রবিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সবাই চালে চল্লিশ : রাজনীতিতে পলিটিক্স!

মোস্তফা কামাল

সবাই চালে চল্লিশ : রাজনীতিতে পলিটিক্স!

লড়াইয়ের বড়াই করতে গিয়ে আবার দৌড়ের ওপর বিএনপি। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমানউল্লাহ আমান, নাজিমউদ্দীন আলম, তরিকুল ইসলামের ছেলে অনিন্দ্যসহ দলের অনেক নেতা-কর্মী নতুন করে ধরপাকড়ের শিকার। অনেকে ঘরছাড়া। নির্দিষ্ট সীমানায় তারা গত কিছু দিন একেবারে খারাপ ছিলেন না। মন্দের ভালো হিসেবে অন্তত নিত্য মার খাওয়া কমেছে। দম-নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ হয়েছে।  ঘর-সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্যে সময় দেওয়ার অবস্থাও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গত ৩০ জানুয়ারি আপদ নামে নতুন করে। বেগম খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরার যাতায়াতের পথে কিছু নেতা-কর্মীর হঠাৎ বিপ্লবী হয়ে ওঠা, আটককৃত কর্মীদের প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার হিম্মত দেখাতে গিয়ে নেমে আসে নতুন করে পুরনো মসিবত। চাল দিতে গিয়ে তারা নিজেরাই চালে পড়ে গেছে বলে নানা তথ্য ও আলোচনা চলছে।

পুলিশের ওপর আক্রমণসহ বিএনপির সেদিনের ক্রিয়াকর্মে ছিল তাজা হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর আমেজ। কর্মীদের প্রিজন ভ্যান থেকে ছিনিয়ে আনার সময় সেলফিও তুলেছে সাহসীদের কেউ কেউ। প্রতিক্রিয়ায় দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর কণ্ঠ ছিল তেজোদ্দীপ্ত। তিনি বলেন, দেয়ালে পীঠ ঠেকে গেলে এমনই হয়। লড়াই ছাড়া পথ থাকে না। বিএনপি কর্মীরাও তাই বাধ্য হয়ে তাদের আন্দোলনের সহযাত্রীদের উদ্ধার করে এনেছে। একদিকে রিজভীর এমন বড়াই, অন্যদিকে পুলিশ নেমে পড়ে মামলাসহ ধরপাকড়ে। রাতেই গ্রেফতার করা হয় গয়েশ্বরকে। হানা দেওয়া হয় আরও অনেকের বাসাবাড়িতে। এবার চিত্র পাল্টে যায়। কথা বদলে যায়। লড়াইয়ের বড়াই একদম অস্বীকার। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এসব কাজ বিএনপির কেউ করেনি। এসব ঘটিয়েছে অনুপ্রবেশকারীরা।

শুরুতে বড়াই, পরে অস্বীকারে এমন চাল ও চাতুরি ক্ষমতাসীনরা আগের সপ্তায় করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্দোলনকারী নিরীহ বাম সংগঠনের ছাত্রছাত্রীদের রড দিয়ে পিটিয়ে সাইজ করেছে ছাত্রলীগ। কৃতিত্বের বড়াই করে বলেছে, তারা ভিসিকে উদ্ধার করেছে। এ অবদানে দল থেকে থ্যাংকস মিলেছে। প্রশংসাপত্র দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বলেছেন, ছাত্রলীগ না গেলে ভিসির প্রাণহানির শঙ্কা ছিল। সেই কথাও পাল্টে যায় একদিনের মাথায়। সারা দেশে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে নেতারা কথা ঘুরিয়ে ফেলেন। এ ক্ষেত্রে লাজ-শরমের কিছু নেই। কমতি নেই স্বর-সুরেও। তারা দাবি করতে থাকেন, ওই কাণ্ড আসলে ঘটিয়েছে ছাত্রদল ও শিবির। ছাত্রলীগ এমনি এমনিই সেখানে গিয়েছিল। হাওয়া বুঝে কথা বদলে ফেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরও। তিনি হাজির হন নতুন বক্তব্য নিয়ে। বলেন, ভিসিকে উদ্ধারের মতো কিছু সেদিন ঘটেনি। আর ছাত্রলীগও ভিসিকে উদ্ধার করেনি।

এটার নামই রাজনীতি। ব্যাকরণে নীতির রাজাকে রাজনীতি বললেই বা কী? রাজনীতির গুণে দিনকে রাত, রাতকে দিন করে দেওয়ার ম্যাজিক নির্বোধকেও রাজনীতিক হতে লোভী করা স্বাভাবিক। শুধু পজিশনে নয়। সাধ্যমতো কম যাচ্ছে না অপজিশনও। তবে, সমস্যা হচ্ছে—কমজুরি হওয়ায় তারা সেভাবে পেরে ওঠে না। এরপরও চেষ্টায় খ্যান্ত দেয় না। সরকার থেকে শিখে সরকারকেই কাবু করার শখ! পরিণতিতে আবার নিয়মিত মার। দৌড়ের ওপর জীবন। গ্রেফতার। ঘরবাড়ি ছাড়া। নাইটগার্ড দেখলেও র্যাব-পুলিশ মনে হয়।

মানুষের মধ্যে এ নিয়ে ভাবনার গরজ কম। দয়া-মায়া বা সহানুভূতিরও কিছু নেই এখানে। পলিটিক্স আর পলিটিশিয়ান থেকে সাবধান থাকা, তাদের কথায় বিশ্বাস না করার মানসিকতা অনেক দিনের হলেও গত বছর কয়েকে তা এখন ষোলোকলায়। সেই দৃষ্টে গোবেচারা শ্রেণির মানুষও হয়ে পড়ছে আরেক ধরনের পলিটিশিয়ান। যার যার গণ্ডিতে সবাই পলিটিশিয়ান। তাদের মধ্যে হাল বুঝে পাল, ভাও বুঝে রাও-এর চর্চা পথে-ঘাটে অহরহ। চাল বোঝেন সবাই। চাল দেন। চালে ফেলেন। কেউ কম, কেউ বেশি। ঘাপটিতে দক্ষতার পাশাপাশি মানুষ অস্থিরতার মধ্যে স্থির থাকতেও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আকাশে মেঘ জমুক, জমিন কাঁপুক, ধর্ষণের বর্ষণ হোক, নিত্যপণ্যের দাম আকাশে উঠুক। তাতেও গা না মাখা, না দেখা, না শোনার প্রবণতা জেঁকে বসেছে মানুষের মধ্যে। তাদের এ সাবধানী পজিশন নানা কারণেই। রাজা, উজির, রাজনীতির প্রতি অভক্তি-বিরক্তি লুকানোতে সফল মানুষের সংখ্যা অনেক। আবার নিজেও সুযোগ পেলে সেটা হওয়ার লোভও দুর্নিবার।

রাজনীতিকদের পলিটিশিয়ান বলতে কারও কারও বেশি পছন্দ। রসিকতাচ্ছলে অনেকে বলেনও রাজনীতির ভিতর পলিটিক্স ঢুকে গেছে। সঙ্গে ট্রিক্সও। এই টিক্স আর ট্রিক্সে চালাক-চতুর মানুষও জনগণের কাতারে থাকছে না। পাবলিক সেজে যেখান দিয়ে যা পারছে ঘটিয়ে দিচ্ছে। হাল পরিস্থিতি বুঝে সন্তানের জন্য প্রশ্নফাঁসের হাটের দিকে পাল তুলতেও খারাপ লাগে না। কারণ তারা জনগণ। তারাই পাবলিক। শেয়ানা হওয়ায় দেয়ালে কখনো তাদের পীঠ ঠেকে না। বরং দেয়াল দূরে ঠেলে দেওয়ার বুদ্ধি রাখে। কৌশল জানে। এ ছাড়া এক সময় শুধু গলা ধাক্কানো হতো বলে দেয়ালে পীঠ ঠেকত। এখন একজন গলা ধাক্কায়, একজন দেয়াল পেছনে সরায়। এতে দেয়ালের কী সাধ্য কারও পীঠে ঠেকার?

এর মধ্যেই মোটা চালের কেজি চল্লিশে রাখার খবর দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। একদিনের মাথায় অর্থমন্ত্রীও এতে জোর সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু গণমাধ্যমগুলোতে তেমন ট্রিটমেন্ট পায়নি খবরটি। তা ঢেকে গেছে আবদুল হামিদের আবার রাষ্ট্রপতি হওয়া, নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, খালেদা জিয়ার মামলার রায়, ৫৭-এর বদলে ৩২ ধারাসহ নানা ঘটনার তেজে। ৭০/৭১ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়া মানুষের কাছেও যেন এটি তেমন খবর নয়। খেতে খেতে তাদের এখন আর কত টাকায় কত খায় তা ভাবারও সময় নেই। বাজারে কোনো পণ্যের ঘাটতি-কমতি নেই। এরপরও আকালের মতো দাম বাড়ানোর কোনো বিহিত মানুষ এখন আর আশা করে না। শিরোধার্য আজাবের মতো তা ভুগতে আপত্তিও করছে না। এ নিয়ে তাদের কারও চটানো বা শহীদ-গাজীর পথে নেওয়ার দিন আপাতত শেষ। ন্যূনতম বোধজ্ঞানের মানুষও এখন আর এ পথে নামতে রাজি নয়। এ কাজে বাংলাদেশে যারা সবচেয়ে পারঙ্গম সেই বড় শক্তির একটি আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। আরেকটি জামায়াতে ইসলামীর থেকেও না থাকার অবস্থায়। এদিক থেকে সরকার একেবারে আনডিস্টার্বে। পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত। 

অন্যদিকে, সরকার কী চায়, কীভাবে চায়—তা জানে-বুঝে কমবুঝের মানুষও। সরকারের গৃহপালিত বিরোধী দল আর রাজপথের বিরোধী দল কী করবে, কদ্দুর পারবে সেটাও কম বোঝে না। এরপরও মাদ্রাসা মাঠে সাম্য-সমতায়ন হয়েছে দুই নেত্রীর। একই দিনে সিলেটের আলিয়া মাঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নৌকায় ভোটের ওয়াদা আদায়, ঢাকার আলিয়া মাঠে খালেদা জিয়ার মামলায় হাজিরার দিনে বিএনপির সাইজ হওয়ার মধ্য দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হাতে-কলমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ রকম ফিল্ডে খুচরা লড়াইয়ের বড়াইতে নেমে বিএনপি রেজিস্টার্ড অনাথের তালিকাভুক্তই হলো। রাজনীতির মাঠে এতিমকে ফুটপাথেও ঠাঁই দেয় না আরেক এতিমও। মধ্যাকর্ষণ শক্তিও এদের কোনো রহম করে না। যে কারণে কান্নার সুযোগ পেলেও তাদের চোখের পানি নিচে পড়ে না। সব পানি ভিতরে সংবরণ করতে হয়। আবার জেদ-দ্রোহের পানিও ফুটতে ফুটতে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। নইলে চতুর-শেয়ানা জনগণ মরা-আধমরা বামদের মার খাওয়ার দৃশ্যও এভাবে এনজয় করে কেন? তারা তো চাল, ডাল, তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিসহ জনসম্পৃক্ত ইস্যুতেই নিয়মিত মাঠে নামে। মোদ্দাকথা ধনে-জনে কমজুরিকে সামর্থ্যবান ভাবার জনগণ নেহাতই কম।  করুণাচ্ছলে তাদের কেউ কেউ বলে ফেলছেন, এরা শুধু রাজনীতি করে। পলিটিক্স বোঝে না। আর বিএনপি নেই রাজনীতিতেও।  বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কাছে রাজনীতিতে নাবালক আর পলিটিক্সে শিশু।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সর্বশেষ খবর