সোমবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভাবের ভিখারি ভক্তির কাঙাল

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

ভাবের ভিখারি ভক্তির কাঙাল

১৯৭৫ সালের শোকাহত ১৫ আগস্টের পর রাষ্ট্রকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়, সংবিধানকে অস্পৃশ্য জায়গায় পৌঁছানো হয়, সংবিধানকে ছোঁয়া এবং সংবিধানের নাম উচ্চারণ করা ছিল তখন নরকে যাওয়ার মতো অপরাধ। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ যেই বিজয় দিবস উদযাপন করলাম। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে যেই উদ্দীপনা আরও প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল হঠাৎ করে সাড়ে ৩ বছরের মাথায় স্বৈরশাসকের দেশ পাকিস্তানের সহায়তায় বাংলাদেশ, বাঙালি এবং বাংলার সংবিধানকে ধ্বংস করা হলো বলেই চারদিকে ছিল পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের উচ্ছ্বাস। মেজর থেকে মেজর জেনারেল (মাত্র ৩ বছরে), এ ছিল যার কাছে কল্পনা, তার উচ্চাভিলাষী হওয়াই স্বাভাবিক। উচ্চাকাঙ্ক্ষী বা উচ্চাভিলাষী হওয়া ভালো কিন্তু অবৈধভাবে ওই পথে চলা শুধু মহাপাপ নয়; ক্রান্তিকালেরও ইশারা দিয়ে যায়। যেই গণতন্ত্রের শেষচিহ্ন মুছে গিয়েছিল, সেই গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নির্বাসন থেকে বিশ্ব মানবতার প্রতীক শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এসে শুরু করলেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম।

ইতিমধ্যে ১৯৭৫ থেকে শুরু করে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটি কেবল ধর্মনিরপেক্ষতা ত্যাগ করেনি। যাদের দ্বারা ১৯৭১-এ গণহত্যা হয়েছিল, ধর্ষণ হয়েছিল, লুণ্ঠন হয়েছিল, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নেয়নি, এমনকি দেশ স্বাধীনের পরে অদ্যাবধি ’৭১-এর ভুলের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি তারা দেশটিকে নব্য ধারায় ধর্মান্ধতার দিকে ঠেলে দেয়। পৃথিবীর অগ্রগতি এবং টিকে থাকার জন্য ধর্মের প্রয়োজন শেষ হয়নি, সেটা অনাদিকাল পর্যন্ত টিকে থাকবে। বহু ধর্মের লোকজন ধর্মীয় সাধনা করবে ভিন্ন পথে এবং এক স্রষ্টার কাছে সবাইর প্রার্থনা পৌঁছবে। ধর্ম, কর্ম একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দুটোর মাধ্যমে যদি স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ করা যায়, তাহলে প্রত্যেকের উচিত ধর্ম ও কর্মকে সমগুরুত্ব দিয়ে পালন করা। ধর্ম ও বর্ণের মধ্যে বিভাজন তৈরি না করা। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ সম্পর্কে কাজী আবদুল ওদুদ বলেন, ‘গত শতকের ত্রিশের দশক ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তখন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ যেমন হচ্ছিল তেমনি সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ বা বিদ্বেষও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তার পেছনে ইন্ধন ছিল ওই ব্রিটিশ শাসকদের Divide & Rule একদিকে সশস্ত্র পন্থায় ব্রিটিশ বিতাড়ন যেমন যুবকদের আকৃষ্ট করেছিল, তেমনি কমিউনিস্ট আন্দোলনও বিকশিত হচ্ছিল। কিন্তু সবকিছুতে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক বা দ্বন্দ্বই উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশদের বিতাড়ন কমবেশি সবারই কাম্য ছিল কিন্তু হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব এতই প্রবল হয়ে উঠছিল যে, তা দ্বি-জাতিতত্ত্বের উদ্ভব ঘটায়।’

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ বইতে বলেছেন, “অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক জনাথন গ্লভার, তাঁর খুবই আগ্রহোদ্দীপক ‘বিংশ শতাব্দীর নৈতিক ইতিহাস’-এ এই ধারণা ব্যক্ত করেছেন যে, গত শতাব্দীতে যা যা ঘটেছে শুধু তাই নিয়েই চিন্তা করলে আমাদের চলবে না; আমাদের মনের মধ্যে যে সব দানব বাসা বেঁধেছে তাদের দিকেও খুব ভালো করে, পরিষ্কার চোখে তাকাতে হবে; ভেবে দেখতে হবে কী উপায়ে তাদের আমরা খাঁচায় পুরতে পারি, পোষ মানাতে পারি। একটি শতাব্দীর, কিংবা একটি সহস্রাব্দের অন্ত অবশ্যই এই জাতীয় বিচার-বিবেচনার জন্য খুবই উপযুক্ত সময়। ভারতবাসীদের ধর্মবিশ্বাসের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করে (হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, জৈন, শিখ, পারসি, ইহুদি এবং অন্যান্য) সম্রাট আকবর রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় পক্ষপাতহীনতার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, যাতে জোর দিয়ে বলা হলো, ধর্মের বিচারে কারও জীবনে হস্তক্ষেপ করা চলবে না এবং যে কেউ নিজের ইচ্ছানুযায়ী ধর্মাচরণ করতে পারবে। ‘চিরাচরিত ধারায়’ নয়, ‘যুক্তিবিচারের পথে চলেই’ দুরূহ সামাজিক সমস্যাসমূহের সমাধানের চেষ্টা করা দরকার। আজকের পৃথিবীতে আকবরের এই ধারণার মূল্য আরও বেড়ে গেছে।’

১৯৭৫-১৯৮০ শুধু ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বহুরূপী গণতন্ত্রের জন্য অর্থাৎ নিজের বহুরূপের জন্য কখনো সংবিধানকে স্থগিত করা হয়, কখনো পরিবর্তন করা হয়, নতুন নতুন সামরিক অধ্যাদেশ সংযুক্ত করা হয় যাতে করে গণতন্ত্র বিবর্ণ রূপ ধারণ করে। রাষ্ট্রের প্রতি অবিচল সতর্কতা সংবিধানের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাস অনেকটা নিভৃতে চলে গেল। বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিজস্ব আঙ্গিকে বন্দী করা হলো পাকিস্তান ও তার দোসরদের স্বার্থে। পরবর্তীতে যিনি ক্ষমতায় আরোহণ করলেন তিনি তো সকালে এক অধ্যাদেশ আবার বিকালে তা বাতিল করে নতুন অধ্যাদেশ, এ যেন এক অধ্যাদেশের খেলা। জনগণের মুখে তখন CMLA যেখানে ছিল (Chief Martial Law Administrator তার ব্যঙ্গাত্মক বিশ্লেষণ হলো Cancel My Last Announcement) অবশ্যই পাকিস্তানের শুরুতে যেমন ছিল জারিগানের ছন্দ ‘দুঃখের কথা কাহারে জানাই, সকাল বেলায় মন্ত্রী হলে বিকাল বেলায় নাই’। এই ছিল পাকিস্তান সরকারের শুরুর প্রেক্ষাপট। আমরাও স্কুলে পড়ার সময় এই জারি গান গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিতাম। কখনো কখনো জারি গানের জন্য প্রথম পুরস্কারও পেতাম।

রাষ্ট্রগঠনের জন্য যেই দর্শন, সেই দর্শনের ‘দ’ তাদের মধ্যে না থাকলে ও ক্ষমতায় থাকার ফন্দিফিকির অর্থাৎ ফকিরি যথেষ্ট ছিল। আমার মতো একটা ক্ষুদ্র জীবের ক্ষুদ্র জ্ঞানের বিচার বিশ্লেষণ আমাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুই ছিলেন একজন বহুমাত্রিক দার্শনিক। ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট ড. এ পি জে আবদুল কালামের মতে ২০ বছর বয়সের মধ্যে মহান লক্ষ্য স্থির করতে হবে এবং শুধুমাত্র—‘Work Work & Work hard until you reach your destination’. যেটা শুধু বঙ্গবন্ধুর বেলায় প্রযোজ্য এবং বঙ্গবন্ধু যৌবনেই এ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং বাস্তবে, হরতাল, অবরোধ, অসহযোগ আন্দোলনের সবকিছুরই শেষ পরিণতি সফল সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে এনেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ। একটি জাতিকে কীভাবে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করতে হয় তার অগ্নিসাক্ষী হলেন বঙ্গবন্ধু, পরীক্ষিত অভিভাবক হলেন বঙ্গবন্ধু।

গণতন্ত্র সম্পর্কে প্রত্যেকটা গণতান্ত্রিক নেতা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গণতন্ত্র উপলব্ধি করেছেন, হৃদয়ঙ্গম করেছেন। ‘সেই গণতন্ত্রের বিকাশে চলমান ঐতিহ্যগুলোর প্রাসঙ্গিকতার কথা ধরা যাক। নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর আত্মজীবনী ‘Long Walk to Freedom’ বইতে লিখেছেন যে বালক বয়সেই তিনি গণতন্ত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিলেন। ম্যাকেজুয়েনিতে গোষ্ঠীপ্রধানের বাড়িতে আফ্রিকানদের স্থানীয় সভাগুলোর কাজকর্ম থেকেই তিনি সব শিখেছিলেন; যিনিই কথা বলতে চাইতেন, বলতেন। এটি ছিল গণতন্ত্রের বিশুদ্ধতম রূপ। পদমর্যাদা অনুসারে বক্তাদের আলাদা আলাদা গুরুত্ব হয়তো ছিল। কিন্তু প্রত্যেকের কথাই শোনা হতো। গোষ্ঠীপ্রধান ও প্রজা, যোদ্ধা ও চিকিৎসক, দোকানদার ও চাষি, ভূ-স্বামী ও মজুর কেউই বাদ পড়তেন না। স্ব-শাসনের ভিত্তিটি ছিল এই যে প্রত্যেকেরই মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল এবং নাগরিক হিসেবে সমান মূল্য ছিল। শুধু মাত্র স্বৈরশাসকদের কাছে এই মতামতের কোনো গুরুত্ব নেই এবং তারা কারও মতামতের তোয়াক্কা করেন না।

‘স্বাধীনতার পথে দীর্ঘযাত্রা’টি তাঁর গ্রামেই শুরু হয়েছিল-এ কথা বলতে গিয়ে ম্যান্ডেলা কিন্তু এ রকমটা দাবি করছেন না যে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের দিকে তাঁকে টেনে নিয়ে যাওয়ার পিছনে অন্য কোনো কিছুরই কোনো ভূমিকা ছিল না। তিনি এ কথাও বলছেন না যে, দক্ষিণ আফ্রিকার সামাজিক ঐতিহ্যটি অন্যরকম হলে সেখানে গণতন্ত্রের কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকত না। বক্তব্য হচ্ছে, ম্যান্ডেলা তাঁর গ্রামে যে ঐতিহ্যগুলোকে দেখেছিলেন সেগুলো অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ এবং অন্যান্য যেসব তাৎপর্যপূর্ণ উপাদানগুলো দক্ষিণ আফ্রিকাতে ম্যান্ডেলা ও অন্যান্যদের প্রভাবিত করেছিল, তাদের সঙ্গে এই ঐতিহ্যগুলো গভীর আন্তক্রিয়ার সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। যেহেতু রাজনীতি ও ঔপনিবেশিক ইতিহাসের আলোচনায় আফ্রিকাতে গণতন্ত্রের এই পূর্বচিহ্নগুলো অবহেলিত থেকে গেছে, সে কারণে আফ্রিকার ঐতিহাসিক পরস্পরাগুলোকে তুলে ধরাটা ম্যান্ডেলার কাছে ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের মননগত ও সামাজিক ইতহাসে তার তার্কিক ঐতিহ্যগুলোর অবদানও আজকের দিনেও কেন সেগুলো এত প্রাসঙ্গিক-তা কেবলমাত্র এই ব্যাপক পরিসরেই বুঝে ওঠা সম্ভব। সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটির জটিলতা সত্ত্বেও ঐতিহ্যসমূহের নিজস্ব আন্তক্রিয়াশীল প্রভাব আছে। দৃঢ় বিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা ও অবিচল সতর্কতাই জাতিকে স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যে পৌঁছিয়ে দিবে গণতন্ত্রকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাবে। আর আমাদের মতো শিক্ষিত, সচ্ছল ও সমাজ সচেতনদের হতে হবে—ভাবের ভিখারি, ভক্তির কাঙাল, দ্রব্যের কাঙাল নয়।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর