সোমবার, ২২ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

অস্তিত্বের সন্ধানে, শিকড়ের টানে

হানিফ সংকেত

অস্তিত্বের সন্ধানে, শিকড়ের টানে

শিকড় ছাড়া যেমন গাছ বাঁচে না, তেমন শিকড় না চিনলে বাঁচে না মানুষের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়। আমাদের এই দেশটি যেমন ছায়াসুনিবিড় তেমন পিতা-মাতা, ভাই-বোন, বন্ধুর মায়ায় ভরা। আর এই ছায়া-মায়াঘেরা মাটি থেকেই জন্ম নিয়েছে আমাদের সংস্কৃতি। বটবৃক্ষের শিকড়ের মতো আমাদের শিকড়ও যেন এই মাটিতেই বিস্তৃত থাকে। দীর্ঘদিন থেকেই আমরা ‘ইত্যাদি’কে স্টুডিওর চার দেয়াল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও দৃষ্টিনন্দন গৌরবময় স্থানগুলোয় গিয়ে ধারণ করছি ইত্যাদি। উদ্দেশ্য নিজেকে জানা, নিজের শিকড়ের অনুসন্ধান করা। যেহেতু কাল বয়ে চলে তাই আজ যাকে বলছি একাল কিছু দিন পর সেটাই হয়ে যাবে সেকাল। কাল যেমন বদলায় তেমন কালের সঙ্গে বদলায় অনেক রীতি-নীতি, বদলায় সংস্কৃতি-সম্প্রীতি, এমনকি স্মৃতিও হয়ে যায় বিস্মৃতি, পাশাপাশি চলে ইতিহাস বিকৃতি। অর্থাৎ এই সংস্কৃতির সুকৃতির মধ্যে অকৃতি-দুষ্কৃতি মিশিয়ে নিষ্কৃৎতি মিলেছে অনেকের। আবার নিষ্ঠা ও শিষ্টাচারের কারণে কারও কৃতি হয়েছে পথিকৃতের মতো। তেমনি একজন মানুষ হচ্ছেন ঠাকুরগাঁও জেলার মুহম্মদ শহীদউজ্জামান। যিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় সাড়ে তিন একর জায়গাজুড়ে গড়ে তুলেছেন এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের ব্যতিক্রমী জাদুঘর। নাম ‘লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘর’। জাদুঘর বলতে আমরা যা বুঝি এটি ঠিক তেমন নয়। কারণ জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘অস্তিত্বের সন্ধানে, শিকড়ের টানে’।

কবিগুরু তার ‘ঐকতান’ কবিতায় লিখেছেন—

‘চাষি ক্ষেতে চালাইছে হাল,

তাঁতি ব’সে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল—

বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার

তারি ’পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।’

শুধু আমাদের দেশই নয়, সমস্ত বিশ্বসংসার এসব শ্রমজীবী মানুষের কর্মের ওপর ভর করে চলছে। আমরা শহর-নগর-বন্দর যে যেখানেই বসবাস করি না কেন আমাদের রসদ জোগায় এই প্রান্তিক কর্মজীবী মানুষ। কিন্তু এসব মেহনতি মানুষের রক্ত, ঘামে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য সবসময়ই থাকে উপেক্ষিত। এই মানুষগুলোর সঙ্গে আমাদের কজনের, বিশেষ করে এই প্রজন্মের কজন মানুষের পরিচয় আছে? কজন চিনি আমাদের সেই নিজস্ব শিকড়? সেই শিকড়ের টানেই ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইত্যাদির টিম নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম ঠাকুরগাঁও জেলার পূর্ব আক্চা গ্রামে। যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে এই ব্যতিক্রমধর্মী জাদুঘর।

জাদুঘর প্রাঙ্গণে গিয়ে মনে হলো সত্যিই যেন আমরা এক ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়ে এসেছি। নানান প্রজাতির ফল ও ঔষধি গাছে ঘেরা বিশাল চত্বর। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে সুন্দর সাজানো বসার ঘর। বসার জন্য গাছের গুঁড়ি ও বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন চেয়ার-টেবিল। পাখির কলকাকলিতে মুখর এই জাদুঘরে এলে মনে অন্যরকম প্রশান্তি আনে। কথা প্রসঙ্গে জাদুঘরের উদ্যোক্তা, একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক, মুহম্মদ শহীদউজ্জামান জানালেন, ‘লোকায়ন কোনো আভিধানিক শব্দ নয়। লোকজ সংস্কৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা ও সংগ্রামে ব্যবহৃত বিচিত্র সব উপকরণভিত্তিক এই জাদুঘর লোকজ মানুষের জন্য। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘর।’

লোকায়ন জাদুঘরে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও গৌরব সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি মনে করেন, যাদের রক্ত, ঘামে আজকের এই সভ্যতা, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের শিকড় না জানলে প্রকৃত শিক্ষা অর্জন সম্ভব নয়। ‘অস্তিত্বের সন্ধানে, শিকড়ের টানে’ প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘরে রয়েছে চারটি স্বতন্ত্র গ্যালারি— ‘তৃণমূল লোকজ গ্যালারি’, ‘নদী গ্যালারি’, ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী গ্যালারি’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি’। শহীদউজ্জামান জানান, ‘লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘরের’ সংগৃহীত কোনো উপকরণই কেনা নয়, সংস্থার কর্মী ও বিভিন্ন ব্যক্তির দান করা উপকরণ দিয়েই সাজানো হয়েছে এই জাদুঘর।

প্রথমেই গেলাম তৃণমূল লোকজ গ্যালারিতে। অভিভূত হলাম। গ্যালারিটি সাজানো হয়েছে আমাদের প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের অর্থাৎ আমাদের মূল চালিকাশক্তি কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, লোকশিল্পীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকা, কর্ম, হাসি-কান্না-বিনোদনের নানান দুর্লভ উপকরণ দিয়ে; যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কৃষিজ উপকরণ থেকে শুরু করে চিকিৎসা, বাদ্যযন্ত্র, বিভিন্ন সময়ের মুদ্রা, অলঙ্কার, ধর্মীয়, গৃহস্থালি, খেলাধুলা, এমনকি দলিল ও প্রাচীন নথিপত্রের নমুনাও রয়েছে এখানে। যেমন— লাঙল-জোয়াল, গাঁইতি, ডুলি, জলা, খুন্তি, বিভিন্ন আকৃতির রেডিও, হামানদিস্তা, তাবিজ-কবজ, কাড়া-নাকাড়া, একতারা-দোতারা, আকড়াই। সুলতানি আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ের মুদ্রা, প্রচলিত কথায় আমরা যেটাকে ‘ফুটা পয়সা’ বলি তাও বিশেষভাবে রাখা হয়েছে এখানে। এই ট্যাব, মোবাইল আর আইপ্যাডের যুগে এখানে এলে শিশুরা দেখতে পায়, নাটাই, গুলতি, লাটিম, ঘুড়ি, মারবেল, ডাঙ্গুলি ইত্যাদি খেলার নানান সামগ্রী। এসব দেখলে এক নিমিষেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ছেলেবেলার নানান স্মৃতি। নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন অনেকেই। এ ছাড়া রয়েছে নানান আকৃতির টর্চলাইট, হ্যাজাকবাতি, হারিকেন। একসময় গ্রামে যাদের বাড়িতে বড় টর্চলাইট থাকত তাদেরই বলা হতো বিত্তশালী। দর্শনার্থীদের কাছে চমৎকারভাবে এ বিষয়গুলো তুলে ধরেন গাইড। গ্যালারির মাঝখানে চমৎকার একটি শোকেসে সাজানো রয়েছে নানান ধরনের দলিলপত্র, মানি অর্ডার ফরম, খাজনা আদায়ের রসিদ, মৌজা ম্যাপ। রয়েছে মাটির তৈরির সানকি, চাঙ্গর, হাঁড়ি-পাতিল, বাসন-কোসনসহ পিঠা বানানোর নানান উপকরণ। এ সময়ে শহরের বাড়িঘরে সেভাবে পিঠা তৈরি না হলেও বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে কিংবা বাজারে ভ্যানের ওপর পিঠা বানানোর পসরা সাজিয়ে বসেন অনেকেই। আমাদের এই ষড়ঋতুর দেশে এখন চলছে শীতকাল। এই শীত নিয়েও নানারকম বচন আছে। যেমন— ‘মাঘের শীতে বাঘ কাঁপে’। বিশ্ব উষ্ণায়নের এই যুগে মাঘ মাসে বাঘ আর কত দিন কাঁপবে তা যেমন জানি না তেমন আমরা যেভাবে শিকড় ভোলার খেলায় মেতেছি তাতে ‘শীতকালে গীত গায়-আতপ চাইলের পিডা খায়’ এই বচনই বা কত দিন থাকবে, তাও বলা মুশকিল।

লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘরের একটি ব্যতিক্রমী গ্যালারি হচ্ছে নদী গ্যালারি। পৃথিবীর আর কোথাও এ ধরনের গ্যালারি আছে কিনা আমার জানা নেই। বাংলাদেশ নদীমাতৃক। আমাদের জীবনের এক বৃহৎ অংশই নদ-নদীনির্ভর। যদিও বহু নদীর অস্তিত্বই এখন আর নেই। তবুও প্রায় ২০০ নদ-নদীর পানি সংরক্ষিত আছে এই নদী গ্যালারিতে। কাচ দিয়ে নির্মিত বিশেষ ধরনের পাত্রে এই পানি সংরক্ষণ করা হয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, রূপসা থেকে শুরু করে আরও অনেক নাম না জানা নদ-নদীর পানি। যারা কক্সবাজারে ধারণ করা ইত্যাদির ২৯ ডিসেম্বর প্রচারিত পর্বটি দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই দেখেছেন, নদ-নদীর পানি সংরক্ষণ করা কাচের পাত্রগুলো কত সুন্দরভাবে দর্শনার্থীদের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বোতলের গায়ে নদ-নদীর নাম এবং নদ-নদী সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সব তথ্যই রয়েছে। যেসব নদ-নদীর অস্তিত্ব এখন নেই অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হারিয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতেও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি হারিয়ে যাওয়া অনেক নদ-নদীর পানিও এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। শুধু নদ-নদীর পানিই নয়, রয়েছে বেশ কটি মহাসাগরের পানি। আরব সাগর, নীল সাগর থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরের পানি। রয়েছে সাতটি মহাসাগরের বালুও।

শুধু নদ-নদী বা সাগরের পানিই নয়, নদ-নদীভিত্তিক নানান তথ্য-উপাত্ত ও উপকরণ রয়েছে এখানে। অর্থাৎ বাংলাদেশের নদ-নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা এবং এ-সংক্রান্ত তথ্য, নদ-নদীভিত্তিক নানান উৎসব, নৌকা, নৌকাবাইচ, গান, বন্যা, জেগে ওঠা চর, মত্স্যসম্পদ, জলজ উদ্ভিদ, জেলে সম্প্রদায় সম্পর্কিত নানান তথ্য এবং রয়েছে মাছ ধরার প্রাচীন ও বর্তমান আমলের নানান উপকরণ। এই গ্যালারিতে এসে দর্শনার্থীরা পরিবেশসচেতনতার মাধ্যমে খাল-বিল, নদী-নালাকে রক্ষায়ও উদ্বুদ্ধ হবে।

এই জাদুঘরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্যালারি হচ্ছে সমতলে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী গ্যালারি। সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা ইত্যাদি নৃ-গোষ্ঠীর ব্যবহৃত কৃষি, বাসস্থান, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, শিকার, নৃত্য-গীত বাদ্যের নানান উপকরণ রয়েছে এই গ্যালারিতে। দৃষ্টিনন্দন এই গ্যালারিটি তৈরিও করেছেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কর্মীরা।

লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘরের একটি বিশেষ গ্যালারি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি। যেটি উদ্বোধন করা হয়েছে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের অর্জন সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য ও ইতিহাস-আলোকচিত্র, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ উপস্থাপন করা হয়েছে এই গ্যালারিতে। মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে সংরক্ষণ করা হচ্ছে দেশের সব স্বীকৃত বধ্যভূমির মাটি এবং সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন স্মারক। এখানেও বিশেষভাবে নির্মিত কাচের পাত্রে বধ্যভূমির মাটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস উপস্থাপন করাই এই গ্যালারির মূল লক্ষ্য।

এখানেই শেষ নয়, আমাদের ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যের সঙ্গে মিলিয়ে কৃষিভিত্তিক ছয়টি উৎসব পালন করা হয় এই জাদুঘরে। বর্ষায় বর্ষামঙ্গল উৎসব, শীতে পিঠা উৎসব, অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব, মঙ্গাকাল অর্থাৎ প্রতি বছর বাংলা কার্তিক মাসে মঙ্গার স্মৃতিভিত্তিক অনুষ্ঠান এবং বছর শেষে চৈত্রসংক্রান্তি অর্থাৎ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানও করা হয়।

এসব অনুষ্ঠানে আমাদের গ্রামীণ লোকজ গান, ধামের গান, ভাওয়াইয়া ও কবিগানের আসর বসে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এসে উপভোগ করেন এসব অনুষ্ঠান। প্রতি মাসের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এখানে বেড়াতে আসা বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন লোকায়নের উদ্যোক্তা শহীদউজ্জামান নিজেই। পাশাপাশি দেখানো হয় শিশুতোষ চলচ্চিত্র।

এ ধরনের জাদুঘর তৈরির কারণ জানতে চাইলে শহীদউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের যেহেতু মূল অস্তিত্বই হচ্ছে গ্রাম তাই গ্রামের সঙ্গে শহরের ব্যবধানটা দূর করা এবং আমাদের নবীন প্রজন্মকে অস্তিত্বের টানে এই শিকড়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠার চিন্তা মাথায় আসে। গ্রামের কাছে রয়েছে আমাদের অনেক ঋণ। আর গ্রামই হচ্ছে আমাদের শিকড়।’

জানতে চেয়েছিলাম, ‘এই জাদুঘরে কেমন সাড়া পাচ্ছেন অর্থাৎ শিকড়ের টানে কেমন দর্শনার্থী আসছেন?’

হেসে বললেন, ‘সবারই কমবেশি শিকড়ের টান আছে। সুতরাং তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারলে নিশ্চয়ই আসবে। আমার এই জাদুঘরে পর্যায়ক্রমে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে অনেক শিক্ষার্থীই নিয়মিত এখানে আসেন, ঘুরে ঘুরে দেখেন, পরিচিত হন আমাদের শিকড়ের সঙ্গে।’

শহীদউজ্জামানের আশা আজকের এই প্রজন্ম লোকায়নের এসব উদ্যোগের মাধ্যমে ‘অস্তিত্বের সন্ধানে, শিকড়ের টানে’ আরও গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হবে। তিনি তার এই উদ্যোগগুলোকে আরও বেশি সম্প্রসারিত করতে চান; যা আগামী দিনে এ দেশের চেতনাকে আরও বেশি ধারণ করবে।

কথায় আছে, ‘যার নেই অনুভব, তার সবই সম্ভব’। এসব সম্ভবের ব্যবসা শুধু পিয়াজ-রসুনে নয়, শিল্প-সংস্কৃতিতেও ঢুকে পড়েছে। যে কারণে শহীদউজ্জামানদের মতো নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাওয়া প্রচারবিমুখ মানুষদের মূল্যায়ন হয় না। যারা কাজ করেন নিজের দায়বোধ থেকে। যাদের দ্বারা ‘সব সম্ভব’ নয়।

আমাদের রয়েছে নিজস্ব শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি। আছে আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। অথচ আজকাল অনেকেই সংস্কৃতিচর্চাকে ফ্যাশনে রূপান্তরিত করে সংস্কৃতির প্রকৃতিকে বিকৃতির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। অথচ আকাশ সংস্কৃতির দাপটে অস্থির এই যুগে শহীদউজ্জামান কি নিষ্ঠার সঙ্গে ধরে রেখেছেন আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

তার সৃষ্টি অস্তিত্বের টানে, শিকড়ের সন্ধানে লোকায়ন জীবনবৈচিত্র্য জাদুঘর সত্যিই এক বিস্ময়কর সংগ্রহশালা। যেখানে গেলে হাজার বছরের জীববৈচিত্র্যের সন্ধান যেমন পাওয়া যায়, তেমন অন্তরে অনুভব করা যায় শিকড়ের টান। ঠাকুরগাঁওয়ের এক নিভৃত পল্লীতে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বিলাসবহুল বাগানবাড়ি বা রিসোর্ট তৈরি না করে শহীদউজ্জামান আমাদের লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখার যে জাদুঘর তৈরি করেছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই জাদুঘরের নতুন সংযোজন মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন বধ্যভূমির মাটি ও স্মারক দর্শনার্থীদের, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। আমরাও আশা করছি, দেশের নানান প্রান্ত থেকে অস্তিত্বের সন্ধানে, শিকড়ের টানে এখানে ছুটে আসবে নবীন প্রজন্ম। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক— দেশ ও দেশের মাটিকে ভালোবাসা। সবাই মিলে দেশের সমৃদ্ধির জন্য এগিয়ে আসা।

লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী।

সর্বশেষ খবর