রবিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

রানী ভিক্টোরিয়া ও তার করিম কাহিনী

নঈম নিজাম

রানী ভিক্টোরিয়া ও তার করিম কাহিনী

ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার একজন কাজের লোক ছিল। তার নাম আবদুল করিম। এই করিম হঠৎ বাকিংহাম প্যালেসে গিয়ে রানী ভিক্টোরিয়ার মন জয় করে নেন। কিন্তু তার সেই অবস্থান কারোরই ভালো লাগেনি। আর লাগেনি বলেই তাকে নিয়ে রাজপ্রাসাদে গভীর ষড়যন্ত্র হয়। ষড়যন্ত্রে রাজপরিবার থেকে শুরু করে সভাসদ, এমনকি খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দরবারও জড়িয়ে পড়ে। কোরআনে হাফেজ একজন করিম সবার টার্গেট হয়ে যান। সবার চিন্তাই ছিল যেকোনোভাবে করিমকে হটানো রানীর মহল থেকে। সেই ষড়যন্ত্র নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমা তৈরি হয়। বই লেখা হয়। এ নিয়ে কল্পকাহিনীরও শেষ ছিল না। এখনো আলোচনা, সমালোচনা আছে। রাজপরিবারের গবেষকরা বিস্ময় নিয়ে সেই কাহিনীর ওপর কাজ করেন। করিম ছিলেন ভারতীয় মুসলমান। তাকে রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠানো হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিশেষ উপহার একটি মোহর দিয়ে। তখন রানীর কাছে ব্রিটিশের দখল করা বিভিন্ন দেশ থেকে সোনার মোহর পাঠানোর নিয়ম ছিল সম্মানের প্রতীক হিসেবে। মোহর দেখে রানী বুঝতেন, তার শাসনভুক্ত দেশগুলো ভালো চলছে। রানীর সামনে এই মোহর উপস্থাপনেরও কায়দা-কৌশল ছিল। রাজাদের কাজ বলে কথা! আর তার সঙ্গে ব্রিটিশ বেনিয়াদের উপস্থাপন। সব মিলিয়ে এলাহি কাণ্ড। সংশ্লিষ্ট দেশের কর্মচারীদের সাজিয়ে রাজকীয় কায়দায় উপস্থাপন করা হতো। করিম ছিলেন তেমনই একজন।

ভারতে নিযুক্ত ব্রিটিশ শাসনক্ষমতার প্রধান গভর্নর জেনারেল করিম ও তার এক সহকারীকে লন্ডনে রাজপ্রাসাদে পাঠান। করিম কাজ করতেন কারাগারে। তার কাজ ছিল আটক ভারতীয় বন্দীদের নাম-ঠিকানা এন্ট্রি করা। ব্রিটিশ বসেরা তার কাজে খুশি ছিল। ইংরেজি বলতে পারতেন করিম। খোশগল্প জমাতে পারতেন। তাই তাকেই নির্বাচিত করা হয়। দুই মাস সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে করিম পৌঁছেন রানীর দরবারে। চূড়ান্তভাবে সামনে নেওয়ার আগে কিছু দিন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কীভাবে আদব-কায়দা বজায় রাখতে হবে সে ব্যাপারে দেওয়া হয় তালিম। তারপর রানীর সামনে হাজির করা হয়। করিম সামনে গিয়ে সব নিয়ম ভুলে যান। করিম তার স্টাইলে রানীর পায়ে কদমবুচি করে বসেন। রানী ভিক্টোরিয়ার তখন বয়স অনেক। তিনি ঘুমাতে আর খেতে বেশি পছন্দ করতেন। আর কোনো কিছুই তার ভালো লাগত না। রাজবাড়ির নিয়ম অনুযায়ী রানীর চাকর-বাকর-রাজকর্মচারীর অভাব নেই। সবকিছু ধরাবাঁধা নিয়মের মধ্যে। শেষ বয়সে এসে রানী ক্লান্ত। এর মধ্যেই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত এসে সাক্ষাৎ করতেন। পরিচয়পত্র পেশ করতেন। আর আসতেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। ডিউকরাও আসতেন বিভিন্ন রাজ্য থেকে। রানী কারও কথাই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন না। এমনকি রাজপুত্রেরও না। তিনি খেতে এবং ঘুমাতেই স্বস্তি অনুভব করতেন। প্রথম দিনের সাক্ষাতে আবদুল করিমের কদমবুচি রানীর কাছে একটু আলাদা মনে হয়। কিন্তু রাজদরবার চমকে ওঠে। এই গাধাটাকে কেন ভারত থেকে পাঠনো হলো তা নিয়ে তখনই গুঞ্জন ওঠে। করিমের সহযোগী ভয় পেয়ে যান, এই বুঝি কোর্ট মার্শালের নির্দেশ আসে। আসলেই তাই, দ্রুত করিমকে দরবার থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। রানী স্মিত হাসলেন। গিয়ে বসলেন বিশ্রামাগারে। তখনই করিমের বিচারের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। এর মাঝে কিছুটা উত্তমমধ্যমও পিঠে পড়ে। কীভাবে বিচার হবে সেই প্রস্তুতির সময়ই রানী খবর পাঠালেন ভারতীয় জীবটাকে তার সামনে হাজিরের। রাজপ্রাসাদজুড়ে হৈচৈ শুরু হয়। রানীকে এভাবে কেউ কখনো দেখেনি। সবাই রানীর কক্ষে জড়ো হন। রানী করিমকে রেখে বাকি সবাইকে বের করে দেন।

করিমের কাছে ভারতের খোঁজখবর নিতে থাকেন ভিক্টোরিয়া। করিম তাকে আগ্রার তাজমহলের কথা জানান। সম্রাট শাহজাহানের করুণ পরিণতি, পুত্রের হাতে বন্দীজীবনের কথাও বাদ যায় না। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর সম্রাটের তাজমহল গড়ার কাহিনী ভিক্টোরিয়া শোনেন। আগ্রা ফোর্টে বন্দীজীবনে থাকার সময় দীর্ঘশ্বাস ও কষ্ট নিয়ে চাঁদনী রাতে দূর থেকে তাজমহলের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলার কথা শুনে রানী আপ্লুত হন। এরপর ভারতীয় সংস্কৃতির কথা আসে। রানী মুগ্ধ হয়ে শোনেন সবকিছু। বৈঠক শেষে রানী নির্দেশ দেন করিমকে তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার। সবাই রানীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, একজন ভারতীয় নিম্নবর্ণের মানুষকে এভাবে নিয়োগদান রাজপরিবারের ঐতিহ্যের বাইরে। তা ছাড়া করিম মুসলমান। ভারতীয় হিন্দুরা বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না। রানী কারও কথা শুনলেন না। তিনি নিজের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে জানিয়ে দেন। করিমের যাত্রা হয় রাজপ্রাসাদে। অসুস্থ রানী ভিক্টোরিয়া সকালে হাঁটতে বের হতেন করিমকে নিয়ে। রাজপ্রাসাদে হাঁটতেন। ঘুরতেও যান এডিনবরা বা অন্য প্রাসাদে। করিম বুদ্ধি দেন হাঁটাচলা করার। রানী তাই শুরু করেন। এর মাঝে রানী বললেন, তিনি হিন্দি শিখবেন। করিম বললেন, হিন্দি শেখার দরকার নেই। কারণ ভারতে উর্দু হলো অভিজাত ভাষা। রানী প্রথমবারের মতো জানলেন ভারতে হিন্দু, মুসলমান আলাদা সম্প্রদায়। ভাষার মাঝেও ঝামেলা আছে। রানী উর্দু শেখা শুরু করলেন। রাজপরিষদে আবার গুঞ্জন উঠল। কেউই বিষয়টি ভালোভাবে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু কারও কিছু করার নেই। কারণ রানীর সামনে কে কথা বলবেন! এদিকে দিন দিন রাজদরবারে দাপট বাড়তে থাকে করিমের। মন্ত্রীরা অখুশি। রাজদরবারের কর্মচারীদের মেজাজ খারাপ। তারা রানীকে জানান, ভারতীয় ব্যক্তিটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে রাজপ্রাসাদে অবস্থান করছেন। তার স্ত্রী ভারতে বসবাস করেন। তিনি স্ত্রীর খবর রাখেন না। ব্রিটিশ শাসনে এভাবে চলতে পারে না। রানী ডাকলেন করিমকে। বললেন, সবকিছু সত্য কিনা? জবাবে করিম জানান, সব সত্য। তার স্ত্রী আছে। তবে সন্তান নেই। রানী আপ্লুত হয়ে বললেন, তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। শিক্ষকের মর্যাদা দিয়ে একটি ভাষা শিখছিলাম। মুনশি নামে ডাকছি। কারণ তুমি বলেছ, ভারতে শিক্ষকদের মুনশি বলা হয়। তুমি আমার সঙ্গে এই মিথ্যা না বললেই পারতে। তুমি তোমার স্ত্রীর প্রতি অবিচার করছ। জবাবে করিম বললেন, আপনি জানতে চাননি এ নিয়ে। তাই বলতে পারিনি। রানী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তবে করিমকে বের করে দেননি। তখনই নির্দেশ দেন করিমের পরিবারকে ভারত থেকে বাকিংহাম প্যালেসে নিয়ে যেতে। রানীর নির্দেশ বলে কথা! তখনই তা বাস্তবায়ন হয়। করিমের স্ত্রী ও শাশুড়িকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজবাড়িতে। তাদেরও ঠাঁই হয় সেখানে। বিষয়টি রাজপরিবারের কারও পছন্দে লাগেনি। তবুও রানীর নির্দেশ বলে কথা!

করিমের স্ত্রী ও শাশুড়ির সম্মানে রানী রাজপ্রাসাদে আলাদা অনুষ্ঠান করেন। বোরকা পরেই করিমের ভারতীয় স্ত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বসেন রানীর পাশে। রাজকর্তারা ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু কারও কিছু করার ছিল না। একদিন করিম রানীর কাছে ভারতীয় আমের গল্প করেন। রানী কোনো দিন আম দেখেননি। রানীর নির্দেশে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ভারতে বিশেষ প্রতিনিধি পাঠান আম নিতে। একটি আম বিশেষ প্যাকেটে করে নেওয়া হয় রানীর সামনে। রানী আম দেখে বিস্মিত হন। কাটার নির্দেশ দেন। কিন্তু দুই মাস জাহাজে রাখা আমটি নষ্ট হয়ে যায়। করিম ছুটে এসে জানান, এই আম খাওয়া যাবে না। কারণ আম নষ্ট। রানী ক্ষুব্ধ হন রাজ কর্মকর্তা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর ওপর।

শুধু পচা আম কাহিনী নয়, আরও অনেক কিছুই হয়েছিল তখন রানীর দরবারে। এই যুগে ভাবছি, সেই যুগে রানী ভিক্টোরিয়ার দরবারে একজন ভারতীয় কীভাবে এত শক্ত অবস্থান নেন! বিস্ময়কর বটে। তবে প্রথমদিকের একটি বিষয় আমার মনেও দাগ কাটে। করিম কাহিনীতে রানীর মনের বড় একটি কষ্ট বেরিয়ে আসে। প্রথম পরিচয়ের সময় রানীকে বলেছিলেন করিম, তিনি জেলবন্দীদের হিসাব লেখার কাজ করেন ভারতে। রানী শুনলেন। একপর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, শোনো, দুনিয়ায় আমরা সবাই প্রিজনার। ভারতে তুমি যাদের তালিকা তৈরি করতে তারা দৃশ্যমান। আবার কারাগারের বাইরে বসবাসকারীরা অদৃশ্যমান। রানী পরোক্ষভাবে তার কঠিন নিরাপত্তা বেষ্টনী, সারাক্ষণ কাজের লোকদের নিয়ন্ত্রণে থাকার বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেন এখানে। আবদুল করিম পরবর্তীতে রানীকে বের করে নেন অনেক শৃঙ্খলার বাইরে; যা ভালো লাগেনি রাজদরবারের কারোই।

করিমের শেষ পরিণতি ছিল নিষ্ঠুর। মৃত্যুর আগে একদিন করিমকে ডেকে নেন। তার সঙ্গে কথা বলেন। এর আগে অনেকবারই তিনি আবেগপ্রবণ ছিলেন করিমের সঙ্গে কথা বলার সময়। চলচ্চিত্রে বেশি দেখানো হয়েছে বলে অনেক ব্রিটিশ গবেষক মন্তব্য করলেও বাস্তবতা অনেকটা কঠিনই ছিল। জগতে সুখ আপেক্ষিক। ক্ষমতায় থাকলেই সুখী হওয়া যায় বিষয়টি তেমন নয়। আজ রাজপ্রাসাদ কাল কী দাঁড়াবে বলা মুশকিল। রানীর মৃত্যুর পর প্যালেস থেকে করিম ও তার পরিবারকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হয়। রানীর দেওয়া সব উপহার পুড়িয়ে দেওয়া হয়। করিমের ক্ষমতা দেখে এত দিন যারা ক্ষুব্ধ ছিল তারা সবাই লাশের শেষকৃত্য সম্পন্নের আগেই বের করে দেয় করিমকে। অথচ এই করিমই সবার নাকের ওপর ছড়ি ঘোরাতেন একদিন রাজপ্রাসাদে। আজ সেই করিম নেই। সেই রানীও নেই। ব্রিটিশরা তখন এই ভূখণ্ড শাসন করত। ব্রিটেনের সেই শাসন নিয়ে বলা হতো, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যায় না। সেই ইংল্যান্ড নেই। রাজপরিবার এখনো টিকে আছে কোনোভাবে। ব্রিটিশের দাপুটে চেহারা দুুনিয়ায় আর দেখা যায় না। অনেক ভুল নীতি আজকের ব্রিটেনকে গুটিয়ে দিচ্ছে। আইরিশ ও স্কটিশদের নিয়েই তাদের সমস্যার শেষ নেই। মানুষের জীবন বড় সংক্ষিপ্ত। কবি নজরুল বলেছেন, ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।’ করিমেরও যায়নি। করিমকে রানী অনেক কিছু দিতে চেয়েছিলেন। করিম তা নিয়ে রানীর মৃত্যুর আগেই ভারতে চলে আসতে পারতেন। আসেননি। রানীর ভালোবাসাই তার কাছে বড় ছিল। আর অন্যদের জন্য সেই ভালোবাসা ছিল সর্বনাশা। তাই তারা করিমের ওপর শোধ নেন রানীর মৃত্যুর পর।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর