শনিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সচলের জন্য করণীয়

ফেরদৌস আরা বেগম

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে, মানে স্পেশাল ইকোনমিক জোনে (এসইজেড) শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য প্লট বরাদ্দের বিষয়টি বেসরকারি খাত সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েকটি আলোচনায় তুলে ধরেছে। এসইজেড গড়ার ধারণাটির সূচনা হয় বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনস অথরিটি (বেপজা) গঠন এবং ২০১০ সালে এসইজেড অ্যাক্ট বলবৎ করার মধ্য দিয়ে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উপযুক্ত হতে পারে এসইজেড। শুল্ক প্রক্রিয়ার সবকিছু বজায় রেখে এখানে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি বা দেশে বিক্রি করা যাবে। প্রথম এসইজেড স্থাপিত হয় পুয়ের্তো রিকোয়, ১৯৪৭ সালে। আয়ারল্যান্ড ও তাইওয়ানে হয়েছে ১৯৬০ সালে। সবচেয়ে সফল এসইজেড হয় চীনের শেনঝেন শহরে, ১৯৭৯ সালে।

১০টি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের মানে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের (ইপিজেড) সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে (এর মধ্যে আটটি ইপিজেড হচ্ছে বেপজা চালিত আর দুটি বেসরকারি খাত চালিত) সরকার মনস্থির করে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি এসইজেড গড়ে তুলবে। বেসরকারি খাতের ৭৬টি জোনের জন্য এ পর্যন্ত ৩৬০১৬ হেক্টর (প্রায় ৮৯ হাজার একর) জমির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার আর আগ্রহ অপ্রচলিত খাতে নতুন প্রজন্মের বিনিয়োগকারী সৃষ্টির ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। নিম্নমধ্য আয়ের দেশ থেকে মধ্যআয়ের দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার পথে বিনিয়োগ আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে এসইজেড। সরকারি খাতে বিনিয়োগ বর্ধমান হলেও বেসরকারি খাতে প্রয়োজন-মাফিক বিনিয়োগ আসছে না।

মধ্যআয়ের দেশ হয়ে ওঠার জন্য বেশ কিছু লক্ষ্যমাত্রা আছে বাংলাদেশের। এগুলোর মধ্যে রয়েছে : মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, জিডিপিতে প্রস্তুতকারক খাতের অবদান ২১ শতাংশ, জিডিপির ৩৪ শতাংশ বিনিয়োগ থেকে হওয়া, বেসরকারি বিনিয়োগ ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ এবং বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) ৯৬০ কোটি মার্কিন ডলার। জিডিপি ও বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এসইজেড পালন করতে পারে তাত্পর্যময় ভূমিকা।

জানা গেছে, ৭৬টি এসইজেডের জন্য সরকারের হুকুমদখল করা ৩৬০১৬ হেক্টর জমিতে উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলছে। এটা সত্যিই এক উৎসাহব্যঞ্জক ব্যাপার যে, বেসরকারি ২০টি জোন অনুমোদিত হয়েছে এবং এর ১৩টিকে প্রি-কোয়ালিফিকেশন লাইসেন্সও দেওয়া হয়েছে। পাঁচটি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য বেপজা এ পর্যন্ত চারটি বেসরকারি কোম্পানিকে প্রি-কোয়ালিফিকেশন লাইসেন্স দিয়েছে। ১৫টি ইজেডের উন্নয়ন চলছে। এ জন্য বিনিয়োগ হয়েছে ৯১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, এতে করে ৪০০০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশে এসইজেড স্থাপন নিশ্চিতকরণে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বেপজা। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এ সংস্থাটিকে দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, লাইসেন্স প্রদান, ব্যবস্থাপনা, চালুকরণ ও নিয়ন্ত্রণের ম্যান্ডেট দেওয়া হয়েছে। বেপজার লক্ষ্য এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান এবং রপ্তানির মাধ্যমে ৪০০০ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) আয়োজিত সাম্প্রতিক এক সেমিনারে এসইজেড বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। সেখানে প্রশ্ন উঠেছে, বিরাট এ কর্মযজ্ঞ যথাসময়ে সম্পন্ন করার সক্ষমতা সরকারের আছে কি-না। জমিসংক্রান্ত বিষয়ও উদ্বেগাত্মক। জমি কেনা ও অধিগ্রহণ খুবই কঠিন কাজ।

জমির মালিকানা একটি জটিল ব্যাপার। জমি অধিগ্রহণ নীতির সহজিকরণ প্রয়োজন। ৫০ ভাগ জমি কেনা হলে ২০ ভাগ জমি অধিগ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছে বেসরকারি খাত। সরকারের সহায়তা ব্যতিরেকে জমি দখলে নেওয়া আর সেই জমিকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলাটা অত্যন্ত সমস্যাসঙ্কুল।

পূর্ণাঙ্গরূপে এসইজেড চালুকরণে দুই ধরনের উন্নয়ন আবশ্যক। অফসাইট উন্নয়নের মধ্যে থাকে অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ, ইউটিলিটি সাপ্লাই, কনটেইনার ডিপো, নদীবন্দর স্থাপন ইত্যাদি। এ ধরনের উন্নয়ন সাধন ও নিশ্চিতকরণ সরকারের কর্তব্য। অনসাইট উন্নয়নের মধ্যে পড়ে রাস্তা, ফ্যাক্টরি ও  ক্যাপটিভ পাওয়ার স্টেশন ইত্যাদি গড়ে তোলা। এসইজেডের ইনসাইট উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব ডেভেলপারদেরই।

সরকার-সরকারভিত্তিক কয়েকটি জোন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন— চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একটি চীনা জোন (সিইপিজেড)। সরকার সেখানে বিনামূল্যে জমি পাচ্ছে, অথচ বেসরকারি খাতকে কিনতে হচ্ছে। এ অবস্থা শুরুতেই বেসরকারি এসইজেডকে দুর্বল করবে।

এসইজেড গঠনের জন্য বেপজা বেশকিছু প্রণোদনা দেয়। যেমন : কর, শুল্ক ও আবগারি শুল্ক মওকুফ, অবাধ এফডিআই, ওয়ার্ক পারমিট, আবাসিক মর্যাদা ও নাগরিকত্ব প্রদানের সুপারিশ ইত্যাদি। বেসরকারি খাত মনে করে, গুচ্ছপ্রণোদনা ভিয়েতনাম, চীন ও সিঙ্গাপুর এসব দেশের মতো হওয়া উচিত। এসব দেশ আকর্ষণীয় গুচ্ছপ্রণোদনা দেওয়ায় সফলতা পেয়েছে।

দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে এসইজেডগুলোর উৎপাদন-সক্ষমতা অর্জন ও গড়ে ওঠার ব্যাপারটি এখনো সন্তোষজনক নয়। গত দুই বছরে সরকার বেশ কয়েকটি এসইজেড ঘোষণা করেছে; কিন্তু একটিও চালু হয়নি। বেসরকারি জোন মালিকরা জমি অধিগ্রহণের বেলায় বিস্তর সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তা ছাড়া বড় কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো দক্ষ জনশক্তিরও অভাব। কোনো এসইজেডের সফল যাত্রা ছাড়াই সাত বছর পার হয়ে গেল। চীনে আছে ১১টি এসইজেড। সবই গড়ে উঠেছে উপকূলীয় এলাকায়। জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের বিশাল অবদান— চীনের জিডিপির ১১ দশমিক ১ শতাংশ, ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান, দেশের মোট এফডিআই ৯ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যবহার, মোট রপ্তানির ৬০ শতাংশ এবং জাতীয় হাইটেক উৎপাদনের ৩৩ শতাংশ। শিগগিরই বাংলাদেশ উঠে যাবে চীনের স্তরে, এটা সম্ভব নয়।  তবে ইতিবাচক কিছু অর্জন তো করা যায়। নতুন নতুন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী বিদেশিদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। দেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গেও এসইজেডের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।  নীতিনির্ধারকদের উচিত দ্রুত প্রয়োগযোগ্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া এবং সেগুলো বাস্তবায়নে যত্নবান হওয়া।

লেখক : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিজনেস  ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট।

সর্বশেষ খবর