মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাউফুন বসুনিয়াকে রক্তের পঙিক্তমালায় স্মরণ

শফী আহমেদ

রাউফুন বসুনিয়াকে রক্তের পঙিক্তমালায় স্মরণ

আজ আমার বন্ধু রাউফুন বসুনিয়ার ৩৩তম মৃত্যু দিবস। ১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারী এরশাদের ভাড়াটিয়া খুনিদের গুলিতে শহীদ হন বসুনিয়া। আজকের এদিনে পরম মমতার সঙ্গে স্মরণ করি তৎকালীন জাতীয় ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রাউফুন বসুনিয়াকে। এরশাদ তাঁর ক্ষমতা তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করার লক্ষ্যে উপজেলা নির্বাচন করার উদ্যোগ নেন। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও রাজনৈতিক দলসমূহ তা প্রতিহত করার ডাক দেয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হল এরশাদের ছাত্র সংগঠন নতুন বংলা ছাত্রসমাজের দখলে ছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ওই দিন সকালে নিয়মিত মিছিল শেষে স্যার এ এফ রহমান হল অভিমুখে রাতে মিছিলের সিদ্ধান্ত নিই। এ ছিল এক কঠিন সিদ্ধান্ত। মিছিলে আক্রমণ হবে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা সূর্যসেন হল ও মুহসীন হলের গেটে জমায়েত হই। মিছিলটি মুহসীন হল থেকে বের হয়ে জহুরুল হক হলের মোড় পর্যন্ত অগ্রসর হতেই একটি মোটরসাইকেলে কালো কোট পরা দুই যুবক মিছিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক রাউন্ড গুলি করে চলে যায়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। বন্ধু বসুনিয়া আমার হাত ধরা ছিল। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। এ এফ রহমান হল ও মুহসীন হলের মাঝখানে তখন সংঘর্ষ চলছে। আমার বন্ধু প্রয়াত কাজী জামিল হক রাজা চিৎকার দিয়ে উঠল বসু আর নেই। আমি বসুনিয়ার নিথর দেহে হাত দিয়ে দেখলাম সব শেষ!

আমাদের এক সহকর্মী মুকুল ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে এরশাদের গুন্ডাবাহিনীর হাতে নিহত হন রাউফুন বসুনিয়া... ওইদিন রাতে সূর্যসেন হলে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়ের দায়িত্ব ছিল বাসদ ছাত্রলীগের। আমরা সন্ধ্যা থেকেই রুমে রুমে গিয়ে মিটিংয়ে আসার জন্য সবাইকে বলতে থাকি। রাত সাড়ে ৮টা-৯টার দিকে বসু ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয় হলের ভিতরে। আমাকে জিজ্ঞাসা করেন রানা হামিদ কোথায়? আমি বলি সামনে যান রানা ভাই আর শফী ভাই সামনেই বসে আছেন। আমাদের কারও একজনের রুমে ডিমের তরকারি আর ভাত রান্না হয়েছিল, সেখানে আমারও খাওয়ার কথা তাই বসু ভাইকে বলি ভাই! মিটিংয়ের দেরি আছে ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত খাবেন? তিনি ‘না’ বলে গেটের বাইরে চলে যান। যথারীতি সভার প্রস্তুতি চলাকালে আমি উনাদের কাছে গেলে শফী ভাই বলেন, তার ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি বললাম তাহলে সিগারেট খাচ্ছেন কেন? আমার উদ্দেশ্য ছিল সিগারেটের বাকি অংশটায় ভাগ বসানো। সেই সভায় সে রাতে সভাপতিত্ব করে আমাদের হল শাখার সভাপতি কামিদ।

নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখার পর এরশাদের উপজেলা নির্বাচন বন্ধসহ আগামীকাল ১৪ ফেব্রুয়ারি বটতলার জমায়েতে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে আমরা স্লোগান দিতে দিতে মুহসীন হল পার হয়ে সামনে এগোতে থাকি। সংখ্যায় ৩০-৩৫ জন ছিলাম। মিছিলের সামনে ছিলেন শফী ভাই, রানা হামিদ, বসু ভাই ও অন্যরা। মুহসীন হল পার হতেই শফী ভাই দ্বিতীয় সারিতে এসে দু-এক বার স্লোগান দিতেই তার গলা বসে যায়। তারপর বসু ভাই জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো বলতেই তার গলার স্বরও দুর্বল হয়ে যায়। সাধারণত প্রায় সব মিছিলে আমি অন্যদের সঙ্গে স্লোগান দিতাম। খানিকটা লজ্জায় আমি বসু ভাইকে বলি ভাই! আপনি সামনে যান আমি স্লোগান ধরছি। তখন আমি স্লোগান ধরি দ্বিতীয় সারি থেকে। জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো, খুনি এরশাদের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। ততক্ষণে মিছিলটা বড় রাস্তায় উঠে গেছে। একটা হোন্ডা সামনে দিয়ে খুব জোরে শব্দ করে এ এফ রহমান হলের দিকে চলে গেল। ঠিক তখন সামনের সারিতে পাশাপাশি বসু ভাই, শফী ভাই ও রানা হামিদ ভাই। তার পরই এফ রহমান হলের সামনে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে একজন কেউ গুলি করেছিল। ধপ করে একটা শব্দ শুনেছিলাম। নিচু হয়ে তাকিয়ে দেখি বসু ভাই! রক্তে ভেজা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঢেকে গেছে চোখ আর কপালে। বসুনিয়ার নিষ্প্রাণ-নিথর দেহ আমরা ক্রলিং করে মুহসীন হলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। মুহসীন হল থেকে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা এ এফ রহমান হলের দিকে শক্তি প্রয়োগ করতে থাকে। অবশেষে লাশ মুহসীন হলের গেস্টরুমে নিয়ে আসতে সমর্থ হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অন্যান্য শিক্ষক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের মধ্যে অনেকেই মুহসীন হলে পৌঁছেন। পুরো ক্যাম্পাসে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসেও নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। পরে পুলিশ প্রহরায় লাশ ঢাকা মেডিকেলের মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকালে শহীদ বসুনিয়ার লাশ নিয়ে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য মিছিল শুরু হয়। মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা শেষ করে পুরান ঢাকার দিকে যেতে থাকলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়। ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে রাজপথে বিভিন্ন সরকারি যানবাহন ও স্থাপনার ওপর হামলা চালায়। ফলে স্বৈরাচারী এরশাদ উপজেলা নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

বসুনিয়ার আত্মদান নয় বছরের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে এক নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করে। আজ স্বৈরাচারের পতনের এত বছর পরও আমরা ঠিক যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আন্দোলন করেছিলাম তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারিনি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে, বছরের শেষ নাগাদ সংবিধান অনুযায়ী সবার অংশগ্রহণে একটি সুষুম নির্বাচন হোক এই আমাদের প্রত্যাশা। বসুনিয়া বিশ্বাস করত বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, সেই বিশ্বাস যেন বাস্তবায়ন হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে।

‘বসুনিয়ার বুকের তপ্ত লাল রক্তে ভেসে যাক সব অন্যায়, ফাগুনের প্রথম দিন প্রকৃতি যেন সেই পরিবেশেই সেজে ওঠে।’

 

লেখক : ’৯০-এর গণআন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের কেন্দ্রীয় নেতা, আওয়ামী লীগ নেতা।

 

সর্বশেষ খবর