‘ইয়া ছালুহাত ছালুহাল জাছাদু কুল্লুহু ইযা ফাজিদাত ফাছাদাল জাছাদু কুল্লুহু আলা ওয়া হিয়াল কালব’ (বোখারি শরিফ)। মানব শরীরে এক টুকরা মাংসপিণ্ড আছে, যা পবিত্র হলে সমস্ত শরীর পবিত্র হবে, যা অপবিত্র হলে সমস্ত শরীর অপবিত্র হবে—তার নাম কালব। হাদিস শরিফে বর্ণিত : ‘রাজায়না মিন জিহাদিল আসগর ইলা জিহাদিল আকবর’। অর্থাৎ আমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদে পদার্পণ করেছি। ছোট জিহাদ ময়দানের জিহাদ, বড় জিহাদ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ। এ ছাড়া পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে : ‘ইন্নাকা কাদিহুন ইলা রাব্বেকা কাদহান ফামুলাকিহে।’ অর্থাৎ : নিশ্চয়ই তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে কঠোর সাধনায় সাধনা কর, তবে তাঁহার দর্শন লাভ করিবে। (সূরা ইনশেক্বাক-৬)।
যাহারা আল্লাহর সঙ্গে মোলাকাতের আরজু (আকাঙ্ক্ষা) না করে এই অস্থায়ী দুনিয়ার ভোগ-বিলাস নিয়ে ব্যস্ত থাকে ও তাতেই শান্তি পায়; তাদের শোচনীয় পরিণামের কথা আল্লাহপাক সুস্পষ্টভাবে কোরআন মজিদে জানিয়ে দিয়েছেন : ‘ইন্নাল্লাজিনা লা ইয়ারজুনা লিকাআনা ওয়া রাদু বিল হায়াতিদ্দুনইয়া ওয়াতমা আন্নু বিহা ওয়াল্লাজিনা হুম আন আয়াতিনা গাফিলুন; উলায়িকা মা-ওয়া হুমুন্নারু বিমা কানু ইয়াকছিবুন।’ [অর্থাৎ, নিশ্চয় যারা আমার দর্শনের আকাঙ্ক্ষা করে না এবং পার্থিব জীবনে পরিতুষ্ট থাকে এবং তাতেই পরিতৃপ্ত হয় এবং যারা আমার নির্দেশনাবলী সম্বন্ধে অমনোযোগী, তারা যা অর্জন করেছে তজ্জন্য, তাদের বাসস্থান নরকে হবে।] (সূরা ইউনুস-৭)।
এ জন্যই আল্লাহপাকের এসব নির্দেশের মর্ম অবগত হয়ে যুগে যুগে নবী, ওলি, সুফি-দরবেশগণ বিপথগামী মানুষকে সহজ ও সরল রাস্তার সন্ধান দিয়েছেন। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এসব সুফি-দরবেশ অজানা-অচেনা এবং শত্রু পরিবেষ্টিত দেশগুলোতেও আল্লাহর নির্ভীক সৈন্য হিসেবে আল্লাহর দীন জারি করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম জারির প্রাথমিক ইতিহাস এসব সুফি-দরবেশ ও ওলি-আল্লাহদের নামে ভরপুর, তন্মধ্যে কয়েকজনে নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যেমন হজরত খাজা মঈনউদ্দীন চিশতি (রহ.), হজরত শাহ জালাল (রহ.) ইত্যাদি।প্রকৃত আধ্যাত্মিক সাধনার কথা ও কাজের মধ্যে বিভিন্নতা থাকে না। তারা মনে ও মুখে এক। তারা এমন নির্দেশ দেন না, যা তারা নিজেদের জীবনে পালন করেননি। কথা ও কাজ এই উভয়বিধ দৃষ্টান্তের সাহায্যে তারা সাধারণ মানুষের মনে ধর্মভাব জাগরিত করে থাকেন। আল্লাহর নৈকট্য (কুরবত) অর্জনে অভিলাষী সাধকদের তারা বহু সাধ্য-সাধনা ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘নফছে আম্মারা’, ‘নফছে মুলহিমা’ ও ‘নফছে লওয়ামা’—আত্মশুদ্ধির এসব বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে ‘নফছে মুতমাইন্নার’ স্তরে উপনীত করেন। মুতমাইন্নার স্তরে উপনীত হওয়ার পর সাধকের কালব শান্তিপ্রাপ্ত হয় এবং ‘কালবে সলিম’ লাভ হয়। ‘কালবে সলিম’ পয়দা করাই মনুষ্য জীবনের লক্ষ্য। এ সম্বন্ধে কোরআন মজিদে উল্লেখ রয়েছে : ‘ইয়াওমা লা ইয়ান-ফাউ মালু ওয়াল বানুন, ইল্লা মান আতাল্লাহা বিকালবিন সলিম।’ [অর্থাৎ, বিচারের দিন একমাত্র কালবে সলিম ছাড়া ধন-দৌলত, ছেলে-মেয়ে কোনোটি কাজে আসবে না।] (সূরা শোয়ারা, ৮৮-৮৯)। ‘কালবে সলিম’ হলে সাধক এ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। যথা : ‘রাদি আল্লাহু আনহুমওয়া রাদু আনহু।’ [অর্থাৎ, আল্লাহ তাঁদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তারাও সর্ব ব্যাপারে আল্লাহর মর্জিতে সন্তুষ্টচিত্তে রাজি হন।] (সূরা বাইয়েনাত-৮)।
প্রকৃত সুফিগণের লক্ষ্য সাধকের কালব। তারা একমাত্র আল্লাহর ওয়াস্তে সাধকের কালব থেকে নানা উপায়ে দুনিয়ার প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ ও মহব্বতকে ক্রমশ কমিয়ে আখেরাতের প্রতি আকর্ষণ ও আল্লাহর প্রতি মহব্বত পয়দা করান। মওলানা রুমী (রহ.) তার বিখ্যাত মসনবীতে ফরমাইয়াছেন—‘রাও তু জাঙ্গার আজ রুখে উ পাক কুন, বাদ আজাঁ নূর রা এদরাক কুন।’ [অর্থাৎ, কালবের জাঙ্গারা (ময়লা) প্রথমে পরিষ্কার কর, তারপর আল্লাহর নূরের সঙ্গে তোমার পরিচয় কর।] ‘তাজকিয়ায়ে নফছ’ অর্থাৎ মানবের মধ্যে যে ধ্বংসকারী দোষ (যথা— লোভ, হিংসা, অহংকার, ক্রোধ, মিথ্যা বলা ইত্যাদি) রয়েছে এগুলোর এছলাহের সঙ্গে সঙ্গে এবং আল্লাহর জিকির, ফিকির, মুরাকেবা, মুশাহেদা ইত্যাদি বিষয়ের অনুশীলনের মাধ্যমে কালবের জাঙ্গারা সাফ হয়ে ‘তাছফিয়ায়ে কালব’ অর্থাৎ কালব সাফ হয়। কালব জাঙ্গারা দোষমুক্ত হলে, রুহের ওপর আল্লাহর নূরের তজল্লি হয় এবং আল্লাহর সঙ্গে সাধকের সম্পর্ক দৃঢ় ও মজবুত হয়। এ সম্পর্কে কোনো এক সুফি সাধক বলেছেন : ‘যদি তোমার দিলকে আয়নার মতো পরিষ্কার করতে চাও, তবে দেল থেকে লোভ, ক্রোধ, কৃপণতা, হারাম, লোকনিন্দা, মিথ্যা, হিংসা, অহংকার, লোক দেখানো কাজ এবং অন্যের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে তার অনিষ্ট চিন্তা করা—এ ১০টি জিনিস বের করে দাও।’
রসুলে আকরাম (সা.)-এর প্রদর্শিত পথে অন্য ধর্মের সাদৃশ্যের মতো চললে সে কখনো মঞ্জিলে মকছুদে অর্থাৎ গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারবে না। ‘মান তাসাব্বাহা বেকওমিন ফাহুয়া মিনহুম’ (আল হাদিস)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি অন্য ধর্মের সাদৃশ্যে চলাফেরা করে, সে সেই ধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত। আধ্যাত্মিক সাধনার শেষস্তর ‘ফানা বাকা’। পবিত্র কোরআন শরিফে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কুলু মান আলাইয়া ফানিন ওয়াবকা ওয়াজহু রাব্বিকা জিল জালালি ওয়াল একরাম’ অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল, একমাত্র আল্লাহর মহিমা ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা ছাড়া। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় একজন মুসলিম সাধক ‘ফানার’ প্রক্রিয়ায় দুজনই দাবিদার হলো, দুজন নিজ নিজ অস্তিত্বে ফিরে আসল, মুসলিম সাধকের রুমাল সুগন্ধি ছিল, অমুসলিম সাধকের রুমাল দুর্গন্ধ হয়ে গেল। এতে প্রতীয়মান হয়, অন্য ধর্মেও আধ্যাত্মিক সাধনা আছে। অধিকন্তু কোরআন-হাদিসের নিয়ম-বহির্ভূত সাধনা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।