বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমেরিকায় ধর্মীয় স্বাধীনতা দিবস

তসলিমা নাসরিন

আমেরিকায় ধর্মীয় স্বাধীনতা দিবস

জানুয়ারির ১৬ তারিখে আমেরিকায় পালন করা হয় ধর্মীয় স্বাধীনতা দিবস। ১৬ জানুয়ারি, ১৭৮৬ সালে ভার্জিনিয়া রাজ্যের সংসদ আমেরিকার জাতির জনক টমাস জেফারসন রচিত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ থেকে গ্রহণ করেছিল ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রস্তাব। তাই ১৬ জানুয়ারিকেই আজকাল ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হোয়াইট হাউস থেকেও এই দিবসকে স্বাগত জানানো হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও এ নিয়ে টুইট করেছেন। ধর্মীয় স্বাধীনতা মানে শুধু খ্রিস্টধর্ম পালন করার স্বাধীনতা নয়। অন্যান্য ধর্ম গোষ্ঠীর, যত ক্ষুদ্রই হোক সে গোষ্ঠী, নিশ্চিন্তে নিরাপদে ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা। মূল খ্রিস্টধর্ম থেকে বেরিয়ে মানুষ অন্তত পনেরো রকম খ্রিস্টধর্ম বানিয়েছে। তাছাড়াও আমেরিকায় আছে নানান ধর্ম। ইসলাম, ইহুদি, বৌদ্ধ, হিন্দু, জৈন, শিখ, তাও, বাহাই, রাস্তাফারিয়ানিজম। সকলের ধর্ম পালন করার সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই এই দিবস। এই দিবসকে আধুনিক করতে হলে, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা দিবস’ না বলে বলা উচিত ‘বিশ্বাসের স্বাধীনতা দিবস’। মানুষ কি শুধু ধর্মেই বিশ্বাস করে, প্রচুর মানুষ সংশয়বাদে আর নাস্তিকতায় বিশ্বাসী। তাদের বিশ্বাস চর্চা করারও অধিকার চাই, শুধু অধিকার নয়, সমান অধিকার। একজন ধর্ম-বিশ্বাসীর যতটুকু অধিকার, একজন ধর্ম-অবিশ্বাসীর অধিকার ততটুকুই হওয়া উচিত। বিশ্বাসের স্বাধীনতা শুধু আমেরিকায় নয়, পৃথিবীর সর্বত্র এই স্বাধীনতা থাকা উচিত মানুষের। এটিই সভ্য হওয়ার প্রথম শর্ত।

বাংলাদেশের সরকার সুন্নি ইসলামকে সবচেয়ে উঁচুতে বসিয়ে বাকি সব ধর্ম গোষ্ঠীর অধিকার অনেকটাই খর্ব করেছে। মাঝে মাঝেই সুন্নি মৌলবাদী গোষ্ঠী হামলা চালায় শিয়া, আহমদিয়া, কাদিয়ানি, বৌদ্ধ, হিন্দু, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ওপর। তাদের বাড়িঘর, উপাসনালয়, সহায় সম্পত্তির ক্ষতি করে দিব্যি বুক ফুলিয়ে চলে যায়। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ হয় সংশয়বাদে এবং নাস্তিকতায় বিশ্বাসীদের ওপর, বিশেষ করে যাঁরা ইসলামের সমালোচনা করেন। তাঁদের তো প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়। সবচেয়ে অস্বস্তিকর দৃশ্য, মানুষ চুপ। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে মনে হয় ভুলে যাচ্ছে মানুষ। শুধু আতংকে জবুথবু মানুষ, তা বলবো না, সুবিধেবাদ এবং স্বার্থপরতার কুলুপও মুখে। আমি কোনও ধর্মে বিশ্বাস করি না, কিন্তু ধার্মিকদের ধর্ম পালনের অধিকারের জন্য আমি লড়াই করি। বাংলাদেশে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করলে যেমন প্রতিবাদ করি, কোথাও গির্জা, গুরুদুয়ারা, সিনেগগ, মসজিদ ভাঙলেও একই রকম প্রতিবাদ করি। ধর্ম পালন করার অধিকার যেমন মানুষের আছে, ধর্ম পালন না করার অধিকারও তেমন আছে। তা না থাকলে গণতন্ত্র বৃথা, অচল। তা না থাকা মানে সমাজে মুক্তচিন্তার কোনও স্থান না থাকা, তা না থাকা মানে সামনে নয় পেছনের দিকে হাঁটা, হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার যুগে ফিরে যাওয়া। ধর্ম পালন না করা নিতান্তই ব্যক্তিস্বাধীনতার অংশ, প্রতিটি গণতন্ত্রই ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু তোমার গণতন্ত্র যদি সেই নিশ্চয়তা না দেয়, তবে তোমার গণতন্ত্রে ত্রুটি আছে।

ভিন্নমত সইতে পারো না অথচ বলো তুমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস কর। তুমি কি আসলে গণতন্ত্রে বিশ্বাস কর? না তুমি মোটেও তা কর না। তুমি বলো যে তুমি বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস কর। হ্যাঁ কর, তবে তা তোমার নিজের বাকস্বাধীনতায়। বাকস্বাধীনতায় তারাই সত্যিকার বিশ্বাস করে, যারা শুধু নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় নয়, অন্যের এমন কী ঘোর শত্রুর মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে।

লক্ষ্য করেছি, ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলো ধার্মিকদের সব রকমের অধিকার আর আহ্লাদ দিয়ে মাথায় তুলে রেখেছে। তাদের মন্দির মসজিদ ট্যাক্স ফ্রি। ধর্মের নামে বড় অংকের চাঁদা তুলছে, ধর্ম ভাঙিয়ে মোটা মোটা দক্ষিণা পাচ্ছে। ধর্ম পালনের নামে মানুষকে ভোগাচ্ছে। জনগণের চলাচলের অসুবিধে করে রাস্তার ওপর মাহফিল করছে, নদীর জল নোংরা করে প্রতিমা বিসর্জন করছে, বাতাস দূষিত করে খোলা জায়গায় মরদেহ পোড়াচ্ছে। ভারতের পার্সিরা তো ছাদের ওপর রেখে দেয় মৃতদেহ যেন শকুনে খেয়ে নেয় সে দেহ। আজকাল শকুন অত নেই, মৃতদেহ পচে দুর্গন্ধ করে পরিবেশ। বাতাস দূষণ তো আছেই, শব্দ দূষণও হামেশাই করে চলেছে ধার্মিকেরা। নিজের বিশ্বাসের বিজ্ঞাপন তারা অহরহই দিচ্ছে, কিন্তু আমি যুক্তি দেখিয়ে বিজ্ঞান বুঝিয়ে ধর্মের বিপক্ষে দু’কথা বললেই বা দু’কলম লিখলেই আমার মুণ্ডু কেটে নিয়ে যায় ধর্মান্ধরা। সমাজের এই অসম ব্যবস্থা কিছু নতুন নয়। এই ব্যবস্থাটা সরকারের তৈরি। কারণ সরকার শুধু আস্তিকদের পক্ষ নেয়, সরকারি প্রচারযন্ত্র শুধু আস্তিকদের প্রাধান্য দেয়। নাস্তিকদের তারা ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। নাস্তিকদের বঞ্চিত করে সাধারণ নাগরিক সুবিধেদি থেকেও। একসময় রোমানরা খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীদের কচুকাটা করতো। এর পর খ্রিস্টধর্মে মানুষকে জোর জবরদস্তি ধর্মান্তরিত করিয়ে খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসীরাই আবার কচুকাটা করেছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের। ইসলাম ধর্ম যখন নতুন ধর্ম ছিল, এটি প্রচারের সময় প্রচুর বাধা এসেছে, আবার এই ধর্মই পরে পেগানদের, ইহুদিদের, জরথুস্ট্রপন্থিদের, বাহাইদের, হিন্দুদের ধর্ম পালনে বাধা দিয়েছে।

ধার্মিকদের একে অপরকে ঘৃণা এবং পরস্পরের রক্তারক্তি লড়াই নতুন কিছু নয়। হিন্দু-মুসলমানের লড়াইয়ের কারণে ভারতের মতো বিশাল এক দেশ ভাগ হয়ে গেল। ভারত ভাগ হয়েছে সত্তর বছর হয়ে গেল, এখনো ধর্মের উচ্ছ্বাস কারও কিছু কম নয়। আমার নিজের কথাই বলি। বাংলাদেশে আমি ভুগেছি ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করে। ফতোয়া জারি হয়েছে, মৃত্যুদণ্ডের হুমকি এসেছে, দেশান্তরি হতে হয়েছে। যে হিন্দু ধর্মকে উদার বলে জানতাম, ভারতে আজকাল সেই হিন্দু ধর্মের সমালোচনা করলে অকথ্য ভাষার গালি শুনতে হয়। আমিই পারিনি, কিন্তু চারদিকে মুখ বন্ধ রাখার অদ্ভুত সংস্কৃতি চালু হয়ে গেছে। কলকাতাকে প্রগতিশীল শহর বলার বাঙালির অভাব নেই। এই কলকাতাই মুখ বন্ধ করে আছে যখন এক লেখকের বাকস্বাধীনতাকে অসম্মান করা হয়, শহর থেকে মায় রাজ্য থেকেও লেখককে বের করে দেওয়া হয়।

ধর্মের অসহিষ্ণু দিকগুলোর সমালোচনা চিরকালই হয়েছে, হয়েছে বলেই আজ অনেক দেশই ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে আর আইন থেকে আলাদা করেছে। আলাদা করেছে বলেই দেশগুলো সভ্যতার পথে হাঁটতে পেরেছে। ধর্ম যদি শাসন করে দেশ, ধর্ম যদি সিদ্ধান্ত নেয় মানুষ কী খাবে কী পরবে কী বলবে কী লিখবে কী ভাববে কী করবে— তবে ব্যক্তির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে ধর্ম, তখন আর ব্যক্তির জন্য ধর্ম নয়, শুধু ধর্মের জন্যই ব্যক্তি। এভাবে চললে সমাজ যে তিমিরে থাকে, সেই তিমিরেই রয়ে যায়। ধর্মের অসহিষ্ণু দিকগুলো না বদলালে, হাজার হাজার বছর পুরনো ধর্মীয় আইন অনুসরণ করলে আমরা আধুনিক তো হবই না, সভ্যও হব না। সমাজের বদল চাইলে সমালোচনা এবং বিতর্কের প্রয়োজন প্রচণ্ড। একে অস্বীকার করা মানে সত্যকে অস্বীকার করা।

আমরা কিন্তু হাজার হাজার বছরের পুরনো কোনও কিছুই মানছি না, আমরা পোশাক বদলেছি, খাবার বদলেছি, সংস্কার বদলেছি, বাড়িঘর বদলেছি, যানবাহন বদলেছি, জীবনযাপনের প্রায় সবকিছুই বদলে ফেলেছি, শুধু ধর্মটাকেই পারিনি। বিজ্ঞানের সব সুবিধে ঢেলে ধর্মকে আরো বলশালী বানিয়েছি, আরো মারমুখো বানিয়েছি।

আমেরিকায় ধর্মীয় স্বাধীনতা দিবস পালন হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মুসলমানদের পছন্দ করেন না, কিন্তু আমেরিকার মুসলমানদের যে ধর্ম পালনের স্বাধীনতা আছে, তা নিশ্চয়ই মানবেন। না মানলেও বাধ্য হবেন মানতে। আমেরিকার সংবিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর অধিকার তাঁর নেই। এখানেই গণতন্ত্রের সারকথা, আমি তোমাকে পছন্দ না করতে পারি, কিন্তু তোমার ধর্ম পালনের অধিকার বা তোমার বিশ্বাসের চর্চাকে আমি মানি। আমি তোমার ভিন্নমতে একভাগও বিশ্বাস না করতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের অধিকারে আমি শতভাগ বিশ্বাস করি।

যতদিন আমরা গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র না মানবো, ততদিন পর্যন্ত জেনে বুঝে অজ্ঞতা আর অন্ধকারই আমাদের আসল ঠিকানা।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

 

 

সর্বশেষ খবর