বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

সরকারের রাজনীতিতে সুসময় অর্থনীতিতে দুঃসময়

পীর হাবিবুর রহমান

সরকারের রাজনীতিতে সুসময় অর্থনীতিতে দুঃসময়

ইতালি সফর শেষে দেশে ফিরে সোমবার বসন্তের বিকালে গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনটি সুসংবাদ দিলেন। উত্ফুল্ল আত্মপ্রত্যয়ী প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এক. দেশ ফোরজি যুগে প্রবেশ করেছে, দুই. বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রস্তুতি শেষ, তিন. আকাশপথে সরাসরি কার্গো পরিবহনে যুক্তরাজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। এটি সত্য যে, এই অর্জন যেমন সরকারের তেমন দেশবাসীর জন্য সুখবরই। আইটি খাত ফোর্থ জেনারেশনে প্রবেশ করায় আমাদের ইন্টারনেট গতি তীব্রতাই পায়নি বরং আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি খাতে রীতিমতো পাল্লা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উেক্ষপণ হলেই সোনায় সোহাগা। শুধু মানুষের জন্য সহজলভ্যই নয়, সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে আইটি খাত এবং দাম কমে যাবে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দিনবদলের সনদ বা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান তুলে শেখ হাসিনা যখন ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত হয়ে ক্ষমতায় এলেন তখন অনেকেই ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে ভ্রূ কুচকেছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা দেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব ঘটাতে সফল হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তার পুত্র হার্ভার্ড পাস তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয় উপদেষ্টা হিসেবে মায়ের পাশে থেকে প্রযুক্তি বিপ্লবের নায়ক হিসেবে নিজের ক্যারিশমা দেখাতে পেরেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ১৩ কোটি মোবাইল সিম এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। কেউ কেউ একাধিক সিম ব্যবহার করছেন। ফোরজি যুগে দেশের প্রবেশ একটি মাইলফলক। এই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা আগামী জাতীয় নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড ভোগ এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী সময়মতো দেশে নির্বাচন হবে। অর্থাৎ তার অধীনেই নির্বাচন হচ্ছে। বিএনপি নির্বাচনে এলো কি এলো না এতে তাদের কিছু যায় আসে না। অর্থাৎ বিএনপিকে নির্বাচনে আনার জন্য সরকার যে আন্তরিক উদ্যোগ নেবে না তারই ইঙ্গিত দিলেন। তিনি আরও বলেছেন, বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি এবারও পারবে না। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে সর্বত্র একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পূর্ণ মেয়াদ কাটিয়ে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে শেখ হাসিনা যখন কথা বলছিলেন তখন তিনি অনেক দৃঢ় এবং আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে নির্বাচন থেকে ছিটকেই পড়েননি, নাজিমউদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে নিঃসঙ্গ কয়েদির কারাদণ্ড ভোগ করছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান কারাদণ্ড ও ফেরারি আসামির পরোয়ানা মাথায় নিয়ে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। দেশে ব্যাপক জনসমর্থন থাকার পরও মামলা আর মামলার জালে আটকা বিএনপি নেতারা কঠিন দুঃসময়ের মুখোমুখি। নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে সরকারি দলের জন্য যে ‘মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো’ বাড়তি পাওয়া তা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেই বোঝা যাচ্ছে। বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষীদের মতে, নেতৃত্বহীন দলটিতে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অংশগ্রহণ করতে না পারলেও তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা সময়ের দাবি। খালেদা জিয়ার দণ্ড সামনে রেখে বিএনপি তড়িঘড়ি করে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনেই জমা দেয়নি তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার পথটিও খুলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টিরও সমালোচনা করেছেন। এই সমালোচনা প্রধানমন্ত্রীরই নয়, বিএনপির অভ্যন্তরেও অল্পবিস্তর রয়েছে। নানা মহলে তো আছেই তারেক রহমান রাজনীতির ইতিহাসে দুর্নীতির বরপুত্র হয়ে নির্বাসিত হয়েছিলেন। বিএনপির উত্তরাধিকারিত্ব নির্বাচিত হলেও প্রজ্ঞা, মেধা, নেতৃত্বমহিমায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নিজেকে ততটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি।  লন্ডনের নির্বাসিত জীবনে উচ্চশিক্ষাসহ রাজনৈতিক বই-পুস্তক পড়াশোনার মধ্য দিয়ে নিজেকে যেমন অভিজ্ঞ করে তুলতে পারেননি তেমনি দেশে ফিরেও একজন সাহসী রাজনীতিবিদের মতো কারাবরণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারেননি। এই দেশের প্রয়াত জাতীয় নেতাদের কথা বাদ দিলেও দুই নেত্রীর নাম না নিলেও সেনাশাসক এরশাদের কথা না বললেও অসংখ্য রাজনীতিবিদ রয়েছেন; যারা দেশের প্রধানমন্ত্রী হননি, মন্ত্রী হননি জীবন-যৌবনের বড় অংশ জেলে কাটিয়েছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞ বিএনপিতে অনেক নেতা রয়েছেন। তাদের কাউকে দায়িত্ব দেওয়া যেত। কার্যত নেতৃত্বহীন বিএনপি রাজনীতির এই কঠিন দুঃসময়ে বাস্তবতার আলোকে কতটা যৌথ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সেই প্রশ্ন থেকে যায়।

প্রধানমন্ত্রী ইতালি যাওয়ার আগেই সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা সাবেক মন্ত্রী ও ডাকসুর জিএস জিয়াউদ্দিন বাবলু প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের পদত্যাগ চেয়েছিলেন। এমন কোনো পরীক্ষা নেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে না। শিক্ষামন্ত্রী এর নৈতিক দায় এড়াতে পারেন না। জনগণের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষের শেষ নেই। তার পদত্যাগ অনেকেই চেয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি নাকচ করে দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাজনীতির দীর্ঘ সময় বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার রিপোর্টিং জীবনে দীর্ঘদিন তার সংবাদ কভার করেছি। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তার বক্তব্যগুলো এখনো কানে বাজে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সবিনয় প্রশ্ন— আজকে বিরোধী দলে থাকলে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে লালন করে আপনি কি শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ চাইতেন না?

প্রধানমন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারা বাদ দিয়ে ডিজিটাল আইনের যে ৩২ ধারা করা হচ্ছে তা নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের আপত্তির বিষয়েও কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সাইবার ক্রাইম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা এ নিয়ে আপনাদের ভয় কেন? কেউ যদি অপরাধ করেন তাহলে এটি প্রয়োগ করা হবে। ফৌজদারি আইন অনুযায়ী কেউ অপকর্ম না করলে সেখানে অপপ্রয়োগ কেন হবে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এখানেও সবিনয়ে বলতে চাই— এই কালো আইন গণমাধ্যমকর্মীদের হাত বেঁধে দেবে। স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগ বিশেষ ক্ষমতা আইন করেছিল। ক্ষমতাচ্যুতির পর সেই আইনের অপপ্রয়োগে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতা-কর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আজকে আপনার ডিজিটাল আইন ৩২ আপনার শাসনামলে হয়তো অপপ্রয়োগ হবে না কিন্তু একদিন আপনার পর যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা অপপ্রয়োগ করবেন না তার গ্যারান্টি কোথায়?

নির্বাচনের এই বছর রাজনৈতিকভাবে সুসময় হলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, সরকার নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন প্রকল্পে অনেক টাকা খরচ করবে। এতে মানুষের হাতে টাকা থাকবে নাকি গোষ্ঠীর হাতে থাকবে তা পরের প্রশ্ন, কিন্তু মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। প্রবাসী রেমিট্যান্স কমে গেছে, আমদানি বাড়লেও সেখানে পুঁজি পণ্যের হার বাড়ছে। পদ্মা সেতু ও রূপপুর ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ নেই কিন্তু পুঁজি পণ্যে ট্যাক্স কম থাকায় দাম বাড়িয়ে ওভার ইনভয়েসে টাকা পাচারের ঘটনা ঘটতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীর নিজেই বলেছেন ব্যাংক খাতে এখন আতঙ্ক, আমানত তুলে নেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। তিনি বেসরকারি ব্যাংক থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান অহেতুক যাতে টাকা তুলে না নেয় সেজন্য অর্থমন্ত্রীকে নজর দিতে বলেছেন। ব্যাংকাররা যেমন উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারীরা তেমন বিভ্রান্ত। নতুন ব্যাংকে টাকা রাখতে সরকারি প্রতিষ্ঠান যখন নিরাপদ বোধ করছে না তখন সাধারণ গ্রাহকরা আতঙ্কিত। পুরনো বেসরকারি ব্যাংক থেকেও কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান টাকা সরিয়ে নেওয়ায় তারল্য সংকট বেড়েছে। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হারিয়েছে, বাড়ছে সুদের হার। এর নেতিবাচক প্রভাব শেয়ারবাজারেই নয়, গোটা অর্থনীতিতে পড়ছে। গভর্নর নিজে বলেছেন একসময় যে আতঙ্ক ছিল শেয়ারবাজারে তা এখন গ্রাস করেছে ব্যাংকিং খাতকে। অর্থমন্ত্রী থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থনীতিবিদ থেকে রাজনীতিবিদ সবার বক্তব্যেই ব্যাংকিং খাত  শেয়ারবাজার ঘিরে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার চিত্র যেমন ফুটে উঠেছে তেমন সর্বত্র অর্থনৈতিক খাত রক্ষায় গভীর আকুতি উঠেছে।

রবিবার জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যর্থতার অভিযোগ এনে অবসরে যেতে বলেছেন। পদত্যাগ চেয়েছেন। জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেছেন, আজ অর্থনীতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অর্থনীতির রক্তক্ষরণের কারণে জাতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে। পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারির মাধ্যমে অর্থনীতিকে দুর্বল করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ডিসেম্বরে অবসরে যাবেন। বাবলুর প্রশ্ন, ডিসেম্বর পর্যন্ত কেন রক্তক্ষরণ কনটিনিউ করবেন, আজকে এখনই পদত্যাগ করুন, মানুষকে বাঁচান, জাতিকে বাঁচান। বাবলু আরও বলেন, অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যাংকিং খাতে আতঙ্ক, উদ্বেগ, বিভ্রান্তি বিরাজ করছে। হ্যাঁ, এ অবস্থা মানি মার্কেটেরও।

হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। প্রথমে পানামা পেপারসে নাম এলো, সরকার বা অর্থমন্ত্রী কোনো ব্যবস্থা নিলেন না। তারপর প্যারাডাইস পেপারসে অনেক ব্যবসায়ীর নাম এলো। কোনো ব্যবস্থা নিলেন না। এগুলো বিভিন্ন ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমে ওয়াশিংটনভিত্তিক কোম্পানি বের করেছে। অথেনটিসিটি আছে। এগুলোর ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।

বাবলু বলেন, বিদেশে অর্থ পাচারে ২৭ জনের নাম এসেছে। কেউ রাজনীতিবিদ নন। ব্যবস্থা নিতে ভয় কীসের? তিনি বলেন, সোনালী, রূপালী, জনতা ও বেসিক ব্যাংক থেকে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা চলে গেছে। এটা গৌরী সেনের টাকা নয়। ১৬ কোটি মানুষের টাকা, কীভাবে দিলেন তার কোনো জবাব নেই।

এর আগে জাতীয় পার্টির আরেক এমপি ও সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশীদ সংসদে দাঁড়িয়ে বলেন, শেয়ার মার্কেটে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে। সূচক নেমে গেছে তলানিতে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য নিম্নমুখী। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এ মুহূর্তে শেয়ারবাজার নিয়ে আবার নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। যে মুহূর্তে ব্যাংকিং খাত বিপর্যয়ের মুখে, শেয়ার মার্কেট তলানিতে, সেই মুহূর্তে কারা এ ষড়যন্ত্র করছে?

আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেল। তাকে বের করে দেওয়া হলেও ব্যাংকের টাকা নেই। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেকে নির্দোষ বলেছেন। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে যে অনাস্থা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছেন সেখানে এ নিয়ে সরকারের কঠোর তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা। এনআরবি ব্যাংকের ভিতরের বেহাল দশা বেরিয়ে এসেছে। নতুন ব্যাংক বা সর্বশেষ দেওয়া ফোর্থ জেনারেশনের দেওয়া ব্যাংকগুলোর অবস্থা ভালো নয়। শোনা যাচ্ছে আরও তিনটি নতুন ব্যাংক আসবে! কেন? কার জন্য? সরকারি ব্যাংক বাঁচাতে একীভূত করার কথা ওঠে, ভিতরে রুগ্নদশা তবু কেন নতুন ব্যাংক?

অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, অধ্যাপক আবুল বারকাত জনতা ব্যাংক শেষ করে গেছেন। সরকারি লোকজনই ব্যাংকিং খাত ডুবিয়েছে। অর্থমন্ত্রী এর আগেও শেয়ারবাজার লুটেরাদের বিরুদ্ধে ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর বলেছিলেন, ওদের হাত অনেক লম্বা। বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর বলেছিলেন, নিজেদের লোকজনের কারণেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। অর্থমন্ত্রী সত্য বলার মধ্য দিয়ে বার বার অসহায়ত্ব ও ব্যর্থতা তুলে ধরেছেন। কোনো ব্যবস্থা কখনই নিতে পারেননি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর বলেছেন, ৪ হাজার কোটি টাকা কোনো টাকা নয়। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে সংস্কারের দাবি উঠলেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বেড়েছে অনেক। ভুয়া এলসির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে অনেক টাকা। একের পর এক ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক ব্যক্তির হাতে একের পর এক ব্যাংক দখলে দেওয়া, যার নিজেরই ব্যাংক ঋণ ৭৫ হাজার কোটি টাকা! এতে গোটা ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকের অনাস্থাই বাড়েনি, ভয়ভীতি আতঙ্ক গ্রাস করেছে  ব্যাংকিং খাতকে। জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারকাত ও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ধরাছোঁয়ার বাইরে দাঁড়িয়ে, কেন আইনের আওতায় আনা হয়নি?  তারল্য সংকট দেখা দেওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শেয়ারবাজারের গ্রাহকদের মাঝে।

নিম্নমধ্য আয়ের দেশ থেকে দেশকে যখন মধ্য আয়ের দেশে নিয়ে যেতে চাচ্ছে সরকার সেখানে ডলারের দাম বাড়ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে যাচ্ছে। ডলারের দাম ১০০-তে যাবে। জনতা ব্যাংকের বারকাত নাম-পরিচয়হীন এক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন দলবাজ পরিচালকদের নিয়ে। ব্যাংক জালিয়াতির এই ঘটনা ভয়ের মাত্রা বাড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করে চলে গেলেও জড়িত কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি কপাল খুলেছিল কয়েকজনের। নিঃস্ব হয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ। পরে আইনের সংস্কার হলেও সেই মামলার আসামিরা এখনো ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে কর্তৃত্ব ফলায়। মানসিক ভারসাম্যহীন এসব চরিত্রহীন লুটেরা পুঁজিবাজারে স্বার্থপরিপন্থী তৎপরতায় চাপের মুখে পড়েছে।

২০১০ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারি আরও কিছু লুটেরার কপাল খুলে দেয়। নিঃস্ব হয়ে পথে বসে যায় ৩২ লাখ বিনিয়োগকারী। সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করেছিল। তদন্ত রিপোর্টের আলোকে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সুপারিশ হয়নি কার্যকর। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খায়রুল হক ২০১১ সালে দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, তিন মাসের মধ্যে বাজার স্থিতিশীল করে দেবেন। সাত বছরে পারেননি। নিজের আখের গুছিয়ে ক্ষমতার দাপট ষোলআনা পূরণ করেছেন। মতলববাজদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। শেয়ারবাজারে এখন সূচক ৬০০০-এর নিচে। পতন ১০০ পয়েন্টে। আতঙ্ক বিরাজ করছে— ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের চেয়েও ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে শেয়ারবাজার। এখন সরাসরি বিনিয়োগকারী ৪০ লাখের ওপরে। ২৫০টি ব্রোকার হাউস পুঁজিবাজারে। সবার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটছে। এ অবস্থা চললে ব্রোকার হাউসগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। আতঙ্ক অস্থিরতায় ঘুম হারাম হয়ে গেছে সবার।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে কৌশলগত বিনিয়োগকারী বা অংশীদারিত্ব ডিমিউচুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫ ভাগ শেয়ার কিনতে চায় চীনের সাংহাই ও শেনজেন কনসোর্টিয়াম স্টক কোম্পানি। সাংহাই বিশ্বের প্রভাবশালী পুঁজিবাজারের তালিকায় পঞ্চম আর শেনজেন অষ্টম স্থানে রয়েছে। তারা ৩০৭ কোটি টাকা প্রযুক্তি খাতে সহায়তা দিতে চায়। ২২ টাকা করে শেয়ার কিনে ৯৯২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে শেয়ারের দাম পড়বে ২৮ টাকা। অন্যদিকে ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ ১৫ টাকা করে শেয়ার কিনতে চায়। প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত এ দেশীয় একটি কোম্পানি তাদের হয়ে পুঁজিবাজারে খেলছে আর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুঁজিবাজারের স্বার্থপরিপন্থী তৎপরতায় কালো হাত প্রসারিত করেছে। ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশনের এক অথর্ব নেতাসহ কেউ কেউ খেলছেন এদের সঙ্গে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ যেখানে তাদের স্বার্থ রক্ষায় চীনা কোম্পানির প্রস্তাব অনুমোদন দিতে চেয়েছে সেখানে সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বাগড়াই দেয়নি, প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত দালাল কোম্পানিটির হয়ে চাপ সৃষ্টি করেছে। এতে ব্রোকার অ্যাসোসিয়েশনসহ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জজুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র অসন্তোষ।

এদিকে আইসিবি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য। সেখানে শেয়ারবাজারের টাকা নিয়ে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট কাটিয়ে স্থিতিশীলতা রক্ষার বিপজ্জনক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আইসিবির ৪০০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করে দেউলিয়া ফারমার্স ব্যাংককে দেওয়া হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ অবস্থা চললে ব্যাংকিং খাতে করুণ বিপর্যয় ঘটবে, আর কৌশলগত বিনিয়োগকারী নিতে গিয়ে পুঁজিবাজারের স্বার্থপরিপন্থী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে শেয়ারবাজারে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ধস নামবে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও অর্থনৈতিক খাত নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এখন নির্বাচনী বছরে। সরকারের জন্য রাজনীতিতে সুসংবাদ হলেও অর্থনীতিতে দুঃসংবাদ বইছে। ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজার নিয়ে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যেমন জরুরি তেমনি নির্বাচনী ইশতেহারে ইতিবাচক আশার আলোর পথ দেখানো জরুরি।

 

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি.কম।

 

সর্বশেষ খবর