মঙ্গলবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদের বাক্যবাণ থেকে বাঁচান

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদের বাক্যবাণ থেকে বাঁচান

উত্তরবঙ্গের শীতার্ত মানুষ মরতে চলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনি ছাড়া কেউ এই শীতের হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে না। তাই আপনি তাদের পাশে দাঁড়ান আল্লাহ খুশি হবেন।

বহুদিন পর লিখতে গিয়ে বড় ঝামেলায় পড়েছি, কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। সারা সপ্তাহ মনে মনে একটা জাল বুনেছিলাম। কিন্তু সেই বুনন আর থাকছে না। সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন হিরু মিয়া দুই বছর হয় মারা গেছেন। ছেলেমেয়ে উপযুক্ত হলে তারা যে কতটা কাজের হয় সেটাই দেখলাম আবদুল মতিন হিরুর সন্তানদের ক্ষেত্রে। দুই ছেলে এক মেয়ে— ১. এ আর এম আলিফ (সুমন)— অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ২. আবু রাফা মো. আরিফ (সুবিন)— অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ৩. মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা— উপকর কমিশনার। তিনজনই বিসিএস। ধনবাড়ী মুসুদ্দির বাড়িতে তার আত্মার শান্তি কামনায় এক ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। বিপুল লোকসমাগমে ৮-১০টি ফুটবল মাঠের মতো এক ফাঁকা জায়গায় অসাধারণ শৃঙ্খলায় খাওয়া শেষে কেউ কেউ থালায়, পাতায় খাবার নিয়ে যখন হাজারে হাজারে যাচ্ছিল তখন বড় শিহরিত হয়েছিলাম। কেন যেন একটু দেরি হওয়ায় সবার সঙ্গে মাঠে বসতে না পেরে মনে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছি। ভালো লাগত হাজার হাজার সাধারণ মানুষের পাশে বসে এক লোকমা খেয়ে আবদুল মতিন হিরুর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করতে পারলে। এর আগে রাতে গিয়েছিলাম লাঙ্গুলিয়ায় কেফাতুল্লাহ চেয়ারম্যানের বাড়ির এক বার্ষিক অনুষ্ঠানে। অসাধারণ ব্যবস্থাপনা। অমন সুস্বাদু খিচুড়ি, পায়েস বেশ কিছু বছর মুখে তুলিনি। তারও একদিন আগে ফালু চানের মাজারে গিয়েছিলাম। এক বিখ্যাত সাধক ফালু চান। কত রাজা-বাদশাহ দেখলাম, সম্রাট আকবরের কবর দেখেছি, শাহজাহানের তাজমহল, নবাব সিরাজদ্দৌলার মুর্শিদাবাদ, গয়া-কাশি-বৃন্দাবন— কোথায় যাইনি। আজমিরে সারা বছর লাখ লাখ লোকসমাগম হয়, সিলেটে হযরত শাহজালালের কবর দিনরাত আলোকিত থাকে তেমনটা রাজা-বাদশাহর কবর থাকে না। হাই কোর্টের পাশে খাজা নাজিমউদ্দিন, শেরেবাংলা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এক ছাদের নিচে ঘুমিয়ে আছেন। অনেকবার দেখেছি কবরের ওপর বিঘত পুরু ধুলো জমে থাকে। কিন্তু পাগলদের কবরে তেমন থাকে না। তাই সেদিন ফালু চানের মাজার বা কবরে বলেছিলাম, দেশের নেতা, মন্ত্রী হওয়ার চেয়ে ফালু চানের ভক্ত হওয়া ভালো। সেই কবে তিনি দেহ ত্যাগ করেছেন, এখনো মাসব্যাপী লাখ লাখ মানুষ তার কবরে আসে, দোয়া করে। নিজের টাকায় খাসি-মুরগি কিনে কবরের আশপাশে রান্না-বান্না করে কিছু মাজারে দিয়ে বাকিটা নিজেরা খেয়ে ‘ফাইলাও নাচে, আমিও নাচি’ বলে লাফাতে লাফাতে বাড়ি ফেরে। ভক্তরা মাজারে যে পরিমাণ আগরবাতি, মোমবাতি দেয় তা বিক্রি করে ১০০ পরিবার সারা বছর চলতে পারে একই মোম পঞ্চাশবার বিক্রি করে। ফকির বা পাগলরা মরেও মানুষ পালে, আমরা নেতারা জীবিতকালেও মানুষের তেমন কাজে লাগি না— তাই বলেছি।

দু-চার-দশ বছর আগে জেলা শহরে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী নতুন গেলে ফোন-টোন করে পরিচিত হতেন। ডিসি-এসপির ক্ষেত্রে মনে হতো ব্যাপারটা যেন বাধ্যতামূলক। কয়েক বছর যাবৎ সেগুলো খুব একটা দেখি না। টাঙ্গাইলের ডিসি বছরখানেক হলো গেছেন। প্রথম দেখা হয়েছিল এক ইফতারিতে। একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছিলাম। কথাবার্তায় বেশ ভালোই লেগেছিল। সেদিন তার দফতরে গিয়েছিলাম। চমৎকার! দেখা যাক পরবর্তী দিনগুলো কেমন হয়। এসপির মনে হয় চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। যে কবার দেখেছি বেশ ভালো লেগেছে। অহংকার নেই, সাদামাটা মানুষ। আমাদের যথাযথ সম্মান দেখানোর চেষ্টা করেন। কোনো কথা বললে সম্ভব হলে শোনার চেষ্টা করেন। আমরাও এ বয়সে খুব একটা বেশি কিছু কামনা বা বাসনা করি না।

যা লিখব বলে ভেবেছিলাম এখন সেদিকে দৃষ্টি দিই। এই শীতে প্রাথমিক শিক্ষকরা শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়েছিলেন। একপর্যায়ে তারা অনশনে গিয়েছিলেন। অনশনের দ্বিতীয় দিন শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম। শিক্ষকরা অনশনের নিয়ম-কানুন জানেন না। দাঁতে খিল এঁটে পড়ে ছিলেন। অনেকেই জানেন না ৭০-৮০ ঘণ্টা পানি পান না করলে জীবনের তরে কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। আর কিডনি মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কিডনি ফেল করলে জীবন ফেল। মহাত্মা গান্ধী, বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনশন করেছেন, কালো মানিক লুথার কিং দীর্ঘদিন অনশন করেছেন। কিডনি বাঁচাতে অনশনেও ক্ষণে ক্ষণে অল্প অল্প পানি পান করতে হয় আমাদের শিক্ষকরা তাও জানেন না। তাই তাদের পদ্ধতি বাতিয়েছিলাম। তারা কথা শুনেছিলেন কি শোনেননি বলতে পারব না। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়লে কাউকে হাসপাতালে কাউকে অবস্থানস্থলেই স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। মুখে অল্প অল্প পানি পান করা আর স্যালাইন দেওয়া একই কথা। শরীর পানি পেলেই হলো। শরীর পানি পেলে আর মৃত্যুজনিত দুর্ঘটনার তেমন ভয় থাকে না। শিক্ষকদের দাবি ছিল প্রধান শিক্ষক আর সহকারী শিক্ষকের বেতন ও গ্রেড বৈষম্য। তাদের দাবি ছিল ন্যায্য। ’৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার যখন প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন তখন প্রধান শিক্ষক আর সহকারী শিক্ষকের বেতনের পার্থক্য ছিল ১০ টাকা। প্রধান শিক্ষক আর সহকারী শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরীক্ষা সবই এক। তাই বেতনও হওয়া উচিত এক সমান। সবাই একই কাজ করলেও প্রধান বলে নাম থাকায় বঙ্গবন্ধু যথার্থই ১০ টাকা বেশি দিয়েছিলেন। এখন না হয় ২০ টাকা বেশি দিলেন, ২০ টাকার জায়গায় ২০০ টাকা। তার বেশি দেওয়া উচিত নয়, তাতে বৈষম্য বাড়বে। শহীদ মিনার থেকে ফিরেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে পত্র দিয়েছিলাম। পরদিন শিক্ষকদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে, বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বড় ভালো লেগেছে।

সেদিন গিয়েছিলাম নন-এমপিও শিক্ষকদের সমাবেশে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষকদের রাস্তায় ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে মনটা বড় বিষিয়ে গিয়েছিল। খুবই খারাপ লেগেছিল। এই সরকার শিক্ষকদের কত সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। লাখো শিক্ষকসহ কয়েক হাজার স্কুলকে এমপিওভুক্ত করেছে। ১৫-২০ বছর শিক্ষাদান করা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক এখনো এমপিওভুক্ত হননি, বাইরে পড়ে আছেন। কে এক পণ্ডিত বলেছেন, নন-এমপিও শিক্ষকদের জন্য নীতিমালা করতে হবে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, অর্থমন্ত্রী অর্থ বরাদ্দ করলে তবেই শিক্ষকদের দাবি নিয়ে ভাবা হবে। কী আশ্চর্য! অর্থমন্ত্রীর কাছে বরাদ্দ না চাইলে তিনি কীসের ওপর বরাদ্দ দেবেন? আর নীতিমালা? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির নীতিমালা বহু বছর থেকে আছে। প্রথমে এলাকার কিছু বিদ্যোৎসাহী লোকজন একটা প্রতিষ্ঠান গড়েন, কেউ জায়গাজমি, কেউ ঘরদুয়ার, কেউ চেয়ার-টেবিল দেন, শিক্ষকরা উৎসাহিত হয়ে পাঠদান শুরু করেন। নবগঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা অন্য স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক বছর পরীক্ষা দেয়। পাসের হার ভালো বা সন্তোষজনক হলে প্রতিষ্ঠানকে পাঠদানের অনুমতি বা স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পাঠদানের অনুমতি বা স্বীকৃতির কয়েক বছরের মধ্যে আপনাআপনি শিক্ষক ও স্কুল উভয়কে এমপিওভুক্ত বা সরকারিকরণ করা হয়। এমপিওভুক্ত হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর সেই প্রতিষ্ঠানে সরকারি ঘর নির্মাণ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। আগে কোনো স্কুল বা কলেজে দালান করার জন্য নির্দিষ্ট শর্ত থাকত প্রতিষ্ঠানটিকে ১০-২০ বছরের পুরনো হতে হতো। কিছু শর্ত এখনো আছে। তার পরও আমরা বিশেষ বিবেচনায় অনেক স্কুল-কলেজ এমপিওভুক্ত হওয়ার পরপরই দালান-কোঠা বরাদ্দ দিয়েছি। ব্যতিক্রম পৃথিবীর সব দেশে, সবখানে আছে। তাই এখানে নতুন করে কোনো নীতিমালার দরকার নেই। নীতিমালার কথা বলা অনেকটাই পণ্ডিতি, বাঙালকে হাই কোর্ট দেখানোর মতো। তাই প্রধানমন্ত্রীকে স্বয়ং সেখানে দৃষ্টি দিতে অনুরোধ করেছিলাম। কারণ, শিক্ষামন্ত্রী নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলন প্রত্যাহার করার অনুরোধ করলে তারা তার আশ্বাসে বিশ্বাস করে আন্দোলন প্রত্যাহার করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস চেয়েছিলেন। আমরা খুবই খুশি হয়েছি এই তীব্র শীতে শিক্ষকদের রাস্তায় ফেলে না রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার ব্যক্তিগত সচিব সাজ্জাদুল হাসানের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়েছেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহের সন্তান সাজ্জাদুল হাসানের বাবা যথার্থ নেতা এবং খুব ভালো মানুষ ছিলেন, এমপি ছিলেন। সেজন্য আমার মনে হয়েছে ভালো মানুষের সন্তানের দ্বারা ভালো কাজ করেছেন। ইবতেদায়ি শিক্ষকরাও রাস্তায় পড়ে আছেন। কোনো দলমত বিবেচনা না করে তারা আমার দেশের মানুষ, দেশের সন্তান, তাদের দাবি-দাওয়া বিবেচনা করা দরকার। তাদের এই তীব্র শীতে রাস্তা থেকে তুলে আনা উচিত— তাতে কারও কোনো ক্ষতি হবে না, বরং দেশের মঙ্গলই হবে।

সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় নতুন সদস্য নেওয়া এবং কয়েকজনের দফতর বণ্টন নিয়ে কয়েক দিন থেকেই ভাবছি, কষ্ট পাচ্ছি, বিব্রতবোধ করছি। মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত সরকারে প্রধানমন্ত্রী হবেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থিত নেতা। সেটা এক দলের হতে পারে, বহু দল মিলেও হতে পারে। সংসদে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর আস্থাভাজনরা হবেন মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর আস্থা না থাকলে কেউ মন্ত্রিসভায় থাকতে পারে না। সেদিক থেকে প্রধানমন্ত্রী যথার্থ করেছেন। তার ইচ্ছা হয়েছে প্রয়োজন পড়েছে নতুন মন্ত্রী নিয়োগ করেছেন। তিনি যথার্থই ভেবেছেন, দফতর বণ্টন করেছেন। এ সবই তার এখতিয়ার, সংবিধানের নির্দেশ। এখানে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু যা সব দেখছি-শুনছি বিরক্তিতে মন ভরে যাচ্ছে। আমাদের নাগরপুরের মেয়ে স্বাধীনতার পর সাধারণ শিল্পীদের সঙ্গে দু-চার বার দেখেছি। এখন অনেক বড় হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুনজরে এসেছে, হঠাৎই প্রতিমন্ত্রী হয়েছে। তাকে দেওয়া হয়েছিল ডাক ও টেলিযোগাযোগ, এখন বদলি করা হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়ে। তা তার পছন্দ হয়নি। হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কেউ চিনত না, জানত না, বুঝত না, সেসব বুঝিয়েছে। এখন তাকে জিজ্ঞাসা না করে অন্য দফতরে বদলি করায় তার খুব লেগেছে। এমনও বলেছে, তিনি মানুষ তো, তাই অমন করলে বুকে লাগে। তাকে ছাড়া যেদিন স্যাটেলাইটের উদ্বোধন করা হবে সেদিন বুক চৌচির হয়ে যাবে। এমন অসন্তুষ্টি, এমন খেদ শুভ নয়। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তিনি শুরুও করেননি, শেষও করছেন না— এতে কষ্ট কোথায়? শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে আমলা-ফইলা নিয়ে নরক গুলজার করা কী এমন কষ্ট? তাহলে আমরা যে মুক্তিযুদ্ধ করলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধে যৌবন বিনষ্ট করলাম; কত গালাগাল, পুলিশের লাঠি, গাড়ি ভাঙচুর। আমাদের কষ্ট হয় না? আমরা মানুষ নই? আমাদের কি কিছুই লাগতে নেই? কী বলি এদের। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী! বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কর্মসূচি আপনার নয়, ওটা ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। শুরুতে লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন, তারপর আপনি এলেন, এখন আরেকজন। তাই আপনার এত ক্ষোভের কারণ কী? যা ছিলেন তাই আছেন। ওসব বলা আপনার শোভা পায় না। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে ব্যর্থতা আপনার, সফলতা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। এসব বলা আরও বাতুলতা। কম কথা বলুন, কাজ করার চেষ্টা করুন। তাতে অনেক বিপদ থেকে বাঁচবেন।

নতুন মন্ত্রী জনাব জব্বার তাকে নিয়ে বলেছেন, তিনি যা করেছেন তা নাকি বলার মতো নয়। বিরক্ত হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি কী করেছেন সে তো সবাই জানে। তার যদি অত লাগে তাহলে পদত্যাগ করলেই পারেন। না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এসব লোক যাদের দয়া করে মন্ত্রিত্বে বসিয়েছেন তাদের কাছে অতটা মর্যাদাবোধ আশা করবেন না। ওটা আমাদের কাছে আশা করতে পারতেন। দেশ সঠিকভাবে চললে এবং সঠিক রাজনৈতিক মূল্যায়ন থাকলে আপনি এদের কাউকে মন্ত্রী বানাতেন না, বানাতে পারতেন না। আপনার অন্নে পালিত মন্ত্রী শুধু দফতর বণ্টনে আপনার প্রতি এত ক্ষোভ! এ ক্ষোভ শুধু আপনার প্রতি নয়, এ ক্ষোভ দেশের প্রতি, দেশাত্মবোধের প্রতি। এদের বিদেয় করা উচিত।

নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বিমানমন্ত্রী বলেছেন তিনি রক্ত দিয়ে বিমানকে লাভজনক করবেন— এটা কোনো কথা হলো! রক্ত দিয়ে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে লাভজনক করা যায়? ওটা কি গুণ্ডামির ব্যাপার, নাকি মেধা ও যোগ্যতার ব্যাপার? কেন যেন সবাই গায়ের জোরে চলতে চান। আপনার বিমানযাত্রায় ত্রুটির জন্য বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের গাড়ি থেকে পতাকা খুলে নিতে চেয়েছিলাম। মাকে, বাবাকে, বঙ্গবন্ধুকে খুব বেশি স্বপ্নে দেখি না। আসলে আমি খুব একটা স্বপ্নই দেখি না। হয়তো কালেভদ্রে দু-চার বার দেখেছি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে যে অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এক রাতে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম যুদ্ধ শেষে পার্ক ময়দানে তার কাছে অস্ত্র জমা দিচ্ছি। স্বপ্নে যা দেখেছিলাম বাস্তবে সেভাবেই নেতা ও পিতার পায়ের সামনে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিলাম। পার্থক্য শুধু সেটা পার্ক ময়দানের জায়গায় বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠ ছিল। অন্য কোনো হেরফের ছিল না। যা বলি হৃদয় দিয়ে তা করার চেষ্টা করি। রাশেদ খান মেননের গাড়ি থেকে পতাকা খুলে না নেওয়া সেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বপ্ন দেখার কারণ।

কীভাবে যেন এক সকালে ফজরের নামাজের আগে আগে আমরা পাশাপাশি হাঁটছিলাম। নেতা বললেন, তুই এটা কী করছিস। মেননের গাড়ির পতাকা তোকে খুলে নিতে হবে কেন। মেনন কি অত যোগ্য যে তুই তার গাড়ির পতাকা খুলতে যাবি? মেনন পতাকা আনেনি, পতাকা তুই এনেছিস। অপছন্দ হলে বিরক্ত হলে আমার গাড়ির পতাকা খুলে নিলে সেটা তোকে মানাত। মেননের পতাকাবাহী গাড়ির দিকে তোর তাকিয়েও দেখা উচিত নয়। আমি অনেক দিন ভেবেছি, আমি যে কথা দিয়েছিলাম তার কী হবে। পরে মনে হয়েছে পিতার স্বপ্নাদেশই যথার্থ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেননের গাড়ির পতাকা খুলে কেন তাকে বিখ্যাত করতে যাব। দরকার কী? বিএনপি রাজাকারদের গাড়িতে পতাকা তুলেছে, আওয়ামী লীগও নুরু মাওলানার গাড়িতে পতাকা তুলেছে। মহীউদ্দীন খান আলমগীর, আশিকুর রহমান পতাকা উড়িয়েছে। আমার রক্তে ভেজা পতাকা কেউ কম অপমান-অবজ্ঞা করেনি। তাই আর রাস্তায় জনাব মেননের গাড়ির পতাকা খুলতে যাইনি। আপনি দিয়েছিলেন, আপনিই আবার বদলে দিয়েছেন এটা আপনার ব্যাপার।

২০ বছর হয় আওয়ামী লীগ ছেড়েছি। আওয়ামী লীগে জন্ম আমার। বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে লালন করে রাজনীতিতে এসেছি, তাকে ধারণ করে বাকি জীবন কাটাব। কিন্তু কেন যেন আওয়ামী লীগ নিয়ে আজেবাজে কথা হলে বুকে বাধে, খারাপ লাগে। সত্যিই কি আপনার সরকার আপনার দল আওয়ামী লীগ, আপনার মার্কা নৌকা ডুবে গেছে যে নেত্রকোনা খালিয়াজুড়ির জনাব মোস্তাফা জব্বারের মতো একজন সাধারণ কম্পিউটার ব্যবসায়ীকে ডুবন্ত নৌকা জাগাবার দায়িত্ব দিয়েছেন? তার এই ঔদ্ধত্য আপনার জন্য আওয়ামী লীগের জন্য সরকারের জন্য সম্মানের না অসম্মানের? একটুও কি বিবেচনা করার নেই? এই জব্বারের দেশের জন্য কী ভূমিকা আছে? আমার এখনো মনে আছে খাদ্যমন্ত্রী মোমেন ভাই যখন বেঁচে ছিলেন, সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত যখন ছিলেন তখন খালিয়াজুড়ির মিটিংয়ে নেত্রকোনা থেকে হেঁটে মদন, সেখান থেকে নাওটানা হয়ে নৌকায় খালিয়াজুড়ি মিটিং করতে গিয়েছিলাম। তখন জনাব জব্বারের সেই মিটিংয়ে বক্তৃতা করা দূরের কথা, মাইকে কিছু বলার যোগ্যতাও ছিল না। এই কয়েক বছরে কী এমন হলো যে তিনি ডুবন্ত নৌকা জাগাতে পারেন? খুব খারাপ ও কষ্ট লেগেছে তাই কথাটি না বলে পারলাম না। বাংলা সফটওয়্যার তৈরি করলেই তিনি তো আর আইনস্টাইন হননি। এমন কেন হবে? দেশের নাগরিক হিসেবে মন্ত্রীদের এমন ঔদ্ধত্য সম্পর্কে আমাদের কি কিছুই বলার নেই? মুক্তিযুদ্ধে জনাব জব্বারের কী ভূমিকা ছিল? আওয়ামী রাজনীতিতে তার অবস্থান কোথায়— উপজেলা, জেলা বা কেন্দ্রে? কিছুই না। এসব লোককে মন্ত্রী বানালে রাজনীতির শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, বড়-ছোট নেতা-কর্মীর পার্থক্য থাকে না। এমন হওয়ার কারণে কেউ কারও কথা শোনে না, সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়, ভালো থাকতে পারে না, খারাপ ধরিবাজরাই বরং এগিয়ে যায়। তাতে সমাজ অশান্তি ও মানুষ অস্বস্তিতে পড়ে।

লেখক : রাজনীতিক।

সর্বশেষ খবর