শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

কল্পলোকের গল্পচ্ছলে জেলজীবন!

গোলাম মাওলা রনি

কল্পলোকের গল্পচ্ছলে জেলজীবন!

ইচ্ছা ছিল বিষয়টি নিয়ে লিখব না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যা নিয়ে কথা না বললে হয়তো ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাসের কাছে একটি সময় নিজেকে জবাবদিহি করতে হবে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার আ8গে বলে নিই— কেন আমার বেগম জিয়ার জেলজীবন নিয়ে লেখার আগ্রহ হচ্ছিল না। বিষয়টি নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে, পক্ষে-বিপক্ষে কিংবা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে যেভাবেই চিন্তা করার চেষ্টা করি না কেন তাতে ইতিবাচক আলোচনার কোনো উপাদান খুঁজে পাইনি। আমি কি বেগম জিয়ার শাস্তি এবং জেলজীবন নিয়ে উল্লসিত হয়ে সগৌরব উল্লম্ফনে বিজয়ের দাম্ভিক পদভারে জমিন প্রকম্পিত করব, নাকি বেদনায় নীল হয়ে সকরুণ সুর তুলে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সারা দেশে প্রবাহিত হব! অথবা আমি কি তথাকথিত নিরপেক্ষতার ভান ধরে খাও-দাও ফূর্তি কর নীতিতে চোখ বুজে সময় পার করব, নাকি শোকে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে উগ্রতার আশ্রয় নিয়ে সবকিছু নিজের প্রতিকূলে ঠেলে দেব।

বেগম জিয়ার জেলজীবন নিয়ে উপরোক্ত চিন্তাভাবনার পেছনে তার বয়স, অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা, রাজনৈতিক প্রভাব যেমন আমাকে বিচলিত করেছে তেমনি তাকে নিয়ে শাসক দলের অ্যালার্জি, উত্তেজনা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং ঘৃণা আমাকে মানব জীবনের পরিণতি সম্পর্কে উদাসীন করে তুলেছে। দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রীর জীবন সায়াহ্নের পরিণতি সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে যদি আমি মনে করি যে তার শাস্তি যথার্থই হয়েছে তাহলেও মন বেদনাবিধুর হয়ে পড়ে। কারণ এত বড় পদ-পদবি, অঢেল বিত্তবৈভবের নিয়ন্ত্রণকারিণী; যার মুখের একটি কথায় বা কলমের খোঁচায় রাস্তার ফকির কিংবা দীনহীন এতিম-মিসকিন মুহূর্তের মধ্যে শত কোটি টাকার মালিক হয়ে যেতে পারত অথবা যার পদস্পর্শ করে কিংবা তার জুতার বাক্স মাথায় বহন করে রাজ-অমাত্য হওয়ার পাশাপাশি বাড়ি-গাড়ি, রংমহল ইত্যাদির মালিক বনে যেতেন সেই তিনি কেন এতিমের নাম করে বিদেশ থেকে আসা মাত্র ২ কেটি টাকা তাও আবার প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যবহার করে আত্মসাৎ করবেন! ১৭ কোটি আদমসন্তানের প্রধানমন্ত্রীর মন কেন এত নিচু হবে অথবা আমরা কেন এতিমের টাকা আত্মসাৎকারীকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে অনাগত মহাকালের বিচারে কলঙ্কিত হলাম ইত্যাদি চিন্তা করে লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়।

আমি যদি বিএনপি ও তার শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর মতো উঁচু গলায় বলি যে, বেগম জিয়া নির্দোষ! সরকার তাদের রাজনীতির পথ কাঁটামুক্ত করে নির্বিঘ্নে পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এহেন কাজ করেছে তাহলেও মনে কোনো শান্তি পাই না। কারণ একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি, রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী এবং দেশের প্রায় ৩০ ভাগ লোকের রাজনৈতিক বিশ্বাস, আস্থা ও শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বিমূর্ত প্রতীকের যদি এ অবস্থা হয় তবে অনাগত দিনে কোনো সুস্থ চিন্তার সভ্যভব্য মানুষ রাজনীতির ময়দানে পা রাখতে সাহস পাবে না। ফলে ব্যাংক ডাকাত, লুটেরা, চরিত্রহীন লম্পট এবং দুর্নীতিবাজরা সিন্ডিকেট করে রাজনীতির ময়দানে বিজয় উল্লাসের কেতন উড়িয়ে অসভ্যতামির নজিরবিহীন নজির স্থাপনের জন্য পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করবে। রাজনীতির মাঠ হয়ে পড়বে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নির্মম বালাখানায়, যেখানে আর্তের চিৎকার, নির্যাতিতের রক্ত এবং ভদ্রজনের হাহাকারের শব্দ অদ্ভুত এক সুরলহরি হয়ে দুর্বৃত্তদের বিনোদিত করবে।

বেগম জিয়ার জেলযাত্রার পূর্বাপর ঘটনার মধ্যে রাজনীতির কূটচাল এবং প্রপাগান্ডা দেখে আমি আতঙ্কিত না হয়ে পারি না। তিনি যখন প্রায় নিশ্চিত হলেন যে, এ যাত্রায় জেলে না গিয়ে তার কোনো উপায় নেই তখন তিনি শেষ মুহূর্তে কিছু রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে নিজের জনপ্রিয়তা, গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি তার প্রতিপক্ষকে প্রদর্শনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। এরপর তিনি তার দলের কার্যনির্বাহী কমিটি, স্থায়ী কমিটি ও আইনজীবী প্যানেলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করলেন। তার অবর্তমানে দল কীভাবে চলবে এবং জেলে যাওয়ার পর তার মামলা, সম্ভাব্য জামিন এবং জেলে ঢোকার পর আরও কী কী সমস্যা হতে পারে তা নিয়ে তিনি নিশ্চয়ই বিশদ আলোচনা করেছেন। তিনি এবং তার বিজ্ঞ আইনজীবীরা নিশ্চয়ই জানতেন যে, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০৬ সালে তারা যে কারাবিধি সংশোধন করেছিলেন তাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীদের জেলখানায় গিয়ে কী দুর্ভোগ পোহাতে হবে। সারা দুনিয়ায় প্রচলিত কারাবিধি ও রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা আদালতের পূর্বানুমতি ছাড়াই জেলখানায় ডিভিশন পান এবং বিমানবন্দর, সরকারি গেস্টহাউস, রেস্ট হাউস, সার্কিট হাউস, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভিআইপি মর্যাদা পান। ২০০৬ সালে বিএনপি মনে করেছিল যে, তারা সারা জীবন ক্ষমতাসীন থাকবে। তাই সব সুযোগ-সুবিধা ক্ষমতাসীনদের জন্য অবারিত করে এবং সাবেকদের জন্য বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী পূর্বানুমতির বিধান করে বাহারি আইন প্রণয়ন করেছিল।

২০০৬ সালে বিএনপি হয়তো ভেবেছিল, ২০০৭ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা ছলেবলে কৌশলে বিনা বাধায় একতরফা নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় চলে আসবে। প্রায় ১ কোটি ভুয়া ভোটারসংবলিত ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা, তাঁবেদার নির্বাচন কমিশন, তলপিবাহক রাষ্ট্রপতি এবং একগাদা দালাল ও দলবাজ রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর দাম্ভিক পদচারণে মুগ্ধ হয়ে সেদিনের সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা হয়তো ভেবেছিলেন, তাদের পথের কাঁটা আওয়ামী লীগ যদি তেড়িবেড়ি করে তবে তাদের যাতে এক কম্বলে লাল দালানের স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে শুইয়ে মামাবাড়ির আদরে আপ্যায়িত করা যায় সেজন্য কারাবিধিটি একটু সংশোধন করা দরকার। একইভাবে বিরোধী দল ও মতকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য তারা সন্ত্রাস দমন অ্যাক্ট ও মেট্রোপলিটান পুলিশ অ্যাক্ট তৈরি করেছিল, যে আইনের অধীন কোনো সভা-সমাবেশ, পথসভা, মানববন্ধন এমনকি বিয়েবাড়ির খানাপিনা, মিলাদ মাহফিল, ওয়াজ-নসিহত ইত্যাদির জন্য পুলিশের পূর্বানুমতি দরকার পড়ে। বিএনপির সেদিনের প্রণীত সেসব কালো আইন ২০১৮ সালে এসে কী চমৎকারভাবে কার্যকর হচ্ছে তা বিএনপির চেয়ে এই মুহূর্তে আর কেউ বেশি বুঝবে বলে আমি মনে করি না।

আমার অনুমান বিএনপির সম্মানিত ও বিজ্ঞ আইনজীবীরা জানতেন যে, দুর্নীতির মামলায় সাজা হলে জেলকোড অনুযায়ী বেগম জিয়া ডিভিশন পাবেন না। তারা জনগণের সহানুভূতি অর্জন এবং সরকার ও বিচার বিভাগকে অমানবিক প্রমাণের জন্য ছোট্ট একটি রাজনৈতিক চাল চালার জন্য রায় ঘোষণার দিন বেগম জিয়ার জন্য ডিভিশন চেয়ে আদালতে কোনো দরখাস্ত করেননি। ফলে পুরো পরিস্থিতি এগোতে থাকল বিএনপির দাবার ঘুঁটির চাল অনুযায়ী। বেগম জিয়া জেলে গেলেন এবং বিধি মোতাবেক ডিভিশন পেলেন না। সারা দেশের বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক সমর্থক নেতা-কর্মীরা লক্ষ কোটি মুখে আহা! আহা! ছি ছি! মরি মরি! কী লজ্জা, কী সর্বনাশ! ইত্যাদি রব তুলে বাংলার আকাশ-বাতাস বেদনার বিষবাষ্পে ধূমায়িত করে তুললেন। সবার মুখে একই কথা— একজন ৭৩ বছর বয়স্ক সম্মানিত নারী যিনি দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলের প্রধান তার সঙ্গে একি বর্বর আচরণ! এমন নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ তো বুশও করেননি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে।

বিএনপির উল্লিখিত ছোট্ট একটি রাজনৈতিক কৌশল কতটা দাবানলের উত্তাপ সৃষ্টি করেছে তা গত কয়েক দিনের মাঠ-ঘাট, চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে একান্ত ফিসফিসানির আলাপ-আলোচনা পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে। বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খেটে খাওয়া মানুষ যারা কোনো দিন রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না তারাও বেগম জিয়ার দুঃখে নানা বিরূপ মন্তব্য শুরু করে দিয়েছেন। বাংলাদেশের আপামর নারীসমাজ এবং সর্বশ্রেণির বয়স্ক জনসাধারণ বেগম জিয়ার দুর্বিষহ জেলজীবনের কথা স্মরণ করে ভর্ত্সনা আরম্ভ করেছেন। বিভিন্ন পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী এবং নাক উঁচু মধ্যবিত্ত ও অভিজাতবর্গ যারা রাজনীতি নিয়ে সাধারণত মাথা ঘামান না তারাও নাকে নস্যি দিয়ে বিরাট বিরাট হাঁচি তুলে ক্ষণে ক্ষণে বলে উঠছেন— এটা বড্ড অনাচার! বড্ড বাড়াবাড়ি! এসবের কি আদৌ দরকার ছিল।

নরম মনের মানুষজন যারা খাওয়া-দাওয়া এবং উপাসনা ছাড়া কিছুই ভাবতেন না তারাও বড় বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বিরতিহীনভাবে আহাজারি শুরু করেছেন হায় আল্লাহ! হায় ভগবান! ওদের কি পরকালের কথা একটু চিন্তা হয় না! বেগম জিয়ার জেলজীবন নিয়ে বিএনপির পরিকল্পনা তাদের দীর্ঘদিনের চিন্তাভাবনার ফসল। সরকারি দল এবং তাদের অনুগত রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের যৌথ মহড়া ও যুগপৎ অভিযানের কারণে গত চারটি বছর বিএনপি-জামায়াত জোট রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক বিপ্লব ঘটানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক স্থিতি সরকারি দাপটে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং মতভেদ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সরকারের কঠোর অবস্থান এবং প্রচলিত রাজনীতির পথে পদে পদে সীমাহীন বাধা সৃষ্টির কারণে তারা না নিজেরা সংগঠিত হতে পারছেন, না জনগণকে সংগঠিত করতে পারছেন।

ইদানীং বিএনপি যে রাজনৈতিক মহাসংকটে পড়েছে ঠিক একই রকম সমস্যায় ভারতীয় কংগ্রেস, পাকিস্তান পিপলস পার্টি, ভারতীয় জনতা পার্টি ও আওয়ামী লীগ বেশ কয়েকবার পড়েছে। অতীতে দলগুলো যেভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান করেছিল ঠিক একই কায়দায় বিএনপিও এগুলোর চেষ্টা-তদবির শুরু করেছে।

ভারতীয় কংগ্রেস যখন ব্রিটিশ জমানায় অস্তিত্ব সংকটে পড়ল তখন দলীয় সিদ্ধান্তে মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীকে সুকৌশলে মহাত্মা গান্ধী বানানো হলো। পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোকে বানানো হলো ডটার অব দি ইস্ট। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সূত্রে আমরা পেলাম বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার লোকজন তাকে জাতীয় মা বানিয়ে সংকট থেকে বেরিয়ে এলো। পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাস বাদ দিয়ে আমরা যদি অনাদিকালের রাজনীতির দিকে লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাব, সংকটাপন্ন রাজনৈতিক দল, মত, গোষ্ঠী বা দেশ নিজেদের প্রয়োজনে মানব-মানবীকে যেমন মহামানব-মহামানবীতে পরিণত করেছে তেমনি প্রতিপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বীকে দানব-দানবীতে রূপান্তরিত করে জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও ঘৃণার রাজ্যে ঝড় তুলে রাজনৈতিক বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা ইদানীং হঠাৎ করেই তাদের নেত্রীকে ঐতিহ্যগতভাবে ম্যাডাম সম্বোধনের পরিবর্তে মা অথবা দেশমাতা সম্বোধন শুরু করেছে এবং গত কয়েক দিনে তা সারা বাংলাদেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মাঝে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বেগম জিয়া যদি সত্যিই মা সম্বোধনে জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েন তবে তা আওয়ামী লীগের জন্য রীতিমতো অস্বস্তিকর ঈর্ষার বিষয়বস্তুতে পরিণত হবে।

বেগম জিয়াকে জেলে রেখে বিএনপি অতি সহজে নিজেদের সব ব্যর্থতার দায়মুক্তি ঘটাতে পারবে এবং নিত্যনতুন অভিনব রাজনৈতিক কৌশলে সরকারকে ব্যস্ত ও বিভ্রান্ত করতে পারবে। কারণ বিপদে পড়লে মানুষের যেমন সাহস-শক্তি বেড়ে যায় তেমনি তাদের বুদ্ধির দরজা খুলে যায়। মানুষ ধৈর্যশীল হয়ে পড়ে এবং হিংসা-দ্বেষ, পরচর্চা ইত্যাদি বাদ দিয়ে কেবল নিজের চিন্তা করতে পারে। প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়মে বিএনপি অতীতের স্থবিরতা, ভীরুতা ও জড়তা কাটিয়ে কীভাবে প্রো-অ্যাকটিভ হয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ১২ ফেব্রুয়ারির একটি সাধারণ পূর্ব ঘোষিত মানববন্ধনের ঘটনায়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আহৃত সেদিনের মানববন্ধন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রীতিমতো বুদ্ধু বানিয়ে দিয়েছিল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আগামী দিনে বিএনপি অনেকটা ঝটিকা ও গেরিলা কায়দায় শান্তিপূর্ণ জনসমাবেশ করে সরকারকে রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেবে। তারা সাধারণত ঘোষণা দেবে এক জায়গায় মানববন্ধনের কিন্তু করবে অন্য জায়গায়। এ ক্ষেত্রে সময়ের আগপিছু এবং স্থান বদল করে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হতচকিত ও অসহায় করে তুলবে। বিএনপি যদি আগামী দিনে প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ডেকে দৈনিক বাংলার মোড়ে জড় হয় কিংবা কারওয়ান বাজারের হোটেল সোনারগাঁও-সুন্দরবনের সামনে জড় হয় তখন পুলিশ প্রস্তুতি নেওয়ার সময়টুকুও পাবে না। তারা যদি মিরপুরের গোলচক্কর, ফার্মগেট চৌরাস্তা, গুলশান গোলচক্কর, উত্তরার জসীমউদ্দীন রোড গোলচক্কর, বাড্ডা-রামপুরা গোলচক্কর, মালিবাগ-মৌচাক চৌরাস্তা, মতিঝিল, গাজীপুর চৌরাস্তা, সাভার বাসস্ট্যান্ড, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড প্রভৃতি স্থানে ঝটিকা মানববন্ধনে কয়েক হাজার লোক জড় করে ফেলে তবে পুলিশের পক্ষে তা ছত্রভঙ্গ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। পুলিশ হয়তো সরকারকে খুশি করার জন্য ব্যাপক হারে বিএনপি নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করবে কিন্তু তাতে পরিস্থিতি শেষাবধি বিএনপির অনুকূলে চলে যাবে।

বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে আদালতের রায় ঘোষণা এবং তার জেলে যাওয়ার ঘটনায় সরকারি দলের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী খুশি হয়েছেন। অনেকে মিষ্টি বিতরণ করেছেন এবং আগামীতে বিনা বাধায় ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। তারা বিএনপির পরিণতি মুসলিম লীগের মতো এবং খালেদা জিয়ার পরিণতি কোনো এককালের ব্যর্থ, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং পরাজিত রাজনৈতিক নেত্রীর মতো কল্পনা করে আয়েশে হাই তোলা শুরু করলেও শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বিষয়টিকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন শুরু করেছেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, আদালত বেগম জিয়াকে শাস্তি দিয়েছে এতে আমাদের উল্লসিত হওয়ার কী আছে।

জনাব কাদেরের এ সতর্কবাণীই এই ইঙ্গিত বহন করে যে, বেগম জিয়ার পরিণতি নিয়ে সরকারি দলের সহজ কল্পনাশ্রিত গল্পকথা দিয়ে আগামী দিনের রাজনীতি চলবে না।

 

            লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর