শিরোনাম
শনিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

পুরুষত্বের পাঠ্যবই : ছাগলের রাজত্ব, ওড়নার শ্রেষ্ঠত্ব

মোস্তফা কামাল

পুরুষত্বের পাঠ্যবই : ছাগলের রাজত্ব, ওড়নার শ্রেষ্ঠত্ব

বই উৎসবের চ্যালেঞ্জে এবারও জিতেছে সরকার। আট বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও বছরের শুরু হয়েছে নতুন বইয়ের গন্ধে। প্রাথমিক-মাধ্যমিকের শিশু-কিশোররা মাতোয়ারা হয়েছে এ উৎসবে। কিন্তু চেতনে-অচেতনে ভুলভাল থেকে গেছে এবারও। ক্ষেত্রবিশেষ আরও বেড়েছে। রেটিং বেড়ে ছাগল এবার বাজিমাত করেছে। ওড়নার হাস্যকর আধিপত্যও বহাল। সেই সঙ্গে পুরুষত্বের বড়াই দেখাতে গিয়ে ধুমছে নারীর অবমাননার কাজটি সাঙ্গ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

শিশুদের পাঠ্যবইতে গতবার অ-তে অজু, ও-তে ওড়না, ছাগলে আম খায় ধরনের বিষয়গুলো মানুষকে ক্ষুব্ধের পাশাপাশি বিনোদিতও করেছে। এমন ছাগলামির বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে। এ ছাগলানুভূতির একটা বিহিত ও উচিত বিচারের দাবি ওঠে। কিন্তু বই বিতরণ হয়ে যাওয়ায় তখন আর করার কিছু থাকেনি। শিক্ষামন্ত্রী ক্ষমা চান। আগামীতে অর্থাত্ এবারের সংস্করণে এর একটা হিল্লা করার আশ্বাস দেন। বই ছাপানোর মহাজনীয় কর্তৃপক্ষ এনসিটিবির কর্মকর্তাদের গাছে ওঠা ছাগল ও শিশু মেয়ের ওড়না নামানোর কড়া হুকুম দেন।

অভিভাবকসহ শিক্ষা পরিবার এতে আশাবাদী হয়। নতুন সংস্করণে শুদ্ধ-বিশুদ্ধতার ব্যাপারে আশা জাগে। কিন্তু ঘটনা এবার আরও বেগতিক। মন্ত্রীর হুকুমত কায়েম হয়েছে বিকৃতভাবে। তামাশার মতো। এনসিটিবি পরিমার্জন করতে গিয়ে ছাগলকে উপর থেকে নিচে নামিয়েছে। কিন্তু খেদায়নি। নিচে ছাগল এবার আরও তাগড়া। ছা-পোনায় জনবল বেড়েছে। প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বইয়ে’ ছাগল আছে চার-পাঁচ বার। বাঘ, সিংহ, হরিণ, গরু, মুরগি, পাখিসহ বিভিন্ন পশুপাখির কিছু ছবি থাকলেও সেগুলো ছাগলের মতো শক্তিমান নয়। বার বার ঘুরেফিরে ছাগলের মতো ব্যাটিংয়ে আসতে পারেনি সেগুলো। তবু রক্ষা ছাগলকে মানুষের চেয়ে বড় মাখলুক করা হয়নি। তবে ছাগলামির ভ্যালু বেড়েছে। আর ছাগলময়তার সঙ্গে বোনাস দেওয়া হয়েছে ওড়নাবাজি। প্রথম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ে পাঠ ১২-তে ‘ও’ অক্ষর চেনানো হয়েছে ‘ওড়না’ দিয়ে। মেয়ে শিশুর ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে ‘ওড়না চাই’। ওড়নার সঙ্গে হিজাব-নেকাব অবশ্য বাদ পড়েছে। ছোট শিশুদের বর্ণ চেনানোর নামে মজা দিতে গিয়ে পাঠ্যবইয়ে জুড়ে দেওয়া এমন সব ছবি ও আকথা তামাশার কোনো সীমাই মানছে না। এ চণ্ডালতা আমাদের প্রজন্মকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে? এ প্রশ্নের কিনারা নেই। এর আগে বোর্ডের দ্বাদশ শ্রেণির ‘পৌরনীতি ও নৈতিক শিক্ষা’ দ্বিতীয় পত্রের দশম অধ্যায়ে ইভ টিজিংয়ের কারণ হিসেবে মেয়েদের অশালীন পোশাক ও বেপরোয়া চালচলনকে দায়ী করা হয়েছে। এবার ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই শিশুদের ওড়না চেনানো ফরজ করা হলো। গেলবার এত সমালোচনা-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের পরও এমন কাণ্ডকারখানা ছাগলামির চেয়েও বড় বিমারির আলামত। আম কেবল ছাগলেই খায় বা ছাগল ছাড়া আর কেউ আম খায় না— জোরজবরদস্তিতে শিশুদের এমন শিক্ষা দেওয়া জরুরি হয়ে গেল? সেই সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যে লিঙ্গবৈষম্য শেখানোকেও যেন জাতীয় দায়িত্ব হিসেবে নেওয়া হয়েছে। নারীকে অবলা, অক্ষম, অসহায় হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অন্তহীন। কেন? এটা কার বা কাদের এজেন্ডা?

তৃতীয় শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণ বইতে বহুবচনের সংজ্ঞায় বলা  হয়েছে, ‘যা দিয়ে একাধিক ব্যক্তি বা বস্তু বোঝায় তাকে বহুবচন বলে। উদাহরণ : মায়েরা বড় দুর্বল।’ এ বইতেই মাতা-পিতার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যবিষয়ক রচনায় লেখা হয়েছে, ‘মা দিনরাত সন্তানের সেবাযত্ন করেন, আর বাবা জোগান দেন সন্তান বেঁচে থাকার খাবার, ওষুধ ও কাপড়। বাবার পরিচয়ে সন্তান গড়ে ওঠে।’ শিশুদের মনোজগতে বাবা-মা সম্পর্কে জ্ঞান ঢোকানো কি সুস্থতা? বাবার পরিচয়ে সন্তান গড়ে ওঠে! আর মায়ের পরিচয় দরকার নেই? তার কাছে মাকে দুর্বল আর বাবাকে সবল বানানোর মানে কী? বিভিন্ন বইয়ের টেক্সটে ছবি উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও পুরুষের জয়জয়কার। নারীর ছবি একেবারেই হাতে গোনা। বিশেষ করে বিজ্ঞানের বইগুলোয় ছেলেদের ছবির ছড়াছড়িতে মনে হওয়া স্বাভাবিক মেয়েরা সায়েন্স পড়ায় অনুপযুক্ত। বিভিন্ন অঙ্কেও যত হিম্মত পুরুষেরই। যেমন, ‘দুইজন পুরুষ যে কাজ দুই দিনে করতে পারে সে কাজ তিনজন নারী করে চার দিনে।’ অর্থাত্ কাজে নারীরা বড় অক্ষম! বিভিন্ন বইয়ে আর্থিক লেনদেন বা ক্রেতা হিসেবে পুরুষের ছবি দেখানো হয়েছে বার বার। আবার পুরুষকে রোগী আর নারীকে সেবিকা হিসেবে দেখানোর প্রবণতাও স্পষ্ট।

পুরুষতন্ত্রের এমন একতরফা জয় দেখিয়ে লিঙ্গসমতার তাগিদকে চেঁচামেচিতে এনে ঠেকানো কেন জরুরি হলো? এবারের পাঠ্যবইতে এ টাইপের কায়কারবারের তথ্য বোধহয় আমাদের বধূ, মাতা, ভগ্নিসহ নারীকুলও এখনো টের পাননি। রচনা, সম্পাদনাসহ পাঠ্যবইগুলো বাস্তবায়নে যে নারীরা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদেরও চোখ পড়েনি? তারাও জেন্ডার চেতনায় সংবেদনহীন? কমজোরি? তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, পাঠ্যবইয়ের ক্রিয়াকর্মে তারা সংখ্যায় তলানিতে। কমের চেয়েও কম। শুনেছি পাঠ্যবই রচনা ও সম্পাদনায় ছিলেন ১৫৯ জন। সেখানে পুরুষ ১২৯ জন। আর নারী ৩০ জন। চিত্রাঙ্কন ও প্রচ্ছদে ৬১ জনের মধ্যে নারী ৫ জন। আর পুরুষ ৫৬। কমের মধ্যে নারীরা কম করে হলেও কি একটু-আধটু বাদ সাধতে পারতেন না এই বেটাগিরির জুলুমবাজিতে?

সমস্যা আসলে অন্যখানে। নানা উদ্দেশ্য ও এজেন্ডা সর্বোপরি মতলববাজির পণ্য করে ফেলা হয়েছে পাঠ্য ও পাঠ্যবইকেও। রাজনীতি-অর্থনীতির কত তরী ভিড়েছে এখানে! এ থেকে সহসা মুক্তির পথও কঠিন করে ফেলা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে যথাযথ করার তাগিদ-দাবি থাকলেও আলামত কিন্তু চোখে পড়ছে না। এর অনিবার্য পরিণতিতে ল্যাঠাতে আরও আঠাই লাগছে। সংস্করণ, পরিমার্জন ইত্যাদির নামে বছর বছর পাঠ্যবইতে ভুল-অসঙ্গতি না কমে আরও বাড়ছে। মাত্রাটা এভাবে বাড়তে থাকলে ভুল-শুদ্ধ, সঙ্গতি-অসঙ্গতি সংজ্ঞা পাল্টে যেতে আর বেশি দিন লাগবে না। তখন হয়তো সংশোধন মহাকমিটি করেও কূলকিনারা মিলবে না। পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে ভোটের রাজনীতি যেভাবে ভর করেছে তাও কম বিপজ্জনক নয়। হেফাজতে ইসলামের হুঙ্কারে গল্প-কবিতা বাদ দেওয়া হয়। তাদের দাবির আসর এখনো আছে। এর লাগাম টানা জরুরি।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

 

সর্বশেষ খবর