শিরোনাম
শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সবজি চাষের আরেক সফল নায়কের গল্প

শাইখ সিরাজ

সবজি চাষের আরেক সফল নায়কের গল্প

গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম গেলাম খুব কাছের একজনের অনুরোধে। প্রফেসর ড. গৌতম বুদ্ধ দাস। আমার ছোট ভাই তুল্য একজন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সদালাপী আর ত্বরিত্কর্মা উদ্যোগী এক মানুষ। সেই নব্বই দশক থেকে পরিচয়, তখন সে বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। যা হোক, গৌতম তার বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষাবর্ষের সমারম্ভ অনুষ্ঠানের সমারম্ভ বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানাল।  আমন্ত্রণটি কোনোভাবেই উপেক্ষা করা গেল না। ভাবলাম, রথ দেখা কলা বেচা দুটিই হবে। যা হোক গিয়ে অনুষ্ঠানে যোগদানের পাশাপাশি অনেক কাজের সুযোগ হলো। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকটি বিভাগ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। সেখানেও কিছু কাজ করলাম। সেটি নিয়ে আগামী সংখ্যায় আলোচনা করব। আমাদের চট্টগ্রাম অফিসপ্রধান চৌধুরী ফরিদ এক কৃষকের খোঁজ দিলেন। চট্টগ্রাম নগরীতে তার বিশাল এলাকায় চাষাবাদ। 

বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এখনো অনেক এলাকাই রয়েছে যেগুলোতে নগর গ্রাস করেনি। হয়তো একদিন করবে। এমন একটি এলাকা রয়েছে দক্ষিণ হালিশহরে। নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে বর্জ্য আবর্জনার ভাগাড়ের ভিতর দিয়ে আসা একটি রাস্তা মিলেছে এক কৃষি সাম্রাজ্যে। সাম্রাজ্য এ কারণে বলছি যে, সেখানে আবাদি এলাকা সুবিশাল আয়তনের। এ কৃষি সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন কৃষক মুহম্মদ মহসীন। গ্রামীণ কৃষি আবাদি এলাকাগুলোতে এক দাগে একক মালিকানায় এত দীর্ঘ আয়তনের জমিও খুঁজে পাওয়া যায় না আজকাল। তবে এ জমি মহসীনের নয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই লিজ নিয়ে আবাদ করে আসছেন।

মহসীন আদি চাটগাঁইয়া। তার বাবা ছিলেন সওদাগর। বেশ কয়েকটি মাছের নৌকা আর দোকানপাট ছিল। পৈতৃকভাবে সম্পদ-সম্পত্তি তেমন না পেলেও পেয়েছেন ব্যবসায়ী মন। এ বাণিজ্যিক মানসিকতাই তাকে আজ তৈরি করেছে আদর্শ কৃষক হিসেবে। আজকের দিনে কৃষি মানেই বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনা আর হিসাব-নিকাশের ব্যাপার। এ দিকটাতে মহসীন যথেষ্টই পাকা। শীতের সকালে মহসীনের খেতে গিয়ে দেখি সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ময়লার পাহাড়ের পাশে ২০০ কানি জমি লিজ নিয়ে ১০০ কানিতে তৈরি করেছেন বিশাল টমেটো খেত।

আজকাল আর এত সকালে কৃষকের মাঠে কর্মব্যস্ততা শুরু হয় না। কিন্তু মহসীনের খেতে গত দেড় মাস ধরে এমন সকালেই শুরু হয়ে যায় শ্রমিকদের টমেটো তোলার ব্যস্ততা। প্রতিদিন কয়েক টন টমেটো এ খেত থেকে যাচ্ছে বাজারে। সারি বেঁধে শ্রমিকরা সংগ্রহ করছে আধাপাকা টমেটো। জড়ো হচ্ছে এক জায়গায়। টমেটো তোলার এক ফাঁকে শ্রমিকরা আয়েশ করে বসলেন চা পানে। সেখানে বসেই কথা হলো শ্রমিকদের সঙ্গে। দেখলাম অধিকাংশ শ্রমিকই চট্টগ্রামের বাইরের। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের। শ্রমিকরা দীর্ঘদিন ধরেই মহসীনের এ কৃষি খামারের সঙ্গে যুক্ত। যেখানে কৃষি শ্রমিক সোনার হরিণ, সেখানে মহসীনের খামারে শ্রমিকের অভাব হয় না। কারণটা পরিষ্কার। কথা ও কাজে স্বচ্ছ মহসীন। সকালে দুবার চা-নাস্তার ব্যবস্থা করে সে, দুপুরে ভাত, বিকালে আবার নাস্তা। যারা স্থায়ী শ্রমিক তাদের জন্য রয়েছে রাতের খাবারের ব্যবস্থাও। সময়মতো বেতন মিটিয়ে দেন মহসীন। দেশের সব এলাকায় এ রেওয়াজ নেই। কৃষি শ্রমিকদের এমন অতিথির মতো আপ্যায়নের ব্যাপারটিও চোখে পড়ে না। মনে আছে বছর দশেক আগেও দেশের অধিকাংশ এলাকায় কৃষি শ্রমিকদের জন্য জমির মালিকরা নিয়ে আসত গামলা ভরে ভাত, সঙ্গে শুকনো মরিচ ভর্তা বা শুঁটকি ভর্তা। শ্রমিকরা যেন বেশি খেতে না পারে তার জন্য প্রচুর ঝাল দেওয়া হতো ভর্তায়। এখন অনেক জায়গায় এর ব্যতিক্রম দেখছি। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে যশোরের কোদালিয়া গ্রামের জমির আলীর শেখের কথা। গত বছরের ঠিক এ সময়ে তার বাঁধাকপির খেতের আলে বসে মরিচ ভর্তা দিয়ে খিচুড়ি খাচ্ছিলেন মালিক-শ্রমিক একসঙ্গে বসে। শ্রমিকদের রীতিমতো অতিথির মতো আপ্যায়ন করা হচ্ছিল। তাদের সঙ্গে আমিও বসে গিয়েছিলাম এ আপ্যায়নে সুযোগ নিতে। কৃষকের স্ত্রী সবার পাতে ঢেলে দিচ্ছিলেন শর্ষে তেল। শ্রমিক-মালিকের এ বৈষম্যহীন সহাবস্থান দেখে বড় অভিভূত হয়েছিলাম। এবার একই রকম ভালোলাগা তৈরি হলো মহসীনকে দেখে। মহসীন বড় কৃষক, সে দক্ষ শ্রমিকের মূল্যায়ন করে।

কৃষিতে নানামুখী বৈচিত্র্য সৃষ্টি হওয়ায় উত্তরাঞ্চলের শ্রমিকদের এখন কাজের সন্ধানে খুব একটা বাইরে যেতে হয় না। যারা দীর্ঘদিন ধরেই বাইরের জেলায় কৃষিজমিতে কাজ করতে অভ্যস্ত তারা খেতমজুরের কাজেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। মজুরিও বেশ ভালো। আগেই বলেছি কৃষি শ্রমিকের অধিকাংশই উত্তরাঞ্চলের। এর মধ্যে কেউ কেউ কাজ করছে ২০ বছর ধরে এ একই খেতে। তাদেরই একজন আজিজার রহমান। লালমনিরহাটের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ২০ বছর আগে একদিন ভাগ্যের সন্ধানে হাজির হয়েছিলেন মহসীনের খামারে। প্রতিবার ফসল তুলে বাড়ি যান। আবার ফিরে আসেন কর্মক্ষেত্রে। জানালেন, ভালোই আছেন, ভালোই চলছে সংসার ও জীবন।

আর এক তরুণী কৃষি শ্রমিক আমেনা বেগম। বাড়ি ভোলা। স্বামী নেই। দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার। কথা হলো তার সঙ্গে। জানালেন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কাজ করেন। তারপর দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি। আবার বিকাল ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন এ খামারে। মেয়ে দুটিকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। কৃষি খামারে কাজ করে চলে যাচ্ছে সংসার।

আসা যাক মহসীনের কথায়। মহসীন ৩০ বছর আগে যখন জনৈক ইকবাল মিয়ার জমিতে আবাদ শুরু করেন, তখন এ এলাকা ছিল তরমুজ চাষ অধ্যুষিত। পতেঙ্গার তরমুজের খুব চাহিদা ছিল। এখন তেমন তরমুজ হয় না। সবজি চাষেই কৃষক অনেক বেশি লাভবান। এবার যেমন টমেটোর বাজার খুব ভালো। স্থানীয়ভাবে প্রফিট আর্লি নামে এক জাতের টমেটো চাষ করেছেন মহসীন। বললেন, মৌসুমের শুরুতে ১২০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে টমেটো বিক্রি করেছেন। তারপর ১১০ টাকা, ১০০ টাকা দরে, ৮০ টাকা দরে এবং এখন ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। ১০০ কানি জমিতে টমেটো আর বাকি ১০০ কানিতে লাউ, ফুলকপি, বাঁধাকপি চাষ করতে খরচ হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা। প্রতিদিন প্রায় ছয় টন টমেটো তুলে বাজারে পাঠাচ্ছেন। আশা করছেন কমপক্ষে এক কোটি টাকার টমেটো তিনি বিক্রি করতে পারবেন। তাহলেও লাভ থাকবে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। কৃষক বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হলে আর তেমন সমস্যা থাকে না। মহসীনের ক্ষেত্রেও তাই। জানতে চেয়েছিলাম সমস্যাগুলোর কথা। জানালেন, সময়মতো সার পেতে মাঝে মাঝে সমস্যা হয়। এ ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা নেই।

মহসীন শ্রমিকদের ব্যাপারে যথেষ্টই সংবেদনশীল। শ্রমিকরাই তার সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক সাফল্য আসার পর তিনি আরও বেশি সদয় হয়েছেন তাদের প্রতি। যদিও মহসীন জানালেন এখনকার কৃষিতে শ্রমিকের ব্যয় সবচেয়ে বেশি। মহসীন খুবই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। চাটগাঁইয়া বনেদি স্বভাবটিও রয়েছে তার। জমি মালিকের কাছেও দারুণ বিশ্বস্ত তিনি।

আমাদের উপস্থিতির কথা জেনে মহসীনের খেতে আসেন এলাকার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুবীর কুমার সেন। তিনি জানালেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এ হালিশহরেই এখনো রয়েছে বিস্তীর্ণ কৃষি আবাদি এলাকা। সেখানে বেশি আবাদ হচ্ছে টমেটো। এ সুবীর কুমার সেনই মহসীনকে উদ্বুদ্ধ করেছেন টমেটোতে কীটনাশক প্রয়োগ না করে জৈব পদ্ধতি ব্যবহারে। চোখে পড়ল খেতে রয়েছে অসংখ্য সেক্স ফেরোম্যান ট্র্যাপ।

দেশে সবজি চাষে যে বিপ্লব ঘটে গেছে তার পেছনে রয়েছে মহসীন আলীর মতো উদ্যোগী কৃষকের অবদান। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন উদ্যোগী কৃষকের সঙ্গে আমাদের দেখা হচ্ছে, যারা আমাদের সবজির চাহিদা যেমন পূরণ করছেন, একইভাবে সামগ্রিক কৃষিকে করে তুলছেন লাভজনক। এখন স্বল্পমেয়াদি সবজি চাষ কৃষকের জন্য সবচেয়ে লাভজনক। একইভাবে সবজি উঠে গেলে সঠিক সময়ে ধানের মৌসুমও ধরছে কৃষক। এ খেতে টমেটো ওঠে গেলে বোরো আবাদ করবেন মহসীন।  সব ফসলের নাবি কিংবা আগাম জাতগুলোর তথ্যও কৃষকের জানা। সব মিলিয়ে ফসল বৈচিত্র্যে তারা একবিন্দুও পিছিয়ে থাকছে না।  মহসীনের মতো সফল ও উদ্যোগী কৃষকের চিন্তাভাবনা ও ধারণাগুলো অন্য যে কোনো কৃষকের জন্য হতে পারে অনুসরণীয়।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর