শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাগরিক শিক্ষার্থী একদিন যদি কৃষক হয়

শাইখ সিরাজ

বিশ্ববিদ্যালয়ের নাগরিক শিক্ষার্থী একদিন যদি কৃষক হয়

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ খাবার খায়, কিন্তু খাবারের উৎস সম্পর্কে খোঁজ রাখে কজন? সব মানুষ কি বলতে পারে কোন খাবার কোথা থেকে আসে? কীভাবে আসে? এসব খাবার উৎপাদনের পেছনে কত মানুষের কী কী ধরনের শ্রম ও সাধনা থাকে? কেউ কেউ এসব জানে। সিংহভাগ মানুষ জানে না। কিছুকাল আগেও পৃথিবী ছিল গ্রামনির্ভর। এখন পৃথিবীর বড় অংশ দখল করে নিয়েছে শহর। গোটা পৃথিবী নাগরিক সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম শহরকে ভালোবাসে। গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা কম। তারা কৃষি বোঝে না। ফসল ও খাদ্য বোঝে না। তারা বোঝে রেস্তোরাঁয় খাবার পাওয়া যায়। বাসার ফ্রিজে বা ডাইনিং টেবিলে খাবার থাকে। পুকুর বা জলাশয় নয়, মাছ পাওয়া যায় বাজারে বা ফ্রিজে। টাকা থাকলে চাইলেই খাবার মেলে। খিদে লেগেছে বললেই খাবার চলে আসে সামনে। আজকের দিনের অনেক শিশু-কিশোর-তরুণ এভাবে চিন্তা করে। আমাদের আগামী দিনের নাগরিকদের এ অজ্ঞতা ও উদাসীনতার জন্য আমাদের একটি দায় রয়েছে। আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও নগরমুখী চিন্তাধারাই এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

কৃষি ও কৃষকের নানান বিষয় নিয়ে প্রায় তিন যুগ হলো মাঠে মাঠে ঘুরছি। দেখছি, কালের বিবর্তনে গ্রাম থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে মানুষ। মেঠোপথ, সবুজ ধান খেত, অপূর্ব প্রাকৃতিক শোভা এখন আর তাদের আলোড়িত করে না। লোকেরা শহরের আলোঝলমল পরিবেশে মগ্ন হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। শহরের একেকজন মানুষ একেকটি যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও হয়ে উঠছে তাই। তারা ঘরে বসে টেলিভিশনে কার্টুন দেখে, কম্পিউটার বা মোবাইলে গেমস খেলেই বেশি মজা পায়। পাশাপাশি বসে গল্পগুজব করার চেয়ে মোবাইল স্ক্রিনে ফেসবুক নিয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। দিনে দিনে ছোট হয়ে যাচ্ছে তাদের পৃথিবী। জীবন হয়ে উঠছে যন্ত্রনির্ভর। এসব কথা চিন্তা করে মনে হলো আমি শুধু গ্রামের কৃষি নিয়ে পড়ে আছি। এদিকে আমাদের ভবিষ্যৎ দিনে দিনে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। কৃষিপ্রধান, নদীমাতৃক বাংলাদেশের আগামী প্রজন্ম যদি শিকড়ের কথা ভুলে যায় তাহলে আমাদের বড় রকমের ক্ষতি হয়ে যাবে।

এই ছোট্ট দেশটির প্রচুর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সবকিছুতেই আমাদের হতাশা। অথচ আমরা আজ বিশ্ব পরিসরেই নিজেদের অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করতে পারতাম শুধু এ কৃষিকে পুঁজি করেই। আমাদের দেশটি কৃষিনির্ভর। এখনো এ দেশের আশি ভাগই গ্রাম। এ দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। কৃষি থেকেই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জনটি নিশ্চিত করা সম্ভব।

আমরা ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে খাদ্যের হিসাব কষি, তার বহুদূরে থাকে উৎপাদক। খাদ্যশস্য ও মাটির সঙ্গে মিশে থাকে এই শ্রেণি। তারাই দেশের বৃহদাংশ। তাদের ন্যায্য মর্যাদা হওয়া উচিত নাগরিক জীবনের অনেক ওপরে। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে প্রায় ১২ কোটি মানুষ রয়েছে আমাদের শহুরে মানুষের হিসাবের বাইরে। ফসল ফলানোর প্রয়াস তাদের কাছে বেশির ভাগ সময়ই শাঁখের করাতের মতো। উপকরণ সংগ্রহ করতে গিয়ে একবার সে করাতে কাটা পড়ে, মাটির গর্ভ ফুঁড়ে ফসলের বেড়ে ওঠার জন্য যাদের জীবনকে উদয়াস্ত নিবেদন করতে হয় ফসলের মাঠে, তাদেরই আবার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার প্রশ্নে আরেকবার পিষ্ট হতে হয় অসম বাজারব্যবস্থার জাঁতাকলে। অথচ সমাজের এ বিশাল জনগোষ্ঠী ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব শূন্যের কাছাকাছি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের জীবনের ঘনিষ্ঠ জায়গাগুলোয় আমরা দাঁড় করাতে পারিনি নিজেদের। তাদের সঙ্গে সংলগ্ন করতে পারিনি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা ভাবী নেতৃত্বকে। এ বিশাল শূন্যতার কিছু অংশ পূরণের লক্ষ্যে কিংবা ব্যর্থতা ঘোচাতেই আমাদের নতুন প্রয়াস ‘ফিরে চল মাটির টানে’।

‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর পক্ষ থেকে ২০১০ সাল থেকে নতুন প্রজন্মকে গ্রামমুখী করার একটি কার্যক্রমে হাত দিই। আমার মনে হয়েছিল, শহরে জন্ম নেওয়া যেসব ছেলেমেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ছে তাদের একটিবারের জন্য গ্রামের কৃষি সম্পর্কে সামান্য ধারণা দিতে পারলেও তারা কৃষককে মূল্যায়ন করতে পারবে। এটা তাদের নিজেদের জীবনেও বড় একটি সাফল্য বয়ে আনবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে চিন্তা করলাম রাজধানীর ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদের কথা। তাদের জীবনের প্রায় কোনো কিছুতেই নেই মাটির স্পর্শ। হয়তো কোনো দিন খালি পায়ে হাঁটেওনি। ওরা জানেই না কৃষি কী জিনিস? জানার চেষ্টাও করে না খাদ্য কোথা থেকে আসে। এ বয়স পর্যন্ত যে খাবার সে খেয়েছে তা কীভাবে এসেছিল তাও মনে নেই তার। এদের একবার গ্রামে নিতে পারলে তা বেশ কাজে দেবে। বিশেষ করে  শিশুমনে গেঁথে যাবে গ্রাম। গ্রামের কৃষকের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও মমতা জন্মাবে। তারা সহজে বুঝে নেবে খাদ্যের মূল উৎস ফসল। ফসলের জন্ম ও বেড়ে ওঠার জায়গাটি মাটি। আর সেই মাটির বুকেই কৃষকের ফসল ফলানোর সংগ্রাম। ওরা বুঝবে মাটির মধ্যেই নিহিত হয়ে আছে জীবন।

এ চিন্তার আগের প্রেক্ষাপটটি একটু বলি। টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচারিত অনুষ্ঠান ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ ধারণের কাজে যখনই আমি নতুন প্রজন্মের কোনো শিক্ষার্থীকে সামনে পাই, তখনই তাদের আহ্বান জানাই গ্রামে যাওয়ার জন্য। ২০১০ সালের শেষ দিকের কথা। রাজধানীর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের এক অনুষ্ঠানে কৃষি ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ। আমি অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তব্যের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিই— তোমাদের মধ্যে কে আছো আমার সঙ্গে গ্রামে যাবে, কৃষকের মতো কাজ করবে? উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ তখন হাত তুলে সম্মতি জানায়। যারা হাত তুলল তাদের নানান প্রশ্ন করে একরকম বাজিয়ে নিলাম। তারপর তাদের ভিতর থেকে সবচেয়ে আগ্রহী ও গ্রামে যাদের তেমন যাওয়া-আসা নেই এমন চারজনকে নির্বাচন করলাম মাঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

শুরুটা এখানেই। তারপর প্রতি বছরই বোরো ও আমন মৌসুমে মাঠে নিয়ে যাই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন দুজন করে ছেলেমেয়ে। এই শিক্ষার্থীরা মাঠে যায়, অনেক বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয়, কৃষকের মতো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে, ভারী কাজ করে। হয়তো ওদের কষ্ট হয়। কিন্তু প্রশ্ন করে দেখেছি, এ কষ্টের ভিতর দিয়ে ওরা একটি বিশাল অর্জনের তৃপ্তি পায়। আনন্দিত হয়। কনকনে শীতে ঠাণ্ডা পানিতে নামলে কষ্ট হয় বটে, কিন্তু দেশের কাদামাটিতে খালি পায়ে এভাবে মিশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তো অনেক দামি। এ অভিজ্ঞতা অমূল্য। জীবনে একটিবারও এ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলে মাটির প্রতি তার একটি দায়বদ্ধতা জন্মাতে পারে। শরীরে মাটির সংযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এ সংযোগের ভিতর দিয়েই তো অনেক কিছু আসে। যাই হোক, এ পর্যন্ত যারা ফিরে চল মাটির টানে কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে তাদের অধিকাংশের মধ্যেই আমি কৃষি ও কৃষককে নিয়ে নতুন করে ভাববার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। এ কার্যক্রমে দ্বিতীয়বার অংশ নিয়েছিল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মেয়ে। নাম ক্যাথি বিপাশা সরকার। আমার খুব মনে আছে, ফিরে চল মাটির টানে কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পর তার বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিজ্ঞতা বিনিময় অনুষ্ঠানে সে জানিয়েছিল, বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন কৃষিপণ্যকে সে ব্র্যান্ডিং করতে চায়। তার এ চিন্তায় অভিভূত হয়েছিলাম। এখন দেশে জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের কাজ চলছে। আমাদের নিজস্ব পণ্যের কপিরাইট নিয়ে নানাভাবে আমরা চিন্তা করছি। ইতিমধ্যে আমাদের দেশের ইলিশ মাছ, শীতলপাটি বাঙালির নিজস্ব সম্পদ হিসেবে মেধাস্বত্ব লাভ করেছে। আরও অনেক পণ্যের এমন মেধাস্বত্ব অর্জনের কাজ চলছে। ফিরে চল মাটির টানে কার্যক্রমে অংশ নেওয়া ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিশাত পারভেজ নামের এক তরুণও নানাভাবে কৃষির বাণিজ্যিকায়ন নিয়ে ভেবেছিল। নর্থ সাউথের রাইসা আফ্রিদা নামের একটি মেয়ে ফিরে চল মাটির টানে কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুবাদে স্থানীয় একটি উন্নয়ন সংগঠনের সঙ্গে কৃষি উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়। এ অভিজ্ঞতা নিয়েই সে এখন কানাডার একটি টেলিভিশনে কাজ করার পাশাপাশি কৃষি ও গ্রামমুখী নানা বিষয় নিয়ে ভাবছে। এসব বিষয় নিয়ে একসময়ের অংশগ্রহণকারীরা যখন চিন্তা বিনিময় করে আমার খুব ভালো লাগে।

এখন চলছে ফিরে চল মাটির টানে কার্যক্রমের অষ্টম বর্ষ। এই তো সেদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের দুই শিক্ষার্থী অনীক ও শবনম এবং নর্দান ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের ফারজানা ও কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের তৌহিদকে নিয়ে গিয়েছিলাম মাঠে। শীতের গভীর রাতে ওদের ছেড়ে দিয়েছিলাম কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করে কাজ খুঁজে বের করার জন্য। ওরা সাফল্যের সঙ্গে এ কাজটি যেমন করেছে, একই ভাবে কৃষকের বাড়িতে অনেক কষ্ট স্বীকার করে রাতযাপন করেছে, পরদিন সকালে মাঠে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে হাত চালিয়ে কাজ করেছে। কাদাপানিতে নেমে বোরো ধানের চারা রোপণ করেছে।

দীর্ঘ সময় কৃষকের মতো সময় কাটানোর পর যে অর্জনের উচ্ছ্বাস ওদের চোখেমুখে দেখেছি তা সত্যিই বিস্ময়কর। ওরা একটি দিন কৃষকের সঙ্গে কাটিয়েই জীবনকে কিছুটা হলেও নতুন করে ভাবতে শিখেছে। গ্রামের কৃষকদের আপন করে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করেছে। আমি মনে করি, এ চার শিক্ষার্থীই সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর প্রতিনিধি। একজন শিক্ষার্থী যদি একটি দিন গ্রামে কৃষকের সঙ্গে কৃষকের মতো শ্রমঘন পরিবেশে কাটায়, তাহলে সত্যিই পাল্টে যেতে পারে তার মনোজগৎ।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

সর্বশেষ খবর