মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচন এবং কিছু কথা

বাহালুল মজনুন চুন্নূ


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট নির্বাচন এবং কিছু কথা

জ্ঞানার্জনের তীর্থভূমি, মুক্তচিন্তার পাদপীঠ, গণতন্ত্রের সূতিকাগার এবং অফুরন্ত আলোর ঝরনাধারায় উৎসারিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত সেই বিরলতম বিশ্ববিদ্যালয়, যা ‘সত্যের জয় সুনিশ্চিত’ (ট্রুথ শ্যাল প্রিভেইল) এই লক্ষ্য সামনে রেখে একটি জাতির জন্মে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছিলেন নেতৃত্বের অগ্রভাগে। এখান থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা দেশে। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, বাংলাদেশ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিশ্বের বুকে যে মহাকাব্য রচিত হয়েছিল, সেই ইতিহাস বিনির্মাণের গর্বিত অংশীদার এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও সুসংগঠিত করার জন্য, চিন্তার স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে আরও শানিত করার লক্ষ্যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন তিয়াত্তরের বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স। এতে আছে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ভার দেওয়া হয়েছিল সিনেট ও সিন্ডিকেটকে। গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটকে মিনি পার্লামেন্ট বলা হয়। ১০৫ জনের সিনেটে ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট থাকেন, যারা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এরা বিশ্ববিদ্যালয়কে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

ড. অমলেন্দু বসু তাঁর ‘স্মৃতির ধূসর সরণি’ বইটিতে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নিরন্তর অগ্রসরমান, এখানে ব্যক্তিত্বের সংযত বিকাশের অমূল্য সুযোগ, এখানে জ্ঞান পথিক যুবজনচিত্ত ক্রমেই এগিয়ে যায়, তার জীবনের মন্ত্র, উপনিষদের ভাষায় “চরৈবেতি” এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো...’। এ কারণেই সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি এখান থেকে জ্ঞানের আলো নিয়ে নিজে আলোকিত হয়েছেন, দেশ ও দেশের মানুষকে আলোকিত করেছেন হাজারো মনীষী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, কূটনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিল্পপতিসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মশালবাহী কেউ না কেউ। এ দেশের অধিকাংশ রথী-মহারথী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একেকটি আলোকচ্ছটা। এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, বুদ্ধদেব বসু, মুনীর চৌধুরী, স্যার এ এফ রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ড. মকসুদুল আলমসহ অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। সত্যেন বোস, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শ্রীনিবাস কৃষ্ণান, কাজী মোতাহার হোসেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক, সরদার ফজলুল করিম, আনিসুজ্জামানের মতো অগণিত কৃতী সন্তানের স্মৃতিধন্য এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। কর্মক্ষেত্রে সদা ব্যস্ত থাকলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আছে তাদের অগাধ ভালোবাসা। এ যেন জন্ম-জন্মান্তরের বাঁধন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো এই ক্যাম্পাসের আলো-হাওয়ায় কাটান বলেই হয়তো এই অনুভূতি সাবেক শিক্ষার্থীরা সর্বদা বয়ে বেড়ান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করেন, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা আনন্দিত হন; হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে অনুভব করার মতো করেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। আবার এই বিশ্ববিদ্যালয় যদি কোথাও ব্যর্থ হয়, কোথাও কোনো অঘটন ঘটে কিংবা বদনাম হয়; তবে সাবেক শিক্ষার্থীদের হৃদয় মুষড়ে পড়ে। বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী সাবেক শিক্ষার্থীরা যখন দেখেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাচ্ছে, নানান ষড়যন্ত্রের জট পাকাচ্ছে— তখন তারা ব্যথিত হন; রুখে দাঁড়ান সব অপশক্তির বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়কে যেন কোনো অপশক্তি আঁকড়ে ধরতে না পারে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীরা যেন কোনো ষড়যন্ত্র না করতে পারে এবং বিশ্ববিদ্যালয় যেন অনির্বাণ জ্ঞানের শিখা জ্বালাতে পারে নির্বিঘ্নে তা নিশ্চিত করতে সিনেটকে প্লাটফরম হিসেবে বেছে নেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদকে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে, জামায়াত ও তাদের দোসরদের অপকর্ম ও ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করার মহান দায়িত্ব বর্তায় এই পরিষদের ওপর; যা তারা দীর্ঘদিন ধরেই সফলভাবে পালন করে আসছে।

স্বাধীনতার পরবর্তী সাড়ে তিন বছর এই বিদ্যাঙ্গন ছিল নির্ঝঞ্ঝাটময়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ঢাবি সিনেটেই এই জঘন্যতম হত্যার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব করা হয়েছিল। পঁচাত্তরের পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কলুষতা বৃদ্ধি পায় দুই স্বৈরশাসকের শ্যেনচক্ষুর কারণে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কলুষিত করার নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি বিএনপি-জামায়াত জোট মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি ও অপশাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছে। এ ক্ষেত্রে তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নিয়ে সেখানে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। তারা চেয়েছিল পাকিস্তানি ধারা ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি সেই চেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বলতে হয় গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদের কথা। এখনো অপশক্তিরা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থির করার ষড়যন্ত্রে মত্ত আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদ তাদের সব অপচেষ্টা নস্যাৎ করে চলেছে। শিক্ষাসহায়ক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তাই এখন আর হলে হলে দ্বন্দ্ব-মারামারির খবর পত্রিকার পাতায় খুঁজে পাওয়া যায় না। গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদ সাবেক শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার প্রতি সদা সজাগ। তাই নির্বাচিত হয়ে এই পরিষদের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে গেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট হ্রাস, গবেষণা খাতে বাজেটের পরিমাণ বৃদ্ধি, তরুণদের উদ্ভাবনী চিন্তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে গঠিত ‘ইনোভেশন অ্যান্ড ইনকিউবেশন ল্যাব’, বিজয় ’৭১ হল, সুফিয়া কামাল হল, বঙ্গবন্ধু টাওয়ার, মুনীর চৌধুরী টাওয়ার, শেখ রাসেল টাওয়ার, ‘৭ই মার্চ ভবন’ নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের এগিয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার, পাকিস্তানের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সম্পর্ক ছিন্নকরণ, জঙ্গিবাদ অঙ্কুরে বিনষ্টকরণ, শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশে স্থিতিশীলতাসহ সার্বিক উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার নির্দেশ ও তত্ত্বাবধানে জ্ঞান ও বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের মহান ব্রত নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। সেই এগিয়ে যাওয়া মসৃণ করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

আবারও শুরু হয়েছে রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েট নির্বাচন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০ জানুয়ারি শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তিনটি কেন্দ্রে (টিএসসি, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র ও সিনেট ভবন) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে ভোট দিয়ে রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটরা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে আরও দৃঢ় করে তুলবেন। ভোটের দিন ভোট কেন্দ্র হয়ে উঠবে তাদের মিলনমেলা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তাদের পদচারণে মুখরিত হয়ে উঠবে। তারা স্মৃতির ভেলায় ফিরে যাবেন পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে। মেতে উঠবেন আনন্দে-উচ্ছ্বাসে। তাই এই নির্বাচন ঘিরে রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটদের মধ্যে বিরাজ করছে ব্যাপক উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা। নির্বাচনের ব্যাপারে বলতে হয়, মূলত লড়াই হবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির মধ্যে। আসন্ন সিনেট নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সমাজের সর্বস্তরের ত্যাগী ও পরীক্ষিত রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল মনোনীত করেছে বঙ্গবন্ধুকন্যার হাত শক্তিশালী করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও গৌরবান্বিত করে তুলতে। প্রাজ্ঞ-রেজিস্টার্ড গ্রাজুয়েটরা তাদের আবারও নির্বাচিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগিয়ে যাওয়ার গতি ত্বরান্বিত করবেন— এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : যুগ্ম-আহ্বায়ক, গণতান্ত্রিক ঐক্য পরিষদ; সিন্ডিকেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

 

সর্বশেষ খবর