শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

জীবন ও রাজনীতি

কাজী হায়াৎ

জীবন ও রাজনীতি

যেখানে রাজনীতি আছে সেখানেই জীবন। বলা যায় জীবনের জন্যই রাজনীতি এবং রাজনীতির সব কর্মকাণ্ড জীবন নিয়ে। রাজনীতি শব্দটি নিয়ে আমার একটু আপত্তি, কারণ শব্দটিতে রাজা রাজা গন্ধ আছে। শুধু গন্ধ নয়, রাজনীতি শব্দটির প্রকৃত ব্যাখ্যা বোধহয় রাজার নীতি আর এই রাজার নীতিই হচ্ছে রাজনীতি। তাই যদি হয়, তাহলে একজন রাজা কী ছিলেন? রাজা ছিলেন লাখো কোটি মানুষের মধ্যে একজন অসাধারণ ব্যক্তি। নিজেকে অসাধারণ করে রাখার জন্য তিনি মাথায় রাজমুকুট পরতেন। রাজা যেখানে বসতেন তাকে রাজসিংহাসন বলা হতো। রাজা ছাড়া ওই সিংহাসনে আর কেউ বসতে পারতেন না। রাজার থাকার জায়গা ছিল রাজপ্রাসাদ। সেখানে রাজা থাকতেন, থাকতেন রানী এবং অনেক দাস-দাসী। রাজার সামনে কারও মাথা উঁচু করে কথা বলা ছিল অন্যায়। রাজা যেভাবে দেশ চালাতেন সেই নিয়মকেই বলা হতো রাজতন্ত্র বা রাজার নীতি। রাজা যা বলতেন, সেটাই ছিল আইন। রাজা হতেন স্বৈরাচারী। রাজার পরিচয় যখন এমনই তখন রাজা রাজা গন্ধ থাকলে বোধহয় বর্তমানে রাজনীতি শব্দটি যেভাবে যে কারণে ব্যবহূত হচ্ছে তাতে আমার এই আপত্তি একেবারে অযৌক্তিক নয়। যে সময়ে প্রথমে বাংলা ভাষায় রাজনীতি শব্দটির ব্যবহার ও সংযোজন হয়েছিল, আমার মনে হয় সারা পৃথিবীতে তখন কোথাও গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নামগন্ধও ছিল না। যদি থাকত তাহলে এই শব্দটি হয়তো হতে পারত গণনীতি, জননীতি, জনকল্যাণ নীতি অথবা হতে পারত রাজ্যনীতি। রাজ্যনীতি হলে বোধহয় কিছুটা হলেও রাজ্যে বসবাসকারী মানুষের কথা যোগ হতো। তবে শব্দটি প্রচলনের সময় কিছু লুটেরা ছাড়া সবসময়ই যারা রাজ্যের প্রধান অর্থাত্ রাজা ছিলেন তারা তাদের নিজ রাজ্যে জনকল্যাণের কথা ভেবেছেন এ কথা সত্য। নিজ রাজ্যের জনগণের কথা ভাবতে গিয়ে অনেক সময় রাজারা অন্য রাজ্যের জনগণের অকল্যাণের কথা ভেবেছেন। অন্য রাজ্য ধ্বংসের কথা ভেবেছেন। অন্য রাজ্যের সম্পদ কেড়ে নেওয়ার কথা ভেবেছেন; এমনকি অন্য রাজ্য দখল করে নেওয়ার কথাও ভেবেছেন। আর এ কারণে পৃথিবীতে হয়েছে অনেক নির্মমতা। প্রাণহানি ঘটেছে কোটি কোটি মানুষের। মানুষের ক্ষমতার দাপটে লজ্জিত হয়েছে মানবসভ্যতা। আর ইতিহাস সর্বকালের এই নির্মমতা আর কলঙ্ক বুকে নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বর্তমান পৃথিবীতে প্রকৃত অর্থে রাজা খুব একটা নেই। শুধু তাসের মধ্যেই লিখিত আকারে ছবিসহ রাজা, রানী আর গোলাম আছে। তবু রাজার মতো কর্মকাণ্ড করছেন এমন অনেক রাজ্যপ্রধান আছেন এখনো পৃথিবীতে। এবার আসি রাজনীতি আর জীবন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে। যত যাই বলি, রাজনীতি শব্দের অর্থ যদি রাজ্যনীতি, গণনীতি, জননীতি অথবা জনকল্যাণ নীতিও হয়, তাহলে কি একটি গণতান্ত্রিক দেশে সে দেশের সরকারপ্রধান ওই দেশের সব মানুষের কল্যাণ করতে পারবেন? ধরা যাক বাংলাদেশের কথা। আমাদের দেশের সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যতই জনকল্যাণের কথা চিন্তা করুন, তিনি কি পারবেন এ দেশের ১৭ কোটি মানুষের কথা চিন্তা করতে। তিনি যে আদর্শ লালন করেন, সে আদর্শ বাস্তবায়নের কথা চিন্তা করেন এবং যে আদর্শ বাস্তবায়নের ওয়াদা করে ক্ষমতায় এসেছেন, সেই আদর্শে কি সব মানুষ বিশ্বাসী? স্বাধীনতাযুদ্ধে যারা এ দেশের স্বাধীনতার সরাসরি বিরোধিতা করেছিল এমনকি পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ পর্যন্ত করেছিল, তারা তো এখনো এ দেশে আছে। সে সময় তারা যে ভুল করেছিল অদ্যাবধি তারা সে ভুল পর্যন্ত স্বীকার করেনি। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংখ্যায় তারা কম থাকলেও স্বাধীনতা-পরবর্তী অনেক সময় রাষ্ট্রীয় সমর্থনে এবং প্রচারে-প্রসারে তারা এখন সংখ্যায় অনেক।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রথম শর্তই হলো বহুজনের বহুমত মেনে নেওয়া। এখন প্রশ্ন হলো জনকল্যাণ ও গণতন্ত্রের কথা চিন্তা করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখনো কি মেনে নিতে পারবেন যুদ্ধাপরাধীদের মত? জনকল্যাণের কথা চিন্তা করে ক্ষমা করতে পারবেন কি তাদের? তিনি কি ক্ষমা করতে পারবেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের? না, তিনি অনেক কিছু পারবেন না। ওই স্বাধীনতার বিপক্ষশক্তি, যুদ্ধাপরাধী, জাতির জনকের খুনিরা দিনে দিনে যতই বেশি হোক তিনি তাদের মতকে প্রশ্রয় ও তাদের কল্যাণের কথা কখনই ভাবতে পারবেন না। তবু এ দেশে গণতন্ত্র আছে। তবু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সেই গণতন্ত্র মেনে নিয়েই চলতে হবে। গণতন্ত্র ও জনকল্যাণ মেনে নেওয়া মানেই সবকিছু মেনে নেওয়া নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রংপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল জেনে চিন্তিত হবেন না। পরিশেষে আমি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলতে চাই। আমার গ্রামের বাড়ির পাশের বাড়িতে আমার একজন চাচাতো ভাই আছে। সে আর্থিকভাবে অসচ্ছল। আমি তাকে প্রায় সবসময়ই অনেকভাবে অর্থ ও কাপড়-চোপড় দিয়ে সাহায্য করি। সে আমার লাগানো গাছের বাগান থেকে গাছ কেটে বিক্রি করে। আমার কয়েকটি বাঁশের ঝাড় ছিল। ঝাড়ের বাঁশগুলো সব কেটে নিয়ে ঝাড়গুলো শেষ করেছে। শতাধিক সুপারি গাছ আছে। সুপারি গাছগুলোর সুপারি কখন হয় কখন পাকে আমি কিছুই জানি না। ওগুলো সে-ই বিক্রি করে খায়। কিছুদিন আগে সে আমাকে ফোন করে বলল তার চোখের অপারেশনের জন্য কিছু টাকা লাগবে। আমি যেন তাকে কিছু সাহায্য করি। টাকা দেব বলে ওয়াদা করে তারিখও দিয়েছিলাম। এক দিন দেরি হতেই আগের সব ঘটনা ভুলে গিয়ে সে গ্রামে বসবাসকারী আমার নিকটজনদের কাছে অনেক নালিশ করেছে। আমি রাগ করিনি। কারণ, এটাই মানুষের চিরাচরিত স্বভাব। শান্তিনগর থেকে ৩-৪ মিনিটে ফ্লাইওভার দিয়ে গাড়ি নিয়ে এসে বাংলামোটরের সিগন্যালে ৫ মিনিট আটকে থাকলে পেছনের ৩ মিনিটে এত কম সময়ে পথ অতিক্রম করার কথা ভুলে গিয়ে অনেকেই অনেক কটু কথা বলেন। পেছনের কথা ভুলে যাওয়া মানুষের স্বভাব। আপনার উন্নয়নের কথা সামান্য তুচ্ছ একটি ঘটনায়ও মানুষ ভুলে যেতে পারে। এ কথাগুলো মনে রাখতে হবে আপনার দলীয় নেতা ও কর্মীদের।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! স্বাধীনতাবিরোধীরাই আপনার শত্রু। এর পরে বর্তমানে যোগ হয়েছে সমাজে যারা দুর্নীতি করছে। আগেই বলেছি ভুলে যাওয়া মানুষের স্বভাব। ভুল মানুষই করে। কঠোর হাতে যদি আপনার শত্রুদের আপনি দমন করতে পারেন, তাহলে জনগণ অবশ্যই আপনার পাশে থাকবে। আর তাই হবে আপনার জনকল্যাণকর কর্ম। কল্যাণ হবে রাষ্ট্রের। রাজনীতি হবে জীবনের জন্য।

লেখক : চলচ্চিত্র পরিচালক।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর