়।  মূলত সুদ মওকুফ বা ঋণ অবলোপনের জন্যই অর্থের সংস্থান বা প্রভিশন করতে হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ব্যাংকের আয়ের বড় অংশই যাচ্ছে প্রভিশনে। খবরে বলা হয়েছে, টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে অনেক ব্যাংক।  ব্যাংকের পারফরম্যান্স রেটিং করার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে ‘ক্যামেলস’ রেটিং। আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। ইংরেজি ছয়টি শব্দের প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে ‘ক্যামেলস’ গঠিত। শব্দগুলো হচ্ছে, ক্যাপিটাল, অ্যাসেট, ম্যানেজমেন্ট, আর্নিংস, লিকুইডিটি ও সেনসিটিভিটি।  শুধু পরিচালন মুনাফা দেখে ব্যাংকের ভালোমন্দ বোঝা যায় না। ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা, সম্পদের মান, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, আয়-সক্ষমতা, তারল্য পরিস্থিতি ও বাজার ঝুঁকির প্রতি সংবেদনশীলতার বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হয়। ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার খবর প্রকাশের পর শেয়ারবাজারে এর প্রভাব পড়ে। কাজেই মূল্য সংবেদনশীল খবর প্রকাশের আগে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে।

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি), জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর