শনিবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

এক নারী উদ্যোক্তার স্বপ্নের কৃষি ক্ষেত্র

শাইখ সিরাজ

এক নারী উদ্যোক্তার স্বপ্নের কৃষি ক্ষেত্র

নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসমতে কৃষির সূচনা হয়েছিল নারীর হাত দিয়ে। সেই আশির দশকে যখন ‘ হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ তৈরি করতে ঘুরে বেড়াচ্ছি দেশের আনাচে-কানাচে, তখন থেকে দেখেছি আমাদের দেশেও কৃষির গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশে রয়েছে নারীর অবদান। সে সময় একবার ভেবেছিলাম নারী ঠিক কতটুকু কৃষিতে জড়িত তা বোঝা যেত একটা পরিসংখ্যান বের করা গেলে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার একটা পরিসংখ্যান তখন পেয়েছিলাম। ‘বিশ্বজুড়ে কৃষিতে নারীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিশ্রমিকের ৭০%, খাদ্য উৎপাদনকারীর ৮০%, খাদ্যসামগ্রীর প্রাথমিক প্রক্রিয়াকরণে ১০% নারী। গ্রামীণ কৃষি বিপণনের ৬০-৯০ শতাংশ নারীর দখলে। এভাবে কৃষি উৎপাদনে যুক্ত কর্মী সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী।’ (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, ১৯৮৫)।

এই কথাটা আমার মনে পড়ল রাজিয়া সুলতানাকে দেখে। রাজিয়া সুলতানা একজন কৃষি উদ্যোক্তা। গত সপ্তাহে দেখে এসেছি কৃষি নিয়ে তার বিশাল কার্যক্রম। সে গল্পই আজ শোনাব আপনাদের।

 

রাজিয়া সুলতানা ছিলেন গৃহিণী। শৈশব থেকে হৃদয়ে লালন করেছেন কৃষির প্রতি টান। জানালেন টেলিভিশনে কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে দেখে মনে সাধ জাগত কৃষিকাজ করার। বিয়ের পর স্বামীর চাকরির জন্য ঘুরতে হয়েছে জেলায় জেলায়। কখনো সিলেট, কখনো রাজশাহী, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম বিভিন্ন জেলা ঘুরে থিতু হয়েছেন সাভারে। সাভারে এসে অল্প অল্প জমি লিজ নিয়ে তৈরি করেছেন কৃষির ক্ষেত্র। শুরু ২০১৪ সালে। প্রথমে ২ বিঘা, এরপর ৫ বিঘা। এভাবে অল্প অল্প করে এখন ১৮ বিঘা জমি লিজ নিয়ে তৈরি করেছেন তার স্বপ্নের কৃষি খামার।

শীতের সকালে হাজির হলাম তার কৃষি কার্যক্রম দেখতে। দেখে মনে হলো ইউরোপের কোনো সবজি খেত। কারণ বিস্তীর্ণ প্রান্তরজুড়ে আমাদের নিত্য চাহিদার কৃষিপণ্য আবাদ হচ্ছে না। আবাদ হচ্ছে বিদেশি সবজি। পুষ্টিগুণ আর আভিজাত্যের বিবেচনায় এসব সবজি এখন নাগরিক সমাজে অনেক বেশি আদৃত। ১৮ বিঘার এই খেতে রয়েছে ব্রুকলি, ক্যাপসিকাম, চেরি, টমেটো, ক্যাবেজ, রেডবিট, সেলেরি, চাইনিজ ক্যাবেজসহ নানা রকমের বিদেশি সবজি ফসল। কৃষি উদ্যোক্তা রাজিয়া সুলতানার স্বপ্নটা ভিন্ন। যথেষ্ট সাহসীও তিনি। স্বপ্ন বাস্তবায়নে অনড় এক নারী। আর এর ভিতর দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন পুরোদস্তুর একজন কৃষক। একসঙ্গে কাঙ্ক্ষিত আয়তনের জমি না পাওয়ায় কয়েকটি খণ্ডে গড়েছেন এই খামারটি। একেক অংশের বৈচিত্র্য একেক রকম। ছোট ছোট অংশে নানা ধরনের বিদেশি সবজির চাষে গড়ে তুলছেন সাফল্যের ভবিষ্যৎ।

প্রতিটি সবজির উৎপাদন খরচ, বিক্রয়মূল্য সবকিছুরই চুলচেরা হিসাব রয়েছে রাজিয়া সুলতানার। তরুণ এই নারী উৎপাদনের প্রতিটি ধাপের অঙ্ক মিলিয়েই যেন যুক্ত হয়েছেন কৃষির এই অনুশীলনে। ৪ বিঘা আয়তনের ব্রুকলি খেত থেকে উৎপাদন আর লাভের হিসাব খেত থেকেই বুঝে নিচ্ছেন রাজিয়া। তার এই হিসাব অন্য কৃষকের জন্য অনুসরণীয়।

রাজিয়া সুলতানা জানালেন, প্রতিটি ক্যাবেজ উৎপাদন থেকে বাজারজাত করতে খরচ হয় ৭ টাকা। মৌসুমের শুরুতে ৫০ টাকা করে প্রতিটি ক্যাবেজ বিক্রি হয়। তারপর বিক্রি করেছেন ৩৫ টাকায়। এখন বিক্রি করছেন ১৮ টাকায়। দাম এর নিচে নামবে না। ফলে লাভের হিসাবটা খুব সহজ। দেশি সবজির সঙ্গে বিদেশি সবজির দামের একটা তুলনামূলক চিত্রও তুলে ধরলেন রাজিয়া। ফুলকপি আর ব্রুকলি উৎপাদনে প্রায় একই খরচ। প্রতিটি ফুলকপি বিক্রি করতে পারেন সর্বোচ্চ ২০ টাকায় সেখানে ব্রুকলি বিক্রি করেছেন সর্বোচ্চ ১০০ টাকায়। আবার মুলা আর চাইনিজ বিটের উৎপাদন খরচ এক হলেও প্রতি হালি মুলা বিক্রি হয় ৫ টাকায়, কিন্তু প্রতি হালি চাইনিজ বিট বিক্রি হয় ২০ টাকায়।

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বুজরুক শোকড়া গ্রামের আনছার আলীর কথা মনে থাকতে পারে অনেকের। তিনিই বাংলাদেশে প্রথম বিদেশি সবজি আবাদ করে আমাদের তাক লাগিয়ে দেন। ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছিলাম তার কথা। তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সারা দেশে বিদেশি সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন অনেক কৃষক। রাজিয়া সুলতানাও তাদের একজন।

প্রাচীরের গা-ঘেঁষা যে জায়গাগুলো একটু স্যাঁতসেঁতে সেখানে মাটির আর্দ্রতা ও উপযোগিতা বুঝে সবজি করেছেন রাজিয়া সুলতানা। সবুজ ও শাক-জাতীয় সেলোরি, চাইনিজ ভেজিটেবল বা সুপে ব্যবহার হয়। দামও পাওয়া যায় ভালো। ৬ বিঘা আয়তনের একটি খেতে আবাদ করছেন টমেটো। এমন বৃহৎ আকারে আগামীতে সৌদি তরমুজ অর্থাৎ শাম্মাম বা রক মেলন আবাদ করার পরিকল্পনা করছেন বলে জানালেন রাজিয়া।

নানা ধরনের বিদেশি সবজি বিশেষত টমেটো, ক্যাবেজ অথবা ব্রুকলির খেত থেকে প্রচুর ঘাস ও উচ্ছিষ্ট পাতা বের হয়। এসব খাওয়ার জন্য খামারে গোটা দশেক ছাগল পালন করছেন তিনি। পরিকল্পনা রয়েছে শুরু করবেন গরু মোটাতাজাকরণ খামার।

রাজিয়া সুলতানা বিদেশি সবজি আবাদ করতে গিয়ে কয়েকটি সমস্যার কথাও তুলে ধরলেন। নতুন ধরনের এসব সবজি আবাদে কোনো সংকট দেখা দিলে তার সমাধান পাওয়া কঠিন। উৎপাদন যত ভালোই হোক আমাদের দেশে কৃষকের জন্য বড় বাধা মধ্যস্বত্বভোগী। রাজিয়া সুলতানার অভিমত, কৃষকের জানা-বোঝা পরিষ্কার থাকলে সে নিজেই তার অনুকূল বাজার সৃষ্টি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে কৃষক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেন তিনি।

কৃষিতে রাজিয়া সুলতানার বোঝাপড়াটা বাণিজ্যিক হিসাব সামনে রেখে। বিনিয়োগ করেন জেনে-বুঝে। চিন্তার শুরুটা কুটিরশিল্পের মতো। একেবারে অর্থনীতির ক্ষুদ্র অংশ থেকে হিসাব শুরু করেন বলে বিনিয়োগে কখনো ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন না।

এখন আরও অনেকটাই সাহসী রাজিয়া। দিনে দিনে প্রসারিত হয়েছে স্বপ্ন। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও অন্যান্য সমস্যা মাথায় রেখেই তিনি অল্প জমিতে বেশি ফসল উৎপাদনের চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন।  শিগগিরই যাবেন Vertical Expansion-এ। একজন নারী হয়েও স্বামী-সন্তান সামলে বেশ দূর থেকেই প্রতিদিন অফিসে উপস্থিতির মতো মাঠে আসেন রাজিয়া। তার এই আগ্রহে উৎসাহ রয়েছে পরিবারের অন্যদের।

সনাতন ও আধুনিক কৃষির পার্থক্য এখানে স্পষ্ট। রাজিয়া সুলতানার খেতের পাশের জমিতে প্রচলিত ব্যবস্থায় লাউ আবাদ করছেন কৃষক জয়নাল আবেদীন। কথা হয় তার সঙ্গে। জানালেন একই রকম জমির গঠন ও একই আবহাওয়া হলেও শুধু জানা-বোঝার অভাবে তিনি পিছিয়ে আছেন। তবে মাঠের সব কৃষকই দিনে দিনে সনাতন কৃষির তুলনায় বিজ্ঞানসম্মত কৃষিকেই বেশি সমর্থন করছেন। আজ থেকে শত বছর আগে নারীমুক্তির বার্তা নিয়ে ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লিখেছিলেন নারীজাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। আজ যেন আমরা রাজিয়া সুলতানার ভিতর সেই মুক্তিসন্ধানী স্বনির্ভর নারী সুলতানার প্রতিকৃতিই দেখতে পাই। আজকের দিনে কৃষিতে বহুমুখী পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের পেছনে যাদের নিরন্তর শ্রম ও নিষ্ঠা রাজিয়া সুলতানা তাদেরই একজন। আজ তিনি আধুনিক কৃষির এক পথপ্রদর্শক। আমার প্রত্যাশা তার পথ ধরে এমন বাণিজ্যিক হিসাব ও বোঝাপড়া নিয়ে কৃষিতে এগিয়ে আসবেন অনেক নারী। সেই সঙ্গে উচ্চমূল্যের ফল-ফসল ও পুষ্টিকর সবজি আবাদেও আমাদের দেশে নতুন এক গতির সঞ্চার হবে, এ আশা তো রয়েছেই।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব

[email protected]

সর্বশেষ খবর