মঙ্গলবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সবকিছু তছনছ করছেন নরেন্দ্র মোদি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

সবকিছু তছনছ করছেন নরেন্দ্র মোদি

৪৪ মাস ক্ষমতায় থাকার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গোটা দেশটাকে আর্থিক, সামাজিক, ধর্ম সব দিক থেকে তছনছ করে দিয়েছেন। তার চ্যালাচামুণ্ডারা বিকাশ পুরুষ বলে যতই প্রচার করুন না কেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অটল বিহারি বাজপেয়ি মন্ত্রিসভার তিন সাবেক সদস্য যশবন্ত সিনহা, অরুণ শৌরী, চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা এবং মোদির ঘনিষ্ঠ সুব্রাহ্মণ্যম স্বামী অভিযোগের পর অভিযোগ এনে বলছেন, মোদি বিকাশ পুরুষ নন, বিনাশ পুরুষ। তিনি ভারতকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছেন। এই আশঙ্কা শুধু বিজেপি নেতাদের নয়, ভারতের মানুষের। ভারত শুধুই হিন্দুদের; অহিন্দুরা ভারতের নাগরিক হতে পারেন না, এই মন্তব্য করেছেন মোদি মন্ত্রিসভার এক সদস্য।

একটার পর একটা ক্ষেত্রে ভারতের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগ তুলে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব বলেছেন, এ দেশ জাতিধর্মনির্বিশেষে সবার দেশ। ইতিহাস বিকৃতি না ঘটানোর জন্য তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন। এদিকে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে মারাত্মক অপরাধের কয়েকটি মামলা ছিল। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে সেসব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। মোদি দুর্নীতিমুক্ত ভারত গড়তে চেয়েছিলেন। ৪৪ মাস পর দেখা যাচ্ছে মোদি নিজেই দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছেন।

বিজেপিবিরোধী দলগুলো খোঁচা দিচ্ছে ফরাসি দেশ থেকে রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনার ক্ষেত্রে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে মোদি মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন কেন? বিজেপি সভাপতি অমিত শাহর ছেলে জয় শাহ সরকারের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা অনুদান পেলেন কেন? এ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে।

বিরোধীরা এসব অভিযোগ করলে আগে বিজেপির তরুণ নেতারা ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এখন তারা ফিফটি নট। প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ রাফায়েল বিমান কেনায় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিলেও সাবেক সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাফায়েল বিমান কেনার ব্যাপারে মোদি সরকার বড় ধরনের কাটমানি নিয়েছে। এদিকে গত বছর গুজরাট নির্বাচনে আসনের হিসাবে বিজেপি জিতলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। বিজেপির অন্দরমহলের খবর হলো— আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে মোদি গুজরাট ছেড়ে কলকাতা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। কলকাতায় বিজেপি অফিস মুরলিধর সেন লেনে কান পাতলেই শোনা যায়, মোদিজি কলকাতা থেকে দাঁড়ালে পশ্চিমবঙ্গে লোকসভার অনেক আসনে তারা জয়ী হবেন। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস এবং বামপন্থিদের বক্তব্য হলো, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। কারণ মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটে সাম্প্রতিক নির্বাচনে সংসদীয় কেন্দ্রের ছটি আসনেই বিজেপি হেরে গেছে। বেনারস থেকে অন্য যে একটি আসনে তিনি জিততেন, সেখানকার পৌর নির্বাচনেও বিজেপি হেরে গেছে।

এ বছরই ভারতের মোট সাতটি রাজ্যে নির্বাচন হবে। তার মধ্যে ছটি বিজেপি-শাসিত। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, ত্রিপুরা, মণিপুর, কর্ণাটকে নির্বাচন হবে। এর মধ্যে কর্ণাটক কংগ্রেস-শাসিত রাজ্য। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ কোটি টাকার দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে এসে গেছে। ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী রমণ সিংয়ের নাম পানামা অ্যাকাউন্ট কেলেঙ্কারিতেও এসেছে।

ভারতের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এ বছরের রাজ্যগুলোর নির্বাচনই ইঙ্গিত দেবে আগামী বছর মোদি ক্ষমতায় আসতে পারবেন কিনা। গেরুয়াবাহিনী হিটলারি কায়দায় প্রচার শুরু করেছে ভারতবর্ষ একদিন না একদিন হিন্দুরাষ্ট্র হবেই। এমনকি সম্প্রতি পশ্চিম ভারতের গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গোয়া প্রভৃতি রাজ্যে তিন-চার দিন ধরে দলিতদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সংকট তৈরি হয়েছে, বিজেপি নেতৃত্ব সে ব্যাপারে একটি কথাও বলছে না। এই দলিতদের নেতা হলেন ভারতের সংবিধানের খসড়া তৈরির সদস্য বাবাসাহেব আম্বেদকরের নাতি প্রকাশ আম্বেদকর। তিনি একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আরএসএসের গেরুয়াবাহিনী গান্ধীজিকে হত্যা করে এত দিন চুপচাপ ছিল। এখন দলিতদের হত্যা করার জন্য আন্দোলন শুরু করেছে। অহিংস ধর্মে দীক্ষিত দলিতরা আরএসএসকে ক্ষমা করবে না। আমরা লড়াই করে যাব। তবে এই লড়াই যে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা কেউ জানে না। নতুন এক লড়াই সৃষ্টি হয়েছে তিন তালাককে কেন্দ্র করে। সদ্যসমাপ্ত ভারতের সংসদের স্বল্পকালীন অধিবেশন শেষ হয়েছে। ‘মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’ ছাড়া সব দলই লোকসভায় তালাকের পক্ষে রায় দিলেও রাজ্যসভায় গিয়ে বিলটা আটকে যায়। রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতার সঙ্গে হাত মিলিয়ে সব বিরোধী দল ও এনডিএ শরিকরাও বিলটি পাস করতে দেননি। তাদের দাবি হলো, তিন তালাকের পর স্ত্রী ও সন্তানদের কে দেখবে, সে ব্যাপারে আইন করতে হবে। তিন তালাক আইনে বলা হয়েছে, তালাক দিলে স্বামীকে তিন বছর জেল খাটতে হবে। এ আইন বিরোধীরা মানতে নারাজ। স্বামী জেলে চলে গেলে পোষ্যদের কী হবে সে প্রশ্ন তুলে বিরোধীরা সাত-আট দিন অধিবেশন বন্ধ করে দেয়। বিরোধীদের নেতৃত্বে সামনের সারিতে আছে কংগ্রেস।

বিধানসভাগুলোর আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেট অধিবেশন এগিয়ে আনা হয়েছে। তিন তালাক বিলের প্রশ্নে বিজেপির অবস্থান আরও খারাপ হয়ে যায় তাদের শরিক তেলেগু দেশম, এডিএমকে, বিজেডির মতো দলগুলো বেঁকে বসায়। বিল পাস করানোর ব্যাপারে সবাই যাতে হাজির থাকেন, সেজন্য হুইপ জারি করেছিল বিজেপি। পাল্টা হিসেবে হুইপ জারি করেছিল কংগ্রেসও। তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ ঘোষণা করে তিন বছরের কারাদণ্ডের অর্ডিন্যান্স জারি করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কিন্তু বিজেপির একটা অংশ মনে করছে, অর্ডিন্যান্স জারি করার বদলে কংগ্রেসকে দোষারোপ করতে পারলে রাজনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হওয়া যাবে। সে কারণেই বিলটিকে সিলেক্ট কমিটিতে পাঠাতে রাজি নয় সরকার। সে ক্ষেত্রে বিজেপি রাজনীতি করার সুযোগ হারাত। সেই সুযোগ নিয়ে বিজেপির সংসদবিষয়ক মন্ত্রী অনন্ত কুমার বলেছেন, মুসলিম বোনদের কথা ভাবছেন না রাহুল গান্ধীরা। ওরা ফের শাহ-বানোর মতো অন্যায় করছেন। রাহুল পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার তিন তালাক বিল নিয়ে এত তত্পর। অথচ লোকপাল বিল নিয়ে তাদের তত্পরতা নেই কেন? যে স্লোগান দিয়ে মোদি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই আচ্ছে দিন দূর দিগন্তেও দেখা যাচ্ছে না ৪৪ মাস পর। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিরোধীদের মত, এখন গোটা ভারতেই কালো অন্ধকার নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হলে  ২০১৯ সালের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দলকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। হিন্দু ভারতের নামে গোটা দেশে যে চোরাগোপ্তা হামলা চলছে, তা বন্ধ করাও এ মুহূর্তে খুব দরকার।

লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর