মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সবাই এত অসহিষ্ণু কেন?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

সবাই এত অসহিষ্ণু কেন?

গতকাল দুপুরে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করে খাবার খেয়ে জীবনে প্রথম কেরানীগঞ্জ নতুন কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম হোসেনপুর, দেবিদ্বার, কুমিল্লার বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখালচন্দ্র নাহাকে দেখতে। রাখালচন্দ্র নাহার একটি মিথ্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড হয়েছিল। ১/১১-এর সময় তার দণ্ড কার্যকর করতে গেলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিলাম। সেনাসমর্থিত সরকারের যেখানে যা বলা, করা দরকার সেসব করে নাহার ফাঁসি যাবজ্জীবনে পরিবর্তন করা হয়। দণ্ড মওকুফের পর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। রাখালচন্দ্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে কদিন আগে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে চিকিৎসাধীন ছিল। খবরটা জেনে হাসপাতালে দেখতে যেতে কারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু কদিন আগে তাকে কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম তাকে দেখতে কেরানীগঞ্জের কারাগারে। কারা কর্তৃপক্ষ অসাধারণ সম্মান ও যত্ন নিয়েছেন এজন্য তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। মানুষের কি জীবন! একজন মুক্তিযোদ্ধা কারাগারেই শেষ হতে চলেছেন। কিন্তু কারও কোনো আকার-বিকার নেই। ’৭৩-এ আলোচনা হয়েছিল, খুব সম্ভবত গেজেটও হয়েছিল, যে কোনো মুক্তিযোদ্ধার একবার যে কোনো সাজা মওকুফ করা হবে। তাই অস্তাচলগামী শ্রীনাহাকে দেখে খুবই অস্বস্তিবোধ করছি। কবে কখন চলে যাবে জানি না, তাই আজ অথবা কাল মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ যেখানে যেখানে যা বলা বা করা প্রয়োজন, যথাযথভাবে তা করে তার মুক্তির আবেদন জানাব। যাতে নাহার মৃত্যু অন্ধকার কারাগারে না হয়ে মুক্ত আলোয় হয়।

মাঝেমধ্যে পাঠকের প্রশংসা শুনে কিছুটা দুর্বলও হই। যারা ভালো বলেন তারা হয়তো আন্তরিকভাবেই বলেন। কিন্তু পাঠকের সেই ভালোয় আমার আন্তরিক গভীরতা না থাকলে আস্তে আস্তে সেসব ভালো আর একসময় ভালো থাকবে না। শিক্ষকদের ভয়ে ছেলেবেলায় স্কুলে যেতাম না, পালিয়ে ওষুধ বিক্রেতাদের ক্যানভাস শুনতাম। লেখাপড়ায় তেমন মন ছিল না। কলেজে গিয়ে যদিও কিছুটা আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু সেও খুব একটা বেশি দিন নয়। ছাত্র রাজনীতি এবং মুক্তির দুর্নিবার আকর্ষণে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। স্বাধীনতার পরও চেষ্টা করেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি চার-পাঁচ দিন। জাহাঙ্গীরনগরেও একই রকম। খাতাপত্রে নাম আছে কিনা জানি না। ওসব ড. নুরুন্নবী ও কবি রফিক আজাদ বলতে পারবেন। কারণ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপার তারা দেখতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে এমন বিব্রত হয়েছি যা বলার মতো নয়। কত স্যার যে ‘স্যার’ বলেছেন, গুটিয়ে গেছি। জীবন স্বাভাবিক গতিতে চললে হয়তো পালের গোদাই থেকে যেতাম। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু আমায় যেমন পিতৃহারা এতিম নিঃসম্বল করেছে, তেমনি প্রবাসে বইয়ের ভিতর প্রবেশের একটা সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু তার পরও বলব, আমার কোনো বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা নেই। অন্তরাত্মা যখন যা বলে, যা দেখি, রাস্তাঘাটে যা শুনি তাই কলমের ডগায় তুলে ধরার চেষ্টা করি। সেটা করতে বিদ্যা-বুদ্ধির প্রয়োজন পড়ে না, প্রয়োজন পড়ে গভীর আন্তরিকতার। কিন্তু দিনে দিনে যে জটিল ঘূর্ণিপাকে পড়তে চলেছি অন্তরাত্মার ডাক শুনে তা যদি লিখতে না পারি। সত্যকে সত্য বলা সারা জীবনের স্বভাব। যা যেভাবে দেখি তা সেভাবে লিখতে বা বলতে যদি না পারি তাহলে কোথায় যাই? তাই খুবই অস্বস্তিতে আছি।

কদিন আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রিয় বোন জননেত্রী শেখ হাসিনা হজরত শাহজালাল, শাহ পরানের পুণ্যভূমি সিলেট সফরের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু করেছেন। তা তিনি করতেই পারেন, কিন্তু সরকারি খরচে নয়। তেমন করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা, তিনি সারা জীবন সরকারি প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের যে আশা করেছেন, তা মাটিচাপা পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরপরই বিরোধী দলনেতা বেগম খালেদা জিয়া গিয়েছিলেন। নেতা-কর্মীদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনসভা কেমন হলো, কত লোক হয়েছিল, ১০-১২ লাখ? এক কর্মী বলেছিল, ‘কী বলেন! মাঠ ভরে নাই। ও মাঠে তো আপনিও মিটিং করেছেন।’ আমি আঁতকে উঠেছিলাম, কী বলো! এরপর, পরপর ১০-১৫ জনকে একই কথা জিজ্ঞাসা করেছি। তাদের কথায় খুব একটা অমিল পাইনি। তবে অনেক গেট সাজানোর কথা শুনেছি। খালেদা জিয়া সম্পর্কে তাদের কথা, ‘হজরত শাহজালালের মাজার থেকে হজরত শাহপরানের মাজার পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বহু লোক হয়েছিল।’ বলেছিলাম, লোকজনকে কি জোর করে বা ভয়-টয় দেখিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল? উত্তর পেয়েছি, ‘না, তেমন নয়। স্বতঃস্ফূর্তই মনে হয়েছে। তা না হলে হাততালি দেবে কেন, নাচবে কেন?’ এই যদি অবস্থা হয় তাহলে তো অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। যাকে তাকে চোর-চোট্টা গালাগাল করলে হবে না।

পুরো সপ্তাহ সরকার আর বিএনপি এর বাইরে কোনো কথা ছিল না। দু-তিন মাস আগেও তারেক রহমানকে নিয়ে যেসব কথা হতো, ভোজবাজির মতো কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের মামলা নিয়ে সারা দেশ মাতোয়ারা। কোনো দুর্নীতির মামলা নিয়ে এর আগে কখনো এত আলোচনা হয়নি। ৩০ বছরের এরশাদের পুরনো মামলার খবর নেই, খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর এবং অন্যদের ১০ বছর সাজা দেওয়া হয়ে গেছে। মানুষের যে আস্থাহীনতা, সেখান থেকে কীভাবে যে মুক্তি পাব জগত্স্রষ্টা আল্লাহ রব্বুল আলামিন ছাড়া আর কেউ জানে না। আগে বিচার-আচার নিয়ে কথা বলতে সবাই চিন্তা করত, আদালত অবমাননার ভয় করত। এস কে সিনহাকে বিদায়ের পর কোর্ট-কাচারি এমনকি বিচারক নিয়ে কথা বলতেও এখন আর সরকারি বা বিরোধী দল কেউ তেমন চিন্তা করে না। খালেদা জিয়াকে যে মামলায় পাঁচ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে এমন মামলা হাজার হাজার হয়েছে, বর্তমানে অনেক আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ এটা একটা সাধারণ মামলা। কিন্তু পার্থক্য এই, খালেদা জিয়ার মামলার মতো আর কোনো মামলা কখনো রকেট গতি পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে না। ফৌজদারি মামলা ফৌজদারি মামলার মতো চললে কারও কিছু বলার ছিল না। সরকারের মধ্যে কেউ ষড়যন্ত্র করছে কিনা বলতে পারব না। তা না হলে বেগম জিয়ার ডিভিশন নিয়ে কথা উঠবে কেন? দণ্ডাদেশের সময়ই তো বিচারকের স্পষ্ট করা উচিত ছিল। জেলে তো আমরাও গেছি, কত আলানী-ফালানী-কুরানীকেও ডিভিশনে দেখেছি, তবে বেগম জিয়াকে নয় কেন? তা ছাড়া রাস্তাঘাটে আলোচনা— নির্জন কারাগারে না রেখে গৃহবন্দী রাখলে ভালো হতো। ফাঁসির আসামির মতো নির্জনে একা রাখা কারাবিধিসম্মতও নয়। সরকারকে বিষয়গুলো ভেবে দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি।

কথাটা ব্যক্তিগত পর্যায়ের মতো শোনাবে, তবু বলছি। মাননীয় আইনমন্ত্রীর বাবা জনাব সিরাজুল হক বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ছিলেন। কলকাতার বেকার হোস্টেলে একসঙ্গে থাকতেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্মের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম বাজারে গিয়ে কাপড়-চোপড় কিনে কলকাতা থেকে গোপালগঞ্জ বা টুঙ্গিপাড়ায় পাঠিয়েছিলেন। ’৬৮-৬৯ সাল থেকে সিরাজ ভাইকে চিনতাম। আমাদের সভা-সমাবেশে ডাকলে ছুটে যেতেন। সত্য কথা বলতে কখনো ভয় করতেন না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবনে সংসদ সদস্যদের যে সভা ডেকেছিলেন সেখানে তিনিই একমাত্র সাহসী পুরুষ যিনি মুখে মুখে খন্দকার মোশতাককে খুনি বলেছিলেন, ‘তুমি খুনি, তোমাকে প্রেসিডেন্ট বা রাষ্ট্রপতি মানি না। এমপিদের সভা ডাকার তোমার কোনো অধিকার নেই।’ আজ কথাটি ভাবতে হয়তো কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সেদিন বঙ্গভবনে ওভাবে বুকের পাটা দেখানো সহজ ছিল না। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর তিনি তার আইনজীবী হয়েছিলেন। যেজন্য আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। গুলশানে আমির হোসেন আমুর কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে মিটিংয়ে জনাব সিরাজুল হকের বহিষ্কার নিয়ে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আপত্তি তুলেছিলাম। সভানেত্রীরও মত ছিল না। কিন্তু তার পরও কীভাবে সিরাজুল হক বহিষ্কৃত হয়েছিলেন বুঝতে পারিনি। তখন না ভাবলেও পরে ভেবেছি, তবে কি আওয়ামী লীগ সভাপতির ওপরও কোনো সভাপতি আছে। যাই হোক, শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তাকে আওয়ামী লীগ প্রধান কৌঁসুলি নিয়োগ করেছিল। আমি আমার সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে বিশ্বাস করি, তিনি তার বন্ধুর সপরিবার হত্যার বিরুদ্ধে একজন আইনজীবী হিসেবে জীবনের শ্রেষ্ঠ ভূমিকা রেখে গেছেন। মামলা চলাকালে সিরাজুল হক মারা গেলে তার ছেলে মাননীয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মামলাটি দেখাশোনা ও পরিচালনা করেন। তারপর এখন তো তিনি একজন খুবই ক্ষমতাবান মন্ত্রী। তিনি সেদিন খালেদা জিয়ার দণ্ড সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা মন্ত্রিপর্যায়ের ব্যাখ্যা হয়নি, ওটা একজন উপসচিব পর্যায়ের হয়েছে। মন্ত্রীর ব্যাখ্যা আরও সাবলীল সুন্দর হওয়ার কথা। নিম্ন আদালতে পাঁচ বছর জেল, জামিন পাবেন কিনা, নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন কিনা এসব কোনো ব্যাখ্যা নয়। ব্রিটিশ ভারতে এ আইন তৈরির পর যত মামলা হয়েছে সব দণ্ডপ্রাপ্ত আপিল করে জামিন পেয়েছেন, অনেকের মামলা খারিজ হয়ে দণ্ড বাতিল হয়েছে। তবে হ্যাঁ, নিরীহ কেউ আপিল করেনি, করার সংগতি ছিল না, তাই হয়তো কেউ সাজা খেটেছে।

কে শোনে কার কথা। সবকিছুতে অতিরিক্ত কৌতূহল অথবা অতিকথনে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি। ৫৭ ধারাকে এখন ৩২-এ আনা হয়েছে। এও সেই ঘাড়ের নামই গর্দান। কেউ কেউ বলছেন, এমপি-মন্ত্রী-নেতাদের সম্মান রক্ষা করার জন্য ৩২ ধারা। মাননীয় আইনমন্ত্রী সেদিন বলেছেন, অনুসন্ধানী কোনো রিপোর্ট করতে যাওয়া সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যদি কোনো মামলা হয় তাহলে তিনি নিজে বিনা খরচে সাংবাদিকের পক্ষে কোর্টে দাঁড়াবেন। বড় মর্মাহত হয়েছি এটা কোনো আইনমন্ত্রীর কথা!

তাকে কেউ বিনা খরচে কোর্টে পাবে? কখনো পেয়েছে? যদি তিনি এতই দয়াবান হোন তাহলে কথাটা তো আইনের মধ্যেই উদ্দেশ্য ও কারণে লিখে দিতে পারেন (এই আইনে কোনো সাংবাদিককে অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য মামলায় জড়িত করা হবে না। করা হলে আইনমন্ত্রী স্বয়ং সরকারি খরচে সাংবাদিকের পক্ষে আদালতে লড়বেন)। আমাদের প্রিয় আবদুল মতিন খসরুও আইনমন্ত্রী ছিলেন। আমার বিশ্বাস, তিনি কখনো অমন হালকা মন্তব্য করতেন না।

কেউ স্বীকার করুক আর না করুক পবিত্রতার সঙ্গে দেশের জন্য, দেশবাসীর জন্য সামান্য হলেও কিছু করার চেষ্টা করেছি। একজন আইনবিদের ছেলে হিসেবে কেন যেন সবসময় আইনের প্রতি বড় ভয়, সে ভয়ের ঊর্ধ্বে কখনো উঠতে পারিনি। যাওয়ার বয়স হয়ে গেছে, দু-চার বার হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্টে গেছি। আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে মাথা নত করার স্বভাব নেই। তবু বিচারকদের চোখে চোখ পড়বে ভেবে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকেছি। সেই বিচার ও আইন-আদালত যখন ভূলুণ্ঠিত হয় তখন বুক চির চির করে। পাকিস্তান আমলেও জেল খেটেছি। কিন্তু আইয়ুব-মোনায়েমের দারোগা-পুলিশরা এত ছোট লোক ছিল না। খালেদা জিয়ার মামলা নিয়ে কত নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়েছে। তাদের টেনে-হিঁচড়ে অমন গালাগাল না করলে আসমান ভেঙে পড়ত না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব একটা অখুশি হতেন না। সংসদ সদস্য থাকতে কতবার পুলিশের সুযোগ-সুবিধার জন্য তর্ক-বিতর্ক করেছি, ৭১ বিধিতে সংসদে জনগুরুত্বপূর্ণ নোটিস দিয়েছি। ট্রাফিক পুলিশের কোনো প্রমোশন ছিল না, কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। একবার কিছু ট্রাফিক সার্জেন্ট এসেছিল। একজন বলেছিল, ‘স্যার! বিয়ের সময় এক শালা ছিল ক্লাস এইটের ছাত্র। আমার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া শেষ করে সেনাবাহিনীতে গেছে। যেদিন একাডেমিতে যায় সেদিনও বোনের সঙ্গে দুলা ভাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে গিয়েছিল। এখন সে মেজর। স্যার বলে স্যালুট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বিয়ের সময় আমি যে ট্রাফিক সার্জেন্ট ছিলাম, এখনো তাই আছি। এ লজ্জা আর সইতে পারি না। তাই আপনার কাছে এসেছি। আর কিছু না হোক এ লজ্জার হাত থেকে বাঁচান।’ তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিল লুত্ফুজ্জামান বাবর। সে বলেছিল, ‘দাদা! বোঝেনই তো, আমাদের কী করার আছে।’ গিয়েছিলাম বেগম খালেদা জিয়ার কাছে। তিনি ব্যাপারটা বুঝেছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে ট্রাফিক সার্জেন্টদের ইন্সপেক্টরে পদোন্নতি দিয়েছিলেন এবং ২৫০ জনের ওপর সার্জেন্টকে শান্তি মিশনে বিদেশ পাঠানো হয়েছিল। এখনো তাদের কারও কারও সঙ্গে দেখা হলে সে যে কী মধুর ব্যবহার করেন বুক জুড়িয়ে যায়। শুধু ট্রাফিক কেন, পুলিশদের স্বার্থেও প্রাণপাত করেছি। তিনবার বেতন বৃদ্ধি ও নানা সুযোগ-সুবিধার জন্য চিৎকার-পাৎকার করে অনেককেই উতালা করেছি। সবার ডিউটির সময় আছে, পুলিশের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। সেই পুলিশরা রাস্তা পেরোতে যাওয়া ৮-১০ বছরের শিশু বাচ্চাকে ওভাবে মারধর করতে পারে কখনো ভাবিনি। তারা কেমন সেবক, এ কেমন ব্যবহার। বছর ত্রিশেক আগে লন্ডনে কাদের সিদ্দিকী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক, আবাহনী ক্রীড়া চক্রের প্রাণপুরুষ, আওয়ামী ঘাতকদের হাতে নিহত ফারুকের বোন বেলীর স্বামী রিয়াজের বাড়ি লেমিংটন গার্ডেনে ছিলাম। কোনো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলে আলোচনা হতো আমাদের বাড়ির সামনে পুলিশের বাড়ি। আশপাশে কত জজ-ব্যারিস্টার, মিলিয়নিয়ার-বিলিয়নিয়ার কারও কেউ কোনো খবর রাখে না। কিন্তু যেই বলতাম ‘পুলিশের বাড়ির সামনে’ সবাই চিনতে পারত। সেখানে পুলিশের সম্মান সবার ওপরে, তারপর নার্স-ডাক্তারের। কিন্তু আমার দেশের পুলিশরা কেন অমন হলো? আমার কুশিমণির মতো ছোট্ট এক বাচ্চাকে তিন পুলিশ মিলেমিশে নাজেহাল করল, নির্যাতন করল তার আগে কেন আমার মরণ হলো না। এসব দেখতেই কি পরম দয়াময় আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন। তার অতটুকু শরীরে কোথায় আঘাতের জায়গা পেল? দুঃখে বেদনায় বুক ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। অপমান-অভিমানে মরে যেতে ইচ্ছা করে এই পুলিশের জন্য সংসদে অত চিৎকার-পাৎকার করেছি। এমন পুলিশের জন্যই কি আমাদের রক্তাক্ত স্বাধীনতা? জীবনে দুজন নারীর পা ধুয়ে পানি খেয়েছি— একজন মা লতিফা সিদ্দিকী, অন্যজন আমার ঔরসজাত সন্তান বড় মেয়ে কুঁড়িমণি। নব্বইয়ের ১০ ফেব্রুয়ারি কুঁড়ির জন্ম। ১৬ ডিসেম্বর আমি দেশে ফিরি। মনে হয় ওর কপালজোরেই আমার দেশে ফেরা। ঢাকা থেকে রাত ২টায় টাঙ্গাইল পৌঁছে মামণির ছোট্ট তুলতুলে পা ধুয়ে পানি খেয়েছিলাম। দানব পুলিশদেরও বলব, যে ট্রাফিক মেয়েটিকে হাত ধরে পরে রাস্তা পার করে দিয়েছে সেই ট্রাফিকের বুটসহ পা ধুয়ে গ্যালনে গ্যালনে পানি খেলেও এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে কিনা জানি না। পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তখন ওই রাস্তায় ভিআইপি মুভমেন্ট ছিল। সে কি মহামান্য রাষ্ট্রপতি, নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? বৃহত্তর ময়মনসিংহের অধিকাংশ যুব ও ছাত্র নেতা বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর কর্মী ছিলেন। সেজন্য অনেককেই কাছে থেকে দেখেছি। আর মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ একেবারে সাদামাটা মাটির মানুষ। তাকে কি জিজ্ঞাসা করব, ওই বাচ্চাটা রাস্তার ওপর থাকলে তার কি তেমন ক্ষতি হতো? তিনি না হয়ে তবে কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? তিনি তো বাচ্চাদের অসম্ভব ভালোবাসেন, আদর করেন, কোলে তোলেন। সেই প্রধানমন্ত্রীর কতটা অসুবিধা হতো? সোনামণির চোখের চাহনিতে তিনি কি জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যেতেন? কেন প্রশাসনের এমন বাড়াবাড়ি? এসব দেখে কেন যেন বলতে ইচ্ছা করে—

‘ও কে? চণ্ডাল? চমকাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব!

ওই হ’তে পারে হরিশ্চন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব।

আজ চণ্ডাল, কাল হ’তে পারে মহাযোগী-সম্রাট,

তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ।

রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে!

হয়তো গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে!

চাষা ব’লে কর ঘৃণা!

দে’খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না!

যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল,

তারাই আনিল অমর বাণী—যা আছে র’বে চিরকাল।’

‘হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম,

আমিই কি জানি—কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম।

হয়তো আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদি ঈসা,

কে জানে কাহার অন্ত ও আদি, কে পায় কাহার দিশা?’

 

লেখক : রাজনীতিক।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর