শনিবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

ধর্ম, স্বাস্থ্য ও ক্যান্সার

মাওলানা মুহিবুল্লাহিল বাকী নদভী
পেশ ইমাম : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানুষের মানবতাবোধের বিকাশ, সুস্থ-সুন্দর ও সঠিক জীবন পরিচালনার সার্বিক নির্দেশনা ইসলাম দিয়েছে। সুস্থ-সবল থাকা সুন্দর জীবনযাপনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহানবী (সা.) সুস্থ-সবল থাকার বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেন, দুর্বল মুমিনের চেয়ে সুস্থ-সবল মুমিন অনেক উত্তম। কারণ সুস্থ-সবল না থাকলে সঠিকভাবে আল্লাহতায়ালার ইবাদতও করা যায় না। এজন্য পরিমিত জীবনযাপন করা আবশ্যক। ইসলাম পরিমিত জীবনযাপনের জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। পানাহার, চালচলন, আচরণ, নিদ্রা, জৈবিকতা নিয়ন্ত্রণসহ সব ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ও পরিমাণ মেনে চলার জন্য ইসলাম বিধিবদ্ধ নির্দেশ দিয়েছে। জীবনের সব ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেই ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামের এই নির্দেশনা মেনে চললে ক্যান্সারসহ অনেক জটিল ও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। খাবার ও জীবনযাপনের ধারার সঙ্গে ক্যান্সারের গভীর সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। যেমন ধূমপান বা মদপানের সঙ্গে ফুসফুস, মুখ ও কণ্ঠনালি এবং যকৃৎ বা লিভারের ক্যান্সারের যোগাযোগ রয়েছে। তেমনি পান, সুপারি, জর্দা, মাংস, অতিরিক্ত লবণ, চিনি ইত্যাদি খাবারের সঙ্গেও ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে। মহানবী (সা.) প্রথমত পরিমিত আহারের নির্দেশ দিয়েছেন এবং উদর পূর্তি করে খেতে নিষেধ করেছেন। পেটের এক তৃতীয়াংশ খাবার, এক অংশ পানি পান করে পূর্ণ করতে এবং এক অংশ খালি রেখে খাবার শেষ করতে বলেছেন। এভাবে পরিমিত আহার করলে ক্যান্সারের উপসর্গ তৈরি হওয়া থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে ক্যান্সারের জন্ম দেয় এমন খাবার ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম প্রথমত বিশুদ্ধ ও অনুমোদিত খাবার খাওয়ার জন্য সব মানুষকে নির্দেশ দিয়েছে। কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে : ‘হে মানবসব! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সূরা বাকারা : ১৬৮)। অন্যদিকে লিভার ক্যান্সারের অন্যতম কারণ মদপানকে ইসলাম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে : ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্যনির্ণায়ক শর সব ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (সূরা মায়েদা : ৯০)।

ধূমপান ফুসফুস ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া লিভার, প্যাংক্রিয়াস, পাকস্থলী, মূত্রনালি, কিডনি ও সারভাইক্যাল ক্যান্সারও ধূমপানের কারণ হতে পারে। মুখ ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্তদের শতকরা ৯০ ভাগই তামাক গ্রহণে অভ্যস্ত বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণভাবে যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাদের চারজনের একজন ফুসফুসের ক্যান্সারে ভোগে। একনাগাড়ে ৪০ বছর ধূমপান করলে স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা ৬০ ভাগ বেড়ে যায় এবং এ ধূমপানের পরিমাণ প্রতিদিন এক প্যাকেট বা তার বেশি হলে এই ঝুঁকি শতকরা ৮৩ ভাগ বৃদ্ধি পায়। তামাক ও ধূমপান ইসলামে নিষিদ্ধ। তামাক, জর্দা, গুল এগুলো মানুষের জন্য কোনো উপকারী খাবার নয়। বরং চরম ক্ষতিকারক ও জীবনবিনাশী উপকরণ; যা মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। এসব খাবার গ্রহণ করে নিজের জীবন ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমরা নিজদের ধ্বংসে নিপতিত করো না।’ (সূরা বাকারা : ১৯৫)। রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো স্থান ইসলামে নেই।’ (ইবন মাজাহ, ইমাম মালিক)। অপবত্রিতা, অপরিচ্ছন্নতা এবং অবাধ ও অশালীন জীবনাচরণ ক্যান্সারের উপসর্গ তৈরি করতে পারে। ইসলাম এসব নিষিদ্ধ করেছে। মলত্যাগের পর ভালোভাবে পরিচ্ছন্ন না হলে কোলন ক্যান্সার হতে পারে। এজন্য ইসলামে ঢিলা, কুলুখ/টিস্যু ও পানি ব্যবহার করে ভালোভাবে পরিচ্ছন্ন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এতে কোলন ক্যান্সার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ইসলাম পবিত্রতার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছে। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পবিত্রতা ইমানের অর্ধাংশ।’ (মিশকাত)। শারীরিক ও মানসিক পরিচ্ছন্নতা ইসলামী অনুশাসনের অন্যতম পালনীয় বিষয়। ইসলামী পরিচ্ছন্নতার অন্যতম বিষয় হচ্ছে সুন্নতে খতনা। খতনা না করানো হলে পুরুষের জননেন্দ্রিয়ে ক্যান্সার সৃষ্টি হয়। ইসলামের এই অনুশাসন মেনে চললে জননেন্দ্রিয়ের ক্যান্সার থেকে মুক্ত থাকা যায়। তাই বর্তমানে অন্য ধর্মাবলম্বী লোকেরাও এ রোগ থেকে বাঁচার জন্য খতনা করায়। অশালীন ও উগ্র পোশাক-আশাক ইসলামে নিষিদ্ধ। অশালীন পোশাক অবাধ ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে। শালীন পোশাক নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে সহায়ক এবং মানুষের মন-মগজে এর প্রভাব লক্ষণীয়। তাই ইসলাম শালীন পোশাক ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। ভেজাল খাদ্য, পেস্টি সাইডযুক্ত শাক-সবজি এবং খাদ্যদ্রব্যে মাত্রাতিরিক্ত প্রিজারভেটিভ ব্যবহারের কারণে বর্তমানে ক্যান্সারের প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল মেশানো, তরিতরকারি ও ফলমূলে কীটনাশকের ব্যবহার, অতিরিক্ত প্রিজারভেটিভ ব্যবহার মানুষের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যারা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে তারা আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে জীবন পরিচালনা করলে ক্যান্সারের মতো মরণঘাতী ব্যাধি থেকে অনেকাংশে আমরা বেঁচে থাকতে পারি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

খুতবা লেখক : ড. মো. আবু ছালেহ পাটোয়ারী। মুফাসসির, ইসলামিক ফাউন্ডেশন। প্রাক-খুতবা বয়ান করেন : ড. সৈয়দ এমদাদউদ্দিন, ইমাম ও খতিব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ।

সর্বশেষ খবর