মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা
ইতিহাস

প্যান-ইসলামী আন্দোলন

প্যান-ইসলামী মতাদর্শের মূল ভিত্তি ছিল একই খলিফার অধীনে সমগ্র মুসলিম জাহানকে একতাবদ্ধ করা। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আব্বাসীয় বংশের পতনের পর মুসলিম সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে এবং এই বিচ্ছিন্নতার কারণে উনবিংশ শতাব্দীতে অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র ইউরোপীয় শক্তির আওতাধীনে আসে। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের করাল গ্রাসে বহু মুসলিম রাষ্ট্র পতিত হয়। প্যান-ইসলামী চিন্তাধারা তুরস্কের নব্য তুর্কিদের বিশেষ করে নমিক কামাল প্রমুখের মধ্যে উন্মেষ হয়। নিজ সাম্রাজ্যে অতুর্কি, বিশেষ করে বিশাল আরব বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর আনুগত্য লাভের জন্য সুলতান আবদুল হামিদ এই ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন। আবদুল হামিদের রাজত্বে আলেপ্পোর শেখ আবু আল হুদা ছিলেন একজন প্যান-ইসলামী আদর্শবাদী। তিনি ওয়াহাবি মতবাদের বিরোধী ছিলেন। তার মতবাদ ছিল : একমাত্র খিলাফতের মাধ্যমে সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে একতাবদ্ধ করা যেতে পারে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, খিলাফত একটি প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান এবং আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠার একমাত্র মাধ্যম। বিশ্বাসীরা (খলিফা) ন্যায় করলে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবে এবং অন্যায় করলে ধৈর্য ধারণ করবে। কিন্তু আবু আল হুদার প্যান-ইসলামী আদর্শ কেবল আবদুল হামিদের রাজ্যের মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বৈদেশিক হামলা থেকে তুরস্ক রক্ষা করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্যান-ইসলামবাদের সর্বাপেক্ষা খ্যাতিমান প্রতিভূ ছিলেন সৈয়দ জামালুদ্দিন আল-আফগানি। তার জীবন ছিল ঘাত-প্রতিঘাতপূর্ণ। তার জন্ম হয় পারস্যে, যদিও তিনি নিজেকে আফগানি বা আফগানিস্তানের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি মতবাদে শিয়া হলেও নিজেকে সুন্নি হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার মধ্যে পরস্পরবিরোধী গুণাবলির সমাবেশ দেখা যায়। অনেকের মতে, তিনি পারস্যের বিপ্লবের পুরোধা ছিলেন। কিন্তু এ কথাও স্পষ্ট যে, তিনি শাসনতন্ত্রবাদী নন। তিনি মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ভ্রমণ করে এমন একজন শক্তিধর ও প্রভাবশালী শাসকের সন্ধান লাভের চেষ্টা করেন যার মাধ্যমে ইসলামকে পুনর্জীবিত ও একগ্রন্থিভুক্ত করতে পারেন। তার লেখনী ছিল খুব প্রখর এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি অসংখ্য পুস্তিকা প্রকাশ করেন। আফগানি ইরানে আসাদাবাদী নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই যোগ্য, প্রতিভাশালী এবং কার্যকর আন্দোলনকারী। তিনি ধর্মতত্ত্ব অপেক্ষা দর্শনশাস্ত্রকে অধিক প্রাধান্য দিতেন। তাঁর রাজনীতি বাস্তব কর্মপন্থার ওপর নির্ভরশীল ছিল, কারণ তিনি কল্পনাবিলাসী ছিলেন না। ওয়াহাবিদের মতো তিনি প্রথম চার খলিফার যুগকে ইসলামের সর্বাপেক্ষা আদর্শ যুগ বলে মনে করতেন, যদিও ওয়াহাবিদের গোঁড়া মতবাদে তিনি আস্থাবান ছিলেন না। তিনি যুক্তিবাদ ও আধুনিকতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। এ কারণে আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহ যথা বাষ্পীয় ইঞ্জিন এবং বিদ্যুতের মতো আধুনিক রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কোরআনের আয়াতে বর্ণিত রয়েছে— এ কথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তিনি যুক্তি দ্বারা সব বাণীর মর্ম উপলব্ধি করার তাগিদ দেন এবং ইসলামকে ধর্মীয় ঐক্যের দ্বারা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার মনে করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ইসলামে একজন মার্টিন লুথারের (সংস্কারক) প্রয়োজন এবং সম্ভবত তিনি নিজেকেই এই বিরল প্রতিভার ধারক বলে মনে করতেন। বিশ্ব-ইসলামবাদী আফগানি ইরান ও তুরস্কের মধ্যে মৈত্রী স্থাপনের চেষ্টা করেন; তিনি ইসলামের ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আশা পোষণ করতেন যে, ইরানের শাহ তুরস্কের সুলতানকে খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং বিনিময়ে সুলতান ইরানের স্বাধীনতাকে মানিয়ে নেন। তিনি তুরস্কের অধিকৃত শিয়াদের পবিত্র স্থানসমূহ যেমন কারবালা, নজফ ইরানকে ফেরত প্রদানের পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। মুসলিম বিশ্বকে একতাবদ্ধ করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিলাভের জন্য তিনি ইস্তাম্বুলে একটি মহাসম্মেলন আহ্বানের ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী নীতি ধূলিসাৎ করা। পারস্যের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের জন্য আফগানি শাহকে ১৮৯১ সালে পারস্য থেকে বিতাড়িত করেন।

উল্লেখ্য, তিনি শিয়া ছিলেন এবং তাঁর শিয়া অনুসারীর হাতে ১৮৯৬ সালে নাসিরউদ্দিন শাহ নিহত হন।

সৈয়দ জামালুদ্দিন আফগানি শিয়া হয়েও মুসলিম জাহানকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আফগানি নাম ধারণ করে নিজেকে সুন্নি হিসেবে পরিচয় দিতেন। বিশ্ব ইসলামবাদের মূলমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ইসলামের একতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এর বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতার জন্য তিনি কিছুকাল ব্রিটিশদের সহযোগিতা কামনা করেন।

 শাকিলা জাহান।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর