শিরোনাম
রবিবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

গল্পের গরু এবং বেসামাল মমতা

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

গল্পের গরু এবং বেসামাল মমতা

গল্পের গরু অনেক সময়ই গাছে চড়ে থাকে। কিন্তু স্রেফ বুকনি বাজির বাণিজ্য যে কোনো গগনে চড়তে পারে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল সদ্যসমাপ্ত কলকাতার নিউটাউনে শুরু হওয়া ‘বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন’-এ। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতির বাণও যে কতটা বেলাগাম হতে পারে, তার এক নতুন নজির তৈরি হলো নজিরবিহীন জাঁকজমকপূর্ণ এই মহাসমারোহে দেশ-বিদেশ থেকে আসা শিল্পরত্নদের ভাষণে। আর এর সঙ্গে চমকপ্রদ ছিল মমতাবন্দনার বৃন্দগীত। সম্মেলনে বাংলাদেশ যোগ দেয়নি।

টানা দুই ঘণ্টার এ অনুষ্ঠানটির আদি অন্ত পুরোটাই ছিল ‘বকোয়াস’। এত কিছু বাগাড়ম্বর শেষে ইতিবাচক একটা সম্ভাবনার দিগন্ত হয়তো বঙ্গবাসী লোকজনের দিব্য চোখের দৃষ্টিগোচর হতো, যদি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা হিসেবে তার ভাষণে এমন কিছু নতুন ঘোষণা করতেন যার দ্বারা পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যের যাবতীয় শিল্পসম্ভাবনার পাষাণ আবার প্রাণ ফিরে পেত। সেই ঘোষণা হলো এতদিনকার ভুল নীতি বর্জন করে শিল্প অথবা বাণিজ্য যাই হোক না কেন, তার জন্য জমির আয়োজন করার দায়িত্ব এখন থেকে নেবে রাজ্য সরকারই। কিন্তু আরাবুল-খুদেদের মতো তৃণমূল নেতা-কর্মীদের জমির দালালির ব্যবসা রমরমাভাবে চলতে দেওয়ার স্বার্থে মমতা ব্যানার্জি যে শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের রাস্তায় না হাঁটার সিদ্ধান্তে এখনো সমানভাবে অনড় তা তিনি আরও একবার স্পষ্ট করে দিলেন আজও। তিনি রাজ্যে শিল্পগঙ্গা আবাহনের ভগীরথের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন বটে, কিন্তু সে গঙ্গা যে কোন জমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে সে কথা আজও তিনি ঘুণাক্ষরে উচ্চারণ করলেন না তার ২০ মিনিটের ভাষণে। অথচ অনেকেই আশা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র যখন তার ভাষণে বললেন, মুখ্যমন্ত্রী একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করতে চলেছেন তখন অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি হয়তো নতুন জমিনীতি নিয়েই কিছু বলবেন। বলা বাহুল্য, মমতা আজও জল ঢেলেছেন সবার সেই আশায়।

বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে যোগ দেওয়া শিল্পপতিদের একজনও এদিন নতুন করে এক পয়সা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেননি। তারা শুধু মমতাস্তুতি করেই দায় সেরেছেন। এ বলে আমায় দেখ, এ বলে আমায় এমনটাই ছিল মমতাবন্দনার ধারা। আম্বানি গোষ্ঠীর মুকেশ আম্বানি এ রাজ্যে একটিও উৎপাদনশিল্প তৈরি করেননি। তার সব কারখানা উত্তর আর পশ্চিম ভারতে। পশ্চিমবঙ্গে শুধু ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা পিটে গেছেন। সেই মুকেশ আম্বানির মতে, ওয়েস্ট বেঙ্গল এখন নাকি মমতার নেতৃত্বে ‘বেস্ট বেঙ্গল’ হয়েছে। রাজ্যগুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বৃদ্ধির হার নাকি চতুর্থ স্থানে এবং বছরে ১৫ শতাংশ হারে এই বৃদ্ধি ঘটছে যা কিনা গোটা দেশের বৃদ্ধির হারের চেয়ে অনেকটাই বেশি। মমতাকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বেঙ্গল মিনস বিজনেস’। মমতার নেতৃত্বে নাকি ধীরে চল নীতি বিদায় নিয়েছে। মুকেশ জানান, তিনি গত দুই বছরে পশ্চিমবঙ্গে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ফেলেছেন। কিন্তু কোথায়? নিজেই খোলাসা বলেন, মোবাইল ব্যবসায়। আগামী এক বছরে তিনি রাজ্যের সব গ্রামে জিও পরিসেবা পৌঁছে দিতে চান। শুধু তাই নয়, তিনি দুই বছরে ৫ হাজার কোটি টাকা এ রাজ্যে ব্যবসার বিনিয়োগেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

লন্ডন থেকে উড়ে আসা লক্ষ্মী মিত্তাল কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। তিনি ভেবে দেখছেন মাত্র। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি লন্ডনে বসেই খবর পেয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যের মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গ সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে। অন্য রাজ্যের অফিসাররা পশ্চিমবঙ্গে এসে নাকি শিখে যাচ্ছেন কীভাবে প্রশাসন চালাতে হয়। তিনি এ রাজ্যে শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি দূর করার জন্য কী করা যায় তা অবশ্যই ভেবে দেখবেন বলে জানিয়েছেন। জেএস ডাবলু স্টিলের কর্ণধার সজ্জন জিন্দাল শালবনীতে স্টিল ফ্যাক্টরি করবেন বলে জমি নিয়েছিলেন। কিন্তু বামফ্রন্ট আমল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত গত ১০ বছরে ইস্পাত শল্পের একটা ইটও গাঁথেননি। বরং সেই জমিতে ছোট একটা সিমেন্ট কারখানা করেছেন। তিনি নাকি এই কারখানা করেই অভিভূত হয়ে গেছেন। বুঝে নিয়েছেন, মমতা যা বলেন তাই করেন। সজ্জন জিন্দাল বিশ্বকাপ আয়োজনে পশ্চিমবঙ্গের কৃতিত্ব দেখে এতটাই মুগ্ধ যে তিনি ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে বিনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ঠিক একই ভাবে কোটাক মাহিন্দ্রা ব্যাংকের উদয় কোটাক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি এ রাজ্যের গ্রাহকদের জন্য শুধু মোবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চালু করবেন। তিন মিনিটেই নাকি সেই অ্যাকাউন্ট খোলা যাবে। তিনি দাবি করেন, এ রাজ্য থেকে তিনি যত না টাকা ডিপোজিট করেছেন তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ঋণ বা বিনিয়োগ হিসেবে খরচ করেছেন। যদিও ভবিষ্যতে এখানে কোনো বিনিয়োগ পরিকল্পনা আছে কিনা সে ব্যাপারে তিনি একবারের জন্যও মুখ খোলেননি। রাজ্য সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েঙ্কা যথারীতি মমতা ব্যানার্জিকে প্রশংসার পর্বতশিখরে তুলে দিয়ে জানিয়েছেন, তার নেতৃত্ব অন্তর্দৃষ্টি ইত্যাদি ইত্যাদির নাকি কোনো তুলনা নেই। এ রাজ্যে রাজনৈতিক স্থিরতা অতুলনীয় যা নাকি ১০ বছর আগে ছিল না। তার এ রাজ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ খুবই ফলপ্রদায়ী। আগামী দিনে তিনি দুর্গাপুরে কার্বন পার্ক, নতুন একটি হাসপাতাল, এফএমসিজি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে চান। তিনি বলেন, এ রাজ্যে শিল্পপতিদের নাকি সবচেয়ে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়। তার সুরে সুর মিলিয়েই হর্ষ নেউটিয়া বলেন, মুখ্যমন্ত্রী শিল্পপতিদের বহু মূল্যবান পরামর্শ দেন। শিল্পপতি সঞ্জয় বিয়ানি বলেছেন, তিনি তার নতুন ব্যবসায় রাজ্যের থেকেই ৯৫ শতাংশ কর্মী নিয়োগ করবেন এবং তার মধ্যে ৬৫ শতাংশই হবে দ্বাদশ শ্রেণি পাস শ্রমিক। এই প্রতিশ্রুতি কীভাবে পূরণ হবে তা কিন্তু তিনি বলেননি। থাইল্যান্ড থেকে আসা অলোক লোহিয়াও বলেছেন, তিনি এ রাজ্য সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো কথা শুনেছেন। যদিও রাজ্যে তিনি কতটা বিনিয়োগ করতে চান তা খোলাসা করে বলেননি। এরা ছাড়াও এদিন ভাষণ দেন শিল্পপতি স্বরাজ পোদ্দার, স্পাইস জেট কোম্পানির চেয়ারম্যান অজয় সিং, পোল্যান্ডের ডেপুটি মিনিস্টার ডেরেক বোগারস্কি ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্য দলের এক প্রতিনিধি।

একসঙ্গে ৫ হাজার লোক বসতে পারে রাজারহাটের এমন নতুন কনভেনশন সেন্টারে আজ সকালে শুরু হলো বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। এই সম্মেলনে সহযোগী দেশ হয়েছে আটটি রাষ্ট্র— পোল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, জাপান, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড ও গ্রেট ব্রিটেন। এ দেশগুলো থেকে শতিনেক বাণিজ্য প্রতিনিধি দল কলকাতায় এসেছে। এদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে অভিনব এই কনভেনশন সেন্টারের ভিতরেই। শিল্পপতিরা প্রত্যেকেই অবশ্য একবাক্যে বলেছেন, এই নতুন কনভেনশন সেন্টারটি বিশ্বমানের। এবারই প্রথম মিলনমেলা ছেড়ে এই নতুন কনভেনশন সেন্টারে বাণিজ্য সম্মেলনের আয়োজন করা হলো।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তার ভাষণে তেমন উজ্জ্বল ছিলেন না। বেশ কয়েকবার ইংরেজি বলতে গিয়ে বলে তিনি বাংলায় চলে গেছেন। একবার তো (সম্ভবত মুখ ফসকে) বলে ফেললেন, ‘আমি হ্যান্ড্রেট পারসেন্ট কমিউনাল’। হয়তো বলতে চেয়েছিরেন ‘সেক্যুলার’। যে মমতা ব্যানার্জি সচরাচর এ ধরনের অনুষ্ঠানে দীর্ঘ ভাষণ দেন, এদিন বললেন অত্যন্ত সংক্ষেপে। মমতা এদিন তার ভাষণে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ এনে কেন্দ্রীয় সরকারকে কটাক্ষ করেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি সমস্ত ধর্ম, জাতির মানুষকে ভালোবাসি। পশ্চিমবঙ্গ সবাইকে ভালোবাসে, সবাই পশ্চিমবঙ্গকে ভালোবাসে।’ মুখ্যমন্ত্রী এদিনও যথারীতি রাজ্যে শিল্প বিকাশের সমস্ত অন্তরায় ছাপিয়ে দিয়েছেন পূর্ববর্তী বাম সরকারের ওপর। তিনি বলেন, ৩৪ বছরের বাম শাসনের জন্যই নাকি রাজ্য এগোতে পারেনি। সেই সময় ৭-৮ লাখ শ্রম দিবস নষ্ট হয়েছিল, তার আমলে একটিও শ্রম দিবস নাকি নষ্ট হয়নি। মমতা দাবি করেন, তার আমলে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার সমস্ত রাজ্যের চেয়ে এগিয়ে। রাজ্যে ক্যাপিটাল এক্সপেনডিচারের হার নাকি ৭.৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি দাবি করেছেন, ইস্পাত ও ক্ষুদ্র শিল্পে রাজ্য এক নম্বরে রয়েছে। মমতার আরও দাবি, গত ছয় বছরে তিনি নাকি ৮১ লাখ বেকার যুবককে চাকরি দিয়েছেন। গ্রামীণ কর্মবিকাশের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ নাকি এক নম্বরে রয়েছে। রাজ্যের সাতকাহন গেয়ে মমতা বলেন, পশ্চিমবঙ্গ হচ্ছে পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সদর দরজা। তাই এখানে বিনিয়োগ করলে লাভ বই ক্ষতি নেই।

মমতা ব্যানার্জি যাই দাবি করে থাকুন না কেন, গত সাত বছরের রাজত্বে এ রাজ্যে বিনিয়োগ আসার হার বামফ্রন্ট আমলের ধারেকাছেও নয়। গত বছর বিশ্ববাণিজ্য সম্মেলনে ঘোষণা করা হয়েছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আসছে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল মাত্র ১৭ হাজার কোটি টাকার। এর মধ্যে প্রকৃত বিনিয়োগের আবহ তৈরি হয়েছে মাত্র ৬০০ কোটি টাকার। সিপিআই (এম)-এর রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্রর বক্তব্য, ২০১১ সালে মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় এসেই প্রতিশ্রুতির বন্যা ছড়িয়েছিলেন, কিন্তু হিসাব নিলে দেখা যাবে এখন পর্যন্ত গত সাত বছরে যেসব শিল্প এসেছে, তার বেশির ভাগেরই প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল বাম আমলে।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর