বুধবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

আওয়ামী লীগের জন্য দুঃখ হয়, মায়া লাগে!

পীর হাবিবুর রহমান

আওয়ামী লীগের জন্য দুঃখ হয়, মায়া লাগে!

কয়েক দিন আগে উচ্চ আদালত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন সম্পন্ন করতে। ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন দাবি করে অসংখ্য কলাম লিখেছি। অসংখ্যবার টকশোয় কথা বলেছি। আমার এই আকুতির নেপথ্যে ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই। না আমি, না পরিবারের কেউ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে অংশগ্রহণ করব। তবু আমি ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত চাই তিনটি কারণে। ১. বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন আদর্শভিত্তিক ইতিহাসের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতির উত্তরাধিকারিত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার সুসংহত এবং তারুণ্যের শক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় সুসংহত করে গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনায় আলোর পথে ঠেলে দিতে পারে। দিতে পারে গণমুখী রাজনৈতিক চরিত্র। ২. জাতীয় রাজনীতি থেকে তৃণমূল গণসংগঠনগুলোয় রাজনৈতিক কর্মী তৈরির যে বন্ধ্যত্ব তৈরি হয়েছে তা কেবল ছাত্র সংসদ নির্বাচনের পথেই দূর হতে পারে। ৩. গভীর দেশপ্রেমে প্রজন্মকে নির্লোভ-নিরহংকারী চরিত্র নিয়ে মানবকল্যাণের রাজনীতিতে টেনে আনতে পারে। আমাদের গৌরবময় অতীত তাই বলে। জাতীয় জীবনে অনেক আনন্দের বিষয় যে, আমাদের স্বাধিকার-স্বাধীনতা সুমহান মুক্তিযুদ্ধে এবং প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির পথ ধরে এ দেশের ছাত্রসমাজ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। তারুণ্যের শক্তিকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সম্ভ্রম রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর কাজে লাগিয়েছে।

যে ছাত্ররাজনীতি আমাদের জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম ও সামরিক শাসনকবলিত বাংলাদেশে বীরত্বের মহিমায় মহিমান্বিত তার উত্তরাধিকার ফিরে পেতেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাই। এটা গভীর আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা ও পর্যবেক্ষণ থেকেই বলছি, আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবময় ইতিহাসের মাইলফলক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এ দেশের ছাত্রসমাজ ঘটিয়েছে। ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমেদ সেই অবিনাশী ঊনসত্তরের সৃষ্টি। ঊনসত্তর বললেই ফৌজি শাসক আইয়ুব খানের পতন, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসির মঞ্চ থেকে বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন, স্বাধিকার-স্বাধীনতার পথে সত্তরের গণরায়ে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ ও জাতির জনকের অবয়ব গোটা ক্যানভাসে চলে আসে।

আমাদের গৌরবময় ছাত্ররাজনীতি, আমাদের তারুণ্যের অগ্নিঝরা সোনালি সময় বাংলাদেশে সামরিক শাসনে কেটেছে গণতন্ত্রের লড়াইয়ে। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে এ-দেশীয় খুনিদের হাতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেনাশাসন-কবলিতই হয়নি, গণতন্ত্র হরণ করে স্বৈরশাসনে আস্ফাালনই দেখা যায়নি, জাতীয় জীবনে নেমেছিল অন্ধকার যুগ। জাতীয় জীবনের গোটা রাজনৈতিক শক্তির আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেকের জীবনে জেল-জুলুম, নির্যাতনের ভয়াবহতা নেমে এসেছে। কিন্তু নব্বইয়ের ডাকসু নেতৃত্বে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য যে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল সেখানে গণমানুষের অংশগ্রহণ জাতীয় রাজনৈতিক শক্তির সম্পৃক্ততাই ঘটায়নি, সেনাশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রকে মুক্ত করেছিল। আমাদের সেদিনের লালিত স্বপ্ন কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে সেই প্রশ্নে জাতীয় নেতৃবৃন্দ ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারেন। আমরা গণতন্ত্রের স্বাদ কতটা গ্রহণ করেছি সে নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হচ্ছে, পাকিস্তানি সেনাশাসকদের আমলে নিয়মিত ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে যুদ্ধবিধ্বস্ত, অভাব-অনটন পীড়িত, ভঙ্গুর সামাজিক অবস্থায়ও ছাত্রসমাজের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়নি। নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক জমানায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন আলোর মুখ দেখেছে। কিন্তু গভীর বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, গণতন্ত্রের নবযাত্রায় দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন আর আলোর মুখ দেখেনি। ছাত্রসমাজ আর গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পায়নি। ডাকসু নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতো হলেও তাদের নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফি দিতে হয়। ডাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত থাকলে জাতীয় রাজনীতি থেকে ছাত্ররাজনীতি স্রোতস্বিনী নদীর মতো কলকল ঢেউ তুলে ভরা যৌবন নিয়ে এগিয়ে যায়। চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, তদবিরবাণিজ্য, বিত্তবৈভবের লোভ-মোহ ছাত্ররাজনীতিকে গ্রাস করতে পারে না। ছাত্ররাজনীতি মেধা ও মননশীলতার, সৃজনশীলতার চিত্রপটে এঁকে দেয় নিজেদের গৌরবের ইতিহাস। শিক্ষাঙ্গনগুলোয় নিয়মিত ছাত্রদের সরব উপস্থিতিতে, সক্রিয় কর্মকাণ্ডে ও গণতান্ত্রিক চেতনায় তরুণ্যে উদ্দীপ্ত করে ক্যাম্পাস। ছাত্রসমাজের স্লোগান ওঠে চতুর্দিকে। হলে হলে সাবসিডি বাড়াতে হবে, বই-পুস্তক-কাগজের দাম কমাতে হবে, ছাত্রাবাসে খাবারের মান উন্নত করতে হবে। সেই সঙ্গে নবীনবরণ, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ক্যাম্পাসকেই মুখরিত করে না; ছাত্রছাত্রীদের মেধা বিকাশের সুযোগ ঘটায়।

সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে ২৭ বছর ধরে যখন যে দল ক্ষমতায় তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর হাতে শিক্ষাঙ্গনের একক ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে। এক পক্ষ শিক্ষাঙ্গনে থাকলে আরেক পক্ষ ক্যাম্পাসের বাইরে রাত কাটায়। অথচ শিক্ষাঙ্গনে পড়ালেখা ও বাসস্থানের অধিকার প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর ন্যায্য পাওনা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে দল ক্ষমতায় তাদের আজ্ঞাবহে পরিণত হয়। ছাত্রসমাজের প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ তারা নেয় না। বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন মাঝেমধ্যে ডাকসু নির্বাচনের দাবি তুলেছে। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো ছাত্র এ দাবিতে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু বোধহীন ও আবেগ-অনুভূতিহীন রাজনীতির মূল্যবোধের অবক্ষয়ে পতিত এই সমাজ তাদের প্রতিবাদের ভাষাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ছাত্ররাজনীতি ও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে উঠে আসা জাতীয় রাজনীতির নেতারাও এ নিয়ে কোনো অনুভূতি প্রকাশ করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন ছাত্র ২০১২ সালে মহামান্য হাই কোর্টে রিট মামলা করেন। পরে ডাকসু নির্বাচন চেয়ে সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, জিএস ডাক্তার মোস্তাক হোসেন ও একজন ছাত্র আবারও রিট মামলা করেন। তাদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্ট যে রায় দিয়েছে সে আলোকে সরকার, বিরোধী দল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে ডাকসুসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আন্তরিক এমনটি দৃশ্যমান হয়নি। আমাদের তারুণ্য বেলায় উচ্চ আদালত এমন একটি রায় দিলে মিছিলে মিছিলে ক্যাম্পাস উত্তাল হয়ে যেত। অধিকার আন্দোলনের দাবিতে ছাত্রসমাজ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে ঘোষণা আদায় করত। দেশের বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে এখন ক্যাম্পাসগুলো। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বয়সসীমা ২৯ বেঁধে দেওয়ায় এ সংগঠনটি এখনো নিয়মিত ছাত্রদের দ্বারাই পরিচালিত। যদিও কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে ছাত্রলীগের নিয়মিত সম্মেলন হয় না। অন্যদিকে আরেকটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল এখন ক্যাম্পাসছাড়া। আরেকদিকে তাদের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সম্মেলন এত বিলম্বে হয় যে, বা কখনোসখনো না হওয়ায় সমালোচকরা ছাত্রদলকে বাবাদের দল বলেন। অনেক জেলায় ১৫-২০ বছর ধরেও ছাত্রদলের নেতা রয়েছেন। অনেক জেলায় ছাত্রদল সভাপতি অছাত্রই নন, বিএনপির জেলা নেতৃত্বে উঠে এসেছেন। তবু সম্মেলনের আয়োজন নেই। এ যেন রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব নয়, ছাত্ররাজনীতিকে বন্ধ্যা করে দেওয়ার নজিরই নয়, দেশের তারুণ্যের শক্তিকে বোধহীন ও জাতীয়তাবাদী প্রতিবাদের শক্তির উৎসকে ভঙ্গুর করে দেওয়ার শামিল। উচ্চ আদালতের রায় মাথায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরর যেমন সব শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা ও পড়ালেখার পরিবেশ নিশ্চিত করে নির্বাচন আয়োজন করা উচিত তেমনি জয়-পরাজয় বড় নয়, এ চিন্তা মাথায় নিয়ে গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর রক্ষার স্বার্থে সব ছাত্র সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা সময়ের দাবি।

স্কুলজীবন থেকে এক কঠিন দুঃসময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছিল। জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলাম অগ্রজ পঁচাত্তর-পরবর্তী সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ও দুবারের সভাপতি মতিউর রহমান পীরের হাত ধরে। আত্মসমালোচনা ও আত্মসংযম-আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্নের বীজ বুকের ভিতর ইবাদতের মতো আমাদের নেতারা প্রবেশ করিয়েছিলেন। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার থেকে ছাত্রজীবন শেষে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হইনি। তবে বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুই আমার নেতা। মানুষই আমার দল। বঙ্গবন্ধুর উচ্চতায় কাউকে জায়গা দিতে পারি না। কিন্তু স্কুলজীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছাত্ররাজনীতিতে নিরন্তর পথ হাঁটলেও, জেল খাটলেও মনে করি না সময়কে নষ্ট করেছি। আদর্শিক ছাত্ররাজনীতির সেই ধারাবাহিকতায় আগে-পরে যারাই ছিলেন তাদের সবাই রাজনৈতিক জীবন বেছে নেননি। কিন্তু পেশাগত জীবনে ছাত্ররাজনীতির সেই তালিম যে কাজে লেগেছে তা গর্ব করে বলতেই পাারি। আদব-কায়দা, আশরাফ-আখলাক পরিবারের পাঠ, পুুঁথিগত বিদ্যা হয় শিক্ষাঙ্গনের আশ্রম তাহলে এ কথা বলতেই পারি ছাত্ররাজনীতির সময়টুকু ছিল সমাজ, দেশ, মানুষ, রাজনীতি ও তার ভাঙা-গড়ার গতি-প্রকৃতির নিরন্তর অন্বেষণের শিক্ষা। সাদাকে সাদা বলা, কালোকে কালো বলা, অন্যায়কে অন্যায় এবং প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা ছাত্ররাজনীতিই দিয়েছে। ছাত্ররাজনীতিতে এমন কাউকে নেতা মানিনি, যারা আমাদের আদর্শ ছিলেন না। এমন কাউকে নেতা মানিনি, যিনি অসৎ বা বিপথগামী ছিলেন। গর্ব করেই বলতে পারি, নেতারা আদর্শচ্যুত হননি। আমরাও হইনি। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি, তদবিরবাণিজ্য তারা শেখেননি, আমাদেরও শেখাননি। মেধার প্রতিযোগিতায়, সাংগঠনিক দক্ষতায় সৃজনশীলতার পথে আমাদের সুকুমার বৃত্তিকে লালন ও বিকশিত করতে সহায়তাই করেননি, জানা এবং বই পড়ার মধ্য দিয়ে জ্ঞানের গভীরে যাওয়ার এবং যে কোনো ঘটনার নির্মোহ বিশ্লেষণের শক্তি জুগিয়েছিলেন। সেই থেকে বিশ্বাস করেছি, বঙ্গবন্ধু মানেই আদর্শ। আদর্শ মানেই মুুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার— একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা ও তার আলোকিত একটি সুন্দর সমাজ। বঙ্গবন্ধু মানেই এই বিশ্বাসে অটল। রাজনীতি মানেই মানবসেবা, রাষ্ট্রের উন্নয়ন, মানুষের ভাগ্য বদল ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। ধর্ম-বর্ণের বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ। আজকের বাংলাদেশে একটি সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে বলেই সমাজের সর্বত্র তার ঢেউ পড়েছে। সব প্রতিষ্ঠান দিনে দিনে ভঙ্গুর ও প্রশ্নবিদ্ধ। এ উপমহাদেশে আওয়ামী লীগ নামের দলটি গৌরব ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে ৬৮ বছর অতিক্রম করেছে। দলের প্রতিষ্ঠাতাদের কেউ কেউ দল ছেড়েছেন। কেউ কেউ অকালে মারা গেছেন। কিন্তু বাঙালি জাতির ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধুই দলটিকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দিয়েছেন। ধনী-সামন্ত গোষ্ঠীর পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের আজ্ঞাবহ মুসলিম লীগের বিপরীতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুই অসীম সাহসিকতায়, সাংগঠনিক বিচক্ষণতায়, নেতৃত্বের দূরদর্শিতা দিয়ে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত বিজয় ঘটাননি, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তি পুঁজি করে স্বাধিকার-স্বাধীনতার পথে হাঁটা বাঙালির হূদয় খুঁড়ে বেদনার আগুন জ্বালিয়ে দ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছেন। গোটা জাতিকে আস্থা ও ভালোবাসায় তাঁর নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ ও বিশ্বস্ত করেছেন। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে এই স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর সারা জীবন কেটেছে জেলে। কখনো গিয়েছেন ফাঁসির মঞ্চে। জনগণের অধিকার নিয়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছেন। লোভ-মোহ ও কাপুরুষতা এই মহানায়ককে স্পর্শ করেনি। পরিবার-পরিজনসহ জনগণের জন্য জীবন দিয়েছেন। ভোগবিলাস কাকে বলে তাঁর রাজনৈতিক ধর্মে ঠাঁই পায়নি। এরিন মোরের পাইপ ছাড়া কোনো বিলাসিতা তাঁর ছিল না। ব্যক্তিত্বের উচ্চতায় অমিত সাহসে এক তেজস্বী বীর বাঙালি ছিলেন। হূদয় ও ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে সম্মোহন করতেন। আদর্শের চেয়ে কোনো শক্তিই তিনি ব্যবহার করেননি। একজন উদার গণতন্ত্রী হিসেবে ইতিহাস তাঁর ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করছে। তাঁর কাছে অর্থবিত্তের মোহ যেমন ছিল না, নিরাবরণ সাদামাটা বর্ণময় উজ্জ্বলতা ছিল। দলের জন্য অনুদানের টাকা ধানমন্ডির বাড়িতে প্রবেশ করাননি, কর্মী ও মানুষকে বিলিয়ে পাঞ্জাবির পকেট খালি করে বাড়িতে ফিরেছেন। তাঁর কাছে যত গরিবই হোন না কেন সৎ-আদর্শবান কর্মীর মূল্যায়ন ছিল সবার আগে। আজকের বাংলাদেশেই নয়, উপমহাদেশের রাজনীতির দিকে তাকালেও কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়— মহাকাব্যের যুগ অতীত হইয়া গিয়াছে। আজীবনের গণতন্ত্রের সংগ্রামের পোড় খাওয়া আওয়ামী লীগে হাজার হাজার নেতা-কর্মী রয়েছেন। যাদের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন নেই। হাজার হাজার নেতা-কর্মী রয়েছেন মানুষের অধিকারের জন্য, রাজনীতির জন্য, দলের জন্য যারা জীবনের ঝুঁকি নেননি বা জেল খাটেনি। লাখ লাখ নেতা-কর্মী রয়েছেন সব লোভ-মোহ পরিহার করে আদর্শের কর্মী হিসেবে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চান। সেই দলের দ্বিতীয় দফা চূড়ান্ত বিকাশ ও জনপ্রিয়তা ঘটেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কর্ণধাররাই ব্যর্থ হননি, সেদিন প্রতিরোধের ডাক দিতে আওয়ামী লীগের সব নেতাই ব্যর্থ হয়েছেন। সেনাশাসন-কবলিত বাংলাদেশে জেল-জুলুম সয়ে তবু নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর এই সংগঠনকে পুনর্জীবন দিয়েছিলেন। আর স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে সেদিন দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলের হালই ধরেননি, গণতন্ত্রের সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ৩৭ বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে দলকে তিনবার ক্ষমতায় এনেছেন। কখনো জেল খেটেছেন, কখনো অবরুদ্ধ হয়েছেন। চব্বিশবারের বেশি মৃত্যুর মুখে পতিত হয়েছেন। দলের লাখ লাখ নেতা-কর্মীর আশ্রয়ের ঠিকানা তিনি। কিন্তু আজকে যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ উন্নয়নের মহাসড়কে দেশকে তুলছেন, বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্বমোড়লদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসিতে চড়িয়েছেন, পদ্মা সেতু দৃশ্যমান করেছেন, তখন প্রশ্ন জাগে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন তাঁর অধীনে কেন সম্ভব নয়? প্রশ্ন জাগে তিনি যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন কী করে একটি লুটেরা গোষ্ঠী তৈরি হয়? শেয়ারবাজার থেকে ব্যাংকপাড়া লুটে নিয়ে যায় সমাজের কিছু চিহ্নিত মুখ। একই সঙ্গে দাপটে হেঁটে বেড়ায়? একই সঙ্গে প্রশ্ন জাগে কখনো হাওয়া ভবন, কখনো আওয়ামী শাসনের করুণাশ্রিত একদল মতলবাবাজ কী করে অগাধ বিত্তবৈভব গড়ে তোলে দলের পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়ে, এমনকি ভোটযুদ্ধে নৌকায় উঠতে চায়? কেমন করে মুজিবকন্যা যখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতিকে এক করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেন তখন আওয়ামী লীগে জামায়াত ঠাঁই পায়?  আওয়ামী লীগ হয়ে জন্ম নিয়ে কত কত নেতা-কর্মী পঁচাত্তর-পরবর্তী ২১ বছরের সংগ্রামে, বিএনপি-জামায়াত দুঃশাসনের যুগে, ১/১১-এর দল ও নেতৃত্বের প্রতি কমিটেড থেকে এত অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে রাজনীতি ও সমাজে আলোচিত হয়েও দলে, সরকারে, সংসদে জায়গা পায় না। অনেকে দল করতে পারে না। অনেকে আজীবন বাম রাজনীতি করে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে আওয়ামী লীগে নেতা হয়, এমপি হয়, মন্ত্রী হয়। অনেকে কোথা থেকে উড়ে এসে কর্তৃত্ব নিয়ে দল ও সরকারে আছে। কীভাবে? আর আজীবন দল করেও মূল্যায়ন হয় না কেন অনেকের? কীভাবে এ দলে জামায়াত-বিএনপি ঢুকে যায়? জানতে বড় ইচ্ছা করে। দল ও নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বস্ত। আবেগ-অনুভূতিসম্পন্ন আদর্শিক ক্লিন ইমেজের গণমুখী নেতা-কর্মীরা না পাচ্ছে পদ-পদবি, না মনোনয়ন। একসময়ের নষ্ট বামেরা জেঁকে বসেছে। এখন ঢুকছে ডানেরা। এতে আসল আওয়ামী লীগ, যাদের জন্ম এই দলে তারা যাবে কোথায়? আওয়ামী লীগের মতো দলে ত্যাগীরা নির্বাসিত হলে দুঃসময়ে সুসময়ের মতলববাজরা যখন সরে যাবে, তখন দলকে করুণ পরিণতি দেখতে হবে।

২০০৩ সালে অন্যান্য বড় দলের মতো আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির কলেবর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা মর্যাদার প্রশ্নে তা বাড়াননি। ওয়ার্কিং কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন আলোকিত নেতৃত্বকে সহসম্পাদক পদে ঠাঁই দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এটি আকস্মিকভাবে এতটাই বেড়ে যায় যে, তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, যার সঙ্গে ধাক্কা লাগে সেই বলে সহসম্পাদক! এলাকায় গিয়ে কর্তৃত্ব ফলায় কেন্দ্রীয় নেতা বলে। তিনি যথার্থই বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ওবায়দুল কাদের মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি দলের জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করছেন। সাংগঠনিক টিমওয়ার্ক গড়ে তুলছেন। মাঠের কোন্দল নিরসনে সবাই মিলে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। এমনি মুহূর্তে দলের উপকমিটি ঘোষণা ঘিরে নেতা-কর্মীদের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। ধানমন্ডির কার্যালয়ে গোলাপ ফুটলেও সুবাস ছড়ায়নি। জামায়াত-বিএনপির লোকজনই নয়, অনেকের ব্যক্তিগত পছন্দের কর্মচারীরাও ঠাঁই পেয়েছেন। ওবায়দুল কাদের সই করেননি। শেখ হাসিনা অবহিত ছিলেন না। কর্মীদের আশ্রয়ের জায়গা থেকে শেখ হাসিনার নির্দেশে ওবায়দুল কাদের তা স্থগিত করেছেন। তিন মাস পর সহসম্পাদক ছাড়াই উপকমিটি ঘোষিত হবে। দলের অনেকেই দলীয় পদবি পাননি। মন্ত্রী-এমপিও হননি। অথচ দক্ষতা, মেধা, সৃজনশীলতায় আওয়ামী লীগের অনেক নারী-পুরুষ এখানে ঠাঁই পাওয়ার দাবি রাখে। অর্থ উপকমিটিতে অনুপম সেনের আগে-পিছে অনেকের নাম ঠাঁই পেয়েছে। যাদের না আছে সমাজে নাম, না আছে দলে পরিচিতি। কেন এমন হলো তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আগামী দিনের কমিটি গঠন জরুরি। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সামনে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, জনগণের দেওয়া অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করে একটি আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা। সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা ও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী ও সুশাসন নিশ্চিত করায় আওয়ামী লীগের ভিতরে ও বাইরে থাকা এবং মাঠপর্যায়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকা শক্তিকে সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ করা। সেই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্বের সংকট দূর করতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা। বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার ছবি বিতর্কিতদের পাশে পোস্টারে যেমন ঠাঁই না দেওয়া, তেমনি নাটোরের অ্যাডভোকেট সাজিদুর রহমান খান থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পর্যন্ত চিহ্নিত করা হাইব্রিড কাউয়াদের সরিয়ে নিবেদিত কর্মীদের তুলে আনা। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কার কোথায় কী অবস্থা, কাকে কখন কোথায় কাজে লাগানো যায়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যেমন জানেন, ওবায়দুল কাদেরও তেমন তাদের চেনেন। সব মানুষের রাজনীতি করার অধিকার আছে। শিল্পপতি, সামরিক-বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের মনোনয়ন দেওয়া অন্যায় নয়। কিন্তু তাদেরই দিতে হবে যারা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবেন। আওয়ামী লীগের মতো দলে যখন বঙ্গবন্ধুকন্যাকে অন্ধকারে রেখে দলের সাধারণ সম্পাদককে অবহিত না করে নানাজন নানা পথে মতলববাজ, সুবিধাবাদী, হাইব্রিড এমনকি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে বিরোধী শিবিরের লোকদের নানা ফাঁকফোকরে প্রতিষ্ঠা করেন, তখন মুক্তিযুদ্ধের বাতিঘর খ্যাত আওয়ামী লীগের জন্য দুঃখ হয়, মায়া লাগে। চাটুকারদের দিয়ে, মতলববাজদের দিয়ে সর্বনাশ হয়, কল্যাণ আসে না। কী মানুষ, কী দলের। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে উঠে আসা শেখ হাসিনার চেয়ে এটি কেউ বেশি জানে না। বিএনপি জাতীয় রাজনীতিতে সারা দেশের ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত করেনি, সংসদে তুলে এনেছে। সেই তুলনায় আওয়ামী লীগ কেন পিছিয়ে— এ প্রশ্ন মনে বেশি জাগে! আর বড় প্রশ্ন, যে আওয়ামী লীগ এ দেশের ইতিহাস সৃষ্টি করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকারের জন্য সেই দল ও তার সংগ্রামী নেত্রী ক্ষমতায় থাকতে কীভাবে বিরোধীদের দমন-পীড়ন করা হয়? কীভাবে পার পায় শেয়ারবাজার-ব্যাংক লুটেরা, দুর্নীতির বরপুত্ররা? কেন ব্যাংকিং খাতে সংস্কার হয় না? ব্যক্তির হাতে চলে যায় ব্যাংকিং খাত?

 

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমনিউজবিডি.কম।

সর্বশেষ খবর