মানুষ বর্বর। মানুষ খুন করে। প্রকাশ্যে করে। পরোক্ষে করে। দিনের আলোয় করে। রাতের অন্ধকারে করে। বাস্তবে করে। কল্পনায় করে। আজ থেকে যদি খুনের জন্য শাস্তি উঠিয়ে দেওয়া হয়, তবে মুহূর্তে কটি করে খুন করবে মানুষ, ভাবলেও আঁতকে উঠি। এত সামান্য বিষয় নিয়ে খুনোখুনিতে মাততে পারে, পশুরা দেখেও নিশ্চয়ই অবাক হয়। পশুদের মধ্যে এমন খুনোখুনি নেই। মানুষ পাশবিকতা শব্দের একটা মন্দ, আর মানবিকতা শব্দের একটা ভালো অর্থ তৈরি করেছে। মানবিকতা শব্দের অর্থ কি লোভ, হিংসে, ঈর্ষা, বর্বরতা, স্বার্থপরতা হওয়া উচিত নয়?
দিল্লির রাস্তায় দিনের আলোয় জবাই করা হলো অঙ্কিত সাক্সেনা নামের এক ২৩ বছরের ফটোগ্রাফার যুবককে। অঙ্কিত সাক্সেনা ২০ বছর বয়সী মেয়ে শাহজাদির সঙ্গে প্রেম করত। ছেলেটি হিন্দু, মেয়েটি মুসলমান। কিন্তু মেয়ের পরিবার কিছুতেই মেনে নেবে না এক বিধর্মী ছেলের সঙ্গে তার মেয়ের প্রেম। মেয়েকে সাবধান করে দিয়েছিল তার পরিবার। অঙ্কিতের সঙ্গে যেন কোনও রকম যোগাযোগ না করে। কিন্তু তারপর যখন জানলো গোপনে তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, অঙ্কিতকে ডেকে পাঠালো শাহজাদির বাবা। তারপর কী হলো, শাহজাদির বাবা আর কাকা মিলে অঙ্কিতকে মারলো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষ দেখলো যে একটি মানুষকে মারা হচ্ছে। কেউ এগিয়ে এলো না অঙ্কিতকে বাঁচাতে। বাবা আর কাকা এরপর ছুরি বের করে, গরু যেমন জবাই করে, তেমন করে জবাই করলো তরতাজা ছেলেটিকে। শাহজাদি পালিয়েছে, কারণ হাতের কাছে পেলে শাহজাদিকেও একই রকম জবাই করবে কসাইগুলো। এগুলোর নাম আমরা দিয়েছি ‘অনার কিলিং’, সম্মানের জন্য হত্যা। হিন্দু মুসলমানে বিয়ে হলে পরিবারের সম্মান যাবে, তাই সম্মান রক্ষা করার জন্য হিন্দু মুসলমান জুটিকে হত্যা করতে হবে, হত্যা করলেই সম্মান বাঁচবে। খুনির সম্মান, এরা মনে করে, প্রেমিকের সম্মানের চেয়ে বড়। এই ঘটনায় মুসলমান হত্যা করল হিন্দুকে। হিন্দুও কিন্তু অবলীলায় হত্যা করে মুসলমানকে। সেদিনই তো শম্ভুলাল নামের এক রাজস্থানী হিন্দু লোক কুপিয়ে আর পুড়িয়ে হত্যা করল এক গরিব মুসলমান শ্রমিককে। শ্রমিক কোনও ‘লাভ জিহাদ’ করেনি। কিন্তু যেহেতু লাভ জিহাদ যারা করছে তারা মুসলমান, আর শ্রমিকটিও মুসলমান, তাই শ্রমিকটিকে দায় নিতে হতো লাভ জিহাদি মুসলমানদের। কট্টরপন্থিদের সাফ কথা, হিন্দু মুসলমানে কোনও বিয়ে হতে দেবো না। ছেলে মুসলমান হলে তো আরও সমস্যা। হিন্দু মেয়েকে বিয়ের সময় বা বিয়ের পর মুসলমান বানাবে। এরকম বিয়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘লাভ জিহাদ’। মুসলমান ছেলেরা নাকি মিশন নিয়েছে, হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে প্রেম ভালোবাসার অভিনয় করে তাদের পটিয়ে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত করাবে। বিয়ে নয়, আসল উদ্দেশ্য হিন্দুদের মুসলমান বানানো। মুসলমান ছেলে আর হিন্দু মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, কিন্তু সব কটি বিয়ে ভালোবাসার জিহাদ নয়। বেশির ভাগই নয়। তারপরও লাভ জিহাদের রটনাটি বাজারে চালু রয়েছে। হিন্দু আর মুসলমান ছেলেমেয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে, বাচ্চা কাচ্চা হয়েছে, সুখের সংসার করছে উভয়ে। যে যার ধর্ম পালন করে সংসার করছে, অথবা একজন আরেকজনের ধর্ম স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে পালন করার জন্য। এমনও হয় দুজন কোনও ধর্মই পালন করে না, কোনও ধর্মকেই হয়তো বিশ্বাসও করে না। এদের সংখ্যাটা বেশি হলেও এদের নিয়ে আজকাল আলোচনা হচ্ছে না।
অঙ্কিত সাক্সেনার হত্যাকাণ্ড হিন্দুদের, বিশেষ করে কট্টরপন্থি হিন্দুদের, খেপিয়ে তুলেছে। খুনিরা এখন জেলে। অঙ্কিতের বাবা খুনির ফাঁসির দাবি করেছেন। তবে তিনি এমন একটি বিবৃতি দিয়েছেন যা অভিনব। তিনি পুরো ভারতবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছেন, তার ছেলেকে মেরে ফেলা হয়েছে, এর দায় মুসলমান সমাজের নয়। সব মুসলমান মিলে এই কাণ্ডটি করেনি। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই, কেউ যেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা না করে, আর সাম্প্রদায়িক হিংসে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কেউ যেন তাঁকে ব্যবহার না করে।এ কথা তিনি মুসলমানদের ভয়ে বলেছেন নাকি মন থেকে বলেছেন জানি না, তবে ছেলের মৃতদেহ চোখের সামনে নিয়ে এমন উদার হওয়া তো নয়ই, উদারতার দু-একটা বাক্য উচ্চারণ করাও সোজা জিনিস নয়। ধরে নিতে পারি তিনি যা বলছেন, মন থেকেই বলছেন। কিছুতেই তিনি চান না তাঁর পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নিতে কোনও মুসলমানের গায়ে কোনও টোকা পড়ুক। অঙ্কিত সাক্সেনার বাবার মতো সব বাবা নয়। প্রতিশোধপরায়ণতা মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড। ঘৃণা মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে। শুধু কি ধর্মে ধর্মে ঘৃণা? ঘৃণা শ্রেণির মধ্যেও। জাতের মধ্যেও। গোত্রের মধ্যেও। ধনী আর গরিবের মধ্যে বিয়ে হওয়া, ছোট জাত আর নীচু জাতে বিয়ে হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজস্থান আর হরিয়ানায় এক গোত্রের নারী-পুরুষ পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইলে তাদের মেরে ফেলা হয়, নয় গ্রাম থেকে চিরকালের জন্য তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাদের আদেশ, বিয়ে করতে হলে করতে হবে ভিন্ন গোত্রে। ভিন্ন গোত্র কোথায় বাস করে? ভিন্ন গ্রামে। তাদের ভাষায়, এক গ্রামের সকলে এক গোত্রের, সুতরাং গ্রামের কোনও ছেলে মেয়ের মধ্যে প্রেম বিয়ে হতে পারবে না। কড়া আইন। এই আইন মেনেই সমাজ চলছে। আধুনিক তরুণ তরুণী যখন এই কড়া আইন মানতে চায় না, তখন হয় তারা খুন, অথবা তারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, অথবা গ্রাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
দুজন ব্যক্তি প্রেম করবে এবং বিয়ে করবে—এতে বাধা দেওয়ার অধিকার কারও নেই। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ কথা জানিয়ে দিয়েছে। এত সাধারণ একটি বিষয়, যেটা সবারই বোধগম্য হওয়া উচিত, সেটা সুপ্রিম কোর্টকে সভা ডেকে বলে দিতে হচ্ছে। মা-বাবা যতদিন না ছেলে মেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক বলে মনে না করবেন ততদিন এই সমস্যা রয়ে যাবে। যতদিন তাঁদের ঘৃণা শুধু তাদের মধ্যে না রাখবেন, মগজধোলাই করে সন্তানদের মধ্যে চালান করবেন, ততদিন সমস্যা রয়ে যাবে। বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে পরিবারের ধর্ম দ্বারা, বিদ্বেষ দ্বারা, কুসংস্কার দ্বারা সংক্রামিত। পরিবারের পছন্দ অপছন্দই তাদের পছন্দ অপছন্দ। সে কারণেই তারা পরিবারের পছন্দ করা মানুষটিকে নিজের সঙ্গী হিসেবে সহজে বরণ করে নিতে পারে। কিন্তু নিজস্ব রুচি গড়ে উঠলেই সমস্যা বাঁধে।
সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়মের বাইরে গিয়ে যারাই প্রেম করুক, যারাই একত্রে বাস করুক—বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সবসময়ই যেন তাদের স্বাগত জানায়। পুরনো নিয়ম ভাঙাই নতুন প্রজন্মের কাজ। যত বেশি বিয়ে হবে ভিন্ন ধর্মে, যত বেশি বিয়ে হবে ভিন্ন শ্রেণিতে, জাতে—তত জাতে জাতে শ্রেণিতে শ্রেণিতে ধর্মে ধর্মে ঘৃণা দূর হবে, তত বেশি বাসযোগ্য হবে সমাজ। সমাজকে ঘৃণামুক্ত করার দায়িত্ব সব বিবেকবান মানুষের।
সত্যিকার ভালোবাসা ধর্ম, জাত, শ্রেণি, গোত্র মানে না। সত্যিকার ভালোবাসার অভাব খুব আজকাল। মানুষ শুধু বিত্ত দেখে, প্রাচুর্য দেখে, নাম খ্যাতি দেখে, ডিগ্রি দেখে। এগুলোকেই ভালোবাসে। মানুষকে নয়। ব্যক্তি ক্রমশ ধূসর হচ্ছে। প্রকট হচ্ছে বাড়ি গাড়ি জুয়েলারি। প্রকট হচ্ছে পণপ্রথা। প্রকট হচ্ছে ধর্ম জাত।
এমন সময় কিছুরই তোয়াক্কা না করে কেউ যদি নির্ভেজাল ভালোবাসা উজাড় করে দেয়, তাদের হত্যা করে আমাদের সমাজ। হিন্দু মেয়ে প্রিয়াংকাকে বিয়ে করার জন্য কলকাতার রিজওয়ানকে হত্যা করেছিল অথবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছিল আমাদের হিন্দু-মুসলমানের-উঁচুজাত-নীচুজাতের-উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্তের সমাজ। দিল্লিতে করেছে অঙ্কিত সাক্সেনাকে হত্যা। শাহজাদি ভয় পাচ্ছে। সাহসী মেয়েটি ভয় পাচ্ছে। অসহিষ্ণুতা বারবার সহিষ্ণুতাকে আঘাত করছে, কাপুরুষতা বারবার সাহসিকতার গায়ে কুড়োলের কোপ বসাচ্ছে। রুখে ওঠার সময় তো এখনই।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।