শনিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

দরিদ্রতা অবলম্বন ও সাদাসিধা জীবন

মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেম, পেশ ইমাম : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘গরিব মুমিনরা ধনীদের ৫০০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)।

প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) মানবতার নবী। তিনি তাঁর জীবনকে আমাদের জন্য আদর্শস্বরূপ উপস্থাপন করেছেন। পার্থিব জিনিসের প্রতি অনাসক্তি, ধনসম্পদের ক্ষেত্রে নিজের তুলনায় অন্যকে প্রাধান্য দেওয়া, অভাবীদের মধ্যে সম্পদ বণ্টন করে দেওয়া, অল্পে তুষ্ট থাকা, সাদাসিধা জীবন যাপন করা তাঁর মহৎ গুণাবলির অন্যতম; যার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে তাঁর অমিয় বাণী ও জীবনধারায়। তিনি ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানদের মধ্যে যারা দরিদ্র তারা মুসলমান ধনীদের চেয়ে ৫০০ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে দরিদ্রাবস্থায় রাখো, দরিদ্রাবস্থায় আমার মৃত্যু দাও এবং দরিদ্রদের সঙ্গে আমার হাশর কর।’ (সুনানে তিরমিজি ও ইবনে মাজাহ)।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘আমি বেহেশতের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম তার অধিকাংশই গরিব লোক। আর দোজখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার অধিকাংশ অধিবাসীই মহিলা।’ (বুখারি, মুসলিম)। উসামাহ ইবনে জায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেন, ‘আমি জান্নাতের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম সেখানে অধিকাংশ গরিব লোক রয়েছে। আর ধনবানরা তখনো হিসাবের জন্য অবরুদ্ধ রয়েছে। অথচ দোজখিদের দোজখের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়ে গেছে।’ (বুখারি, মুসলিম)।

সাহাবি আরও বলেন, ‘সত্তরজন (আহলে সুফফাকে) এ অবস্থায় দেখেছি, তাদের কারও কাছে (গা ঢাকার) জন্য চাদর ছিল না, কারও কাছে লুঙ্গি ছিল এবং কারও কাছে চাদর (একসঙ্গে দুটি বস্ত্রই কারও কাছে ছিল না), তারা তা গর্দানে বেঁধে নিতেন। তারপর সেই বস্ত্র কারও পায়ের অর্ধগোছা পর্যন্ত হতো এবং কারও পায়ের গাঁট পর্যন্ত। সুতরাং তারা তা হাত দিয়ে জমা করে ধরে রাখতেন, যেন লজ্জাস্থান দেখা না যায়।’ (বুখারি)।

তিনি আরও বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা এবং কাফিরের জন্য জান্নাত।’ (মুসলিম, তিরমিজি)। আল্লাহর কাছে এ দুনিয়ার কোনো দাম নেই। এ ব্যাপারে সাহল ইবনে সাদ (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি আল্লাহর কাছে মাছির ডানার সমান দুনিয়া (মূল্য বা ওজন) থাকত, তাহলে তিনি কোনো কাফিরকে তাঁর (দুনিয়ার) এক ঢোক পানিও পান করাতেন না।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ)। আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন এক লোক মহানবী (সা.)-কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! আল্লাহর কসম! আমি নিঃসন্দেহে আপনাকে ভালোবাসি।’ তিনি বললেন, ‘তুমি যা বলছ, তা চিন্তা করে বল।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি নিঃসন্দেহে আপনাকে ভালোবাসি।’ এরূপ তিনি তিনবার বললেন। রসুল (সা.) বললেন, ‘যদি তুমি আমাকে ভালোবাসো, তাহলে দারিদ্র্যের জন্য বর্ম প্রস্তুত রাখো। কেননা, যে আমাকে ভালোবাসবে স্রোত তার শেষ প্রান্তের দিকে যাওয়ার চেয়েও বেশি দ্রতগতিতে দারিদ্র্য তার কাছে আগমন করবে।’ (তিরমিজি)। রসুল (সা.)-এর দোয়া আল্লাহতায়ালা কবুল করেছিলেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আল্লাহর শপথ! রসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের সময় তিনি কোনো দিনার বা দিরহাম রেখে যাননি। কোনো গোলাম বাঁদিও রেখে যাননি; বরং তিনি যে লৌহবর্মটি দিয়ে জিহাদ করতেন তাও ৩০ ‘কফিজ’ (এক প্রকার আরবি পরিমাপ) যবের বিনিময়ে বন্ধক রেখে যান। তাঁর পরিবারে এমন অনেক রাত কেটেছে, যখন তাঁরা রাতের খাবার গ্রহণের জন্য কিছুই পাননি।

অবস্থানগত দিক থেকে রসুল (সা.)-এর জীবন দুই ভাগে বিভক্ত। মক্কার জীবন ও মাদানি জীবন। মক্কার জীবনে রসুল (সা.) এতটাই অভাবগ্রস্ত ছিলেন যে, তাঁর পরিবারে অভাব-অনটন নিত্যদিনকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাসের পর মাস তাঁর ঘরে আগুন জ্বলত না। ক্ষুধার্ত অবস্থায় বহু বেলা গুজরান হতো। তিনি ঘরে যেমন অভাবগ্রস্ত ছিলেন, বাইরেও তেমন ছিলেন। দাওয়াতের উদ্দেশ্যে তিনি সফরে যেতেন। এমন এক সফরের কথা তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘আমি আর বিলাল সফরে বের হয়েছি, একাধারে তিন দিন চলে গেছে, আমাদের সঙ্গে কোনো খাবার ছিল না। বিলালের বোগলে লুকানো (পোঁটলা বাঁধা) যৎসামান্য খাবার ছাড়া, একটা প্রাণ বেঁচে থাকতে পারে এতটুকু খাবারও আমাদের কাছে ছিল না।’ এমন অভাবগ্রস্ত অবস্থায় রসুল (সা.)-কে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল আপনি চাইলে মক্কার পাহাড়কে সোনায় পরিণত করে দেওয়া হবে। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি তা চাই না বরং আমি চাই এই অভাব-অনটনের মধ্যেই থাকব। এক ওয়াক্ত খাবার খাব আর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব। আবার এক ওয়াক্ত উপবাস থাকব আর ধৈর্য ধারণ করব।’ মক্কার কুরাইশরা তাঁকে রাজত্ব প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি তা গ্রহণ না করে দরিদ্রতাকেই আপন করে নিয়েছিলেন। এতেই প্রমাণিত হয়, তিনি দরিদ্রতাকে কতটা পছন্দ করতেন।

মদিনার জিন্দেগিতে রসুল (সা.) মসজিদে নববীর পাশে তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য পৃথক কামরা বা রুম নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। মেহমানদের জন্য ছিল পৃথক একটি কামরা। প্রতিটি কামরার দেয়াল খেজুর গাছের শাখার মধ্যে কাদামাটি লাগিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল। ছাদও ছিল খেজুর পাতা দিয়ে তৈরি। প্রতিটি কামরায় ছিল একটি করে দরজা। বিছানার জন্য ছিল খেজুর পাতার চাটাই। ছিল খেজুর গাছের আঁশভর্তি চামড়ার একটি তাকিয়া বা বালিশ ও দেয়ালের সঙ্গে টানানো ছিল কয়েকটি পশুর চামড়া। তেলের অভাবে অনেক সময় সান্ধ্যবাতিও রসুল (সা.)-এর ঘরগুলোয় জ্বলত না। ভিন্ন কোনো পরিচারিকা না থাকায় ঘরের কাজ নবীপত্নীরা নিজেরাই আনজাম দিতেন। এই ছিল রসুলে আরাবির রাজমহলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা।

খুতবা লেখক : মুফতি ওসমান গনি সালেহী

 

সর্বশেষ খবর