রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমার আলমা মেয়টা

আতাউর রহমান

আমার আলমা মেয়টা

ইংরেজি ভাষায় একটি শব্দ আছে ‘Alma mater’ যেটা বলতে বোঝায় সেই প্রতিষ্ঠানটি যেখানে একজন ছাত্র স্বয়ং শিক্ষা লাভ করেছে। শব্দটি মূলত ল্যাটিন ভাষা থেকে উদ্ভূত এবং ল্যাটিন ভাষায় এটার অর্থ হচ্ছে ‘ধাই-মা’ বা দুধ-মা। তা যে প্রতিষ্ঠানটি তাকে শিক্ষার আলোকে আলোকিত করেছে ও তাকে মান আর হুঁশ সংবলিত মানুষে পরিণত করেছে, সেটা তো সত্যিকার অর্থেই তার মায়ের বিকল্প, দুধ-মা।

আর শব্দটির উচ্চারণ হচ্ছে ‘আলমা মেয়টা’ অর্থাৎ শেষ অক্ষর ‘R’ উচ্চারিত হয় না। তা ইংরেজি ভাষায় এরকম খেয়ালি উচ্চারণ বহু আছে। উদাহরণস্বরূপ যেমন-স্কটল্যান্ডের রাজধানীকে ওরা লিখে

 Edinburgh, কিন্তু উচ্চারণ করে ‘এডিনবরা’ লন্ডনস্থ আমাদের দূতাবাসে টিউব তথা পাতাল-রেলে যেতে গেলে যে স্টেশনটিতে নামতে হয়, সেটিকে লিখে Gloucester Road, কিন্তু উচ্চারণ হচ্ছে গ্লোস্টার রোড। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

ইংরেজি ভাষার এই বানান-বৈচিত্র্য তথা উচ্চারণের খেয়ালিপনা প্রদর্শন করতে গিয়ে জর্জ বার্নার্ড শ’ একবার একটি শব্দ লিখেছিলেন,

‘Ghoti’, এটাকে উপস্থিত সবাই উচ্চারণ করলেন ‘ঘটি’। কিন্তু বার্নার্ড শ’ বললেন, না, এটার উচ্চারণ হচ্ছে ‘ফিশ’। অতঃপর তিনি প্রমাণ করে দিলেন :  laugh শব্দের বানানে gh-এর উচ্চারণ ‘f’-এর মতো Women (উচ্চারণ : উইম্যান) শব্দের বানানে O-এর উচ্চারণ হচ্ছে  ‘i’-এর অনুরূপ, আর Nation শব্দের বানানে ti-এর উচ্চারণ হয় ‘sh’-এর মতো, অতঃএব শব্দটির উচ্চারণ ‘ঘটি’ নয়, উচ্চারণ হচ্ছে ‘ফিশ’  (fish)| সে যা হোক, আমি লিখতে বসেছি এমসি তথা মুরারী চাঁদ কলেজ সম্পর্কে। কলেজটি আমার আলমা মেয়টা বটে; কেননা আমি এই কলেজের ছাত্র, আবার এই কলেজে অধ্যাপনাও করেছি। কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা রাজা গিরীশ চন্দ্র তার মাতামহ মুরারী চাঁদের নামে ১৮৮৬ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্রিটিশ আমলেই এটা সরকারিকরণ করা হয়, কিন্তু নাম অপরিবর্তিত থাকে।

আমি ১৯৫৯ সালে আমার জন্মস্থান ঢাকাদক্ষিণে অবস্থিত হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। বর্তমানে এই পাবলিক পরীক্ষাটির নাম হচ্ছে এসএসসি বা মাধ্যমিক পরীক্ষা। আমাদের আগে তথা ব্রিটিশ আমলে এই পরীক্ষাটির নাম ছিল ‘এনট্রান্স’ পরীক্ষা। প্রসঙ্গত, জিন্নাহ সাহেব ও গান্ধীজি উভয়েই ছিলেন এনট্রান্স পাস ও অতঃপর যথাক্রমে বিলেতের লিংকনস ইন ও ইনার টেম্পল থেকে সরাসরি ব্যারিস্টার। এটা চিন্তা করলে এখন বেশ অবাকই লাগে।

আর সে আমলে এখনকার মতো গ্রামেগঞ্জে মহাবিদ্যালয় তথা কলেজ ছিল না। তাই কলেজে পড়তে গেলে শহরে আসতেই হতো। অতঃপর আমিও একদিন বৃষ্টিস্নাত সকালে সিলেট শহরে পদার্পণপূর্বক শহরের উপকণ্ঠে টিলাগড় নামক স্থানে থ্যাকারে টিলার কোল ঘেঁষে অবস্থিত এমসি কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হলাম এবং কলেজ ক্যাম্পাসটি, সত্যি বলতে কী, প্রথম দৃষ্টিতেই আমার প্রাণ কেড়ে নিল। বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক উইলিয়াম মেকপিস্ থ্যাকারের পিতা যে ব্রিটিশ আমলের প্রারম্ভে সিলেটের কালেক্টর তথা বর্তমানের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন এবং তার নামেই যে টিলাটির নামকরণ করা হয়েছে, এ তথ্য তখনোব্ধি আমার জানা ছিল না। কলেজটির স্থাপনা ও নৈসর্গিক শোভা সত্যিই প্রশংসনীয়।

তা কলেজে ভর্তি হওয়ার অল্প কয়েকদিন পরেই ক্লাস শুরু হওয়ার প্রাক্কালে বাক্স-পেটরা নিয়ে এসে উঠলাম কলেজসংলগ্ন ছাত্র হোস্টেলের থার্ড ব্লকে। হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট তখন ছিলেন সুনামগঞ্জ থেকে আগত ফিলোসফির প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাহেব। আমি বিজ্ঞান শাখার ছাত্র ছিলাম বিধায় তার ক্লাস করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে সরাসরি ছাত্রদের কাছ থেকে তার মুখ-নিঃসৃত ফিলোসফি বা দর্শনশাস্ত্রের সংজ্ঞা আমি শোনেছিলাম যেটা খুবই চমকপ্রদ বিধায় আজোব্ধি আমার স্মরণে আছে :

 ‘Philosophy is searching by a blind man in a dark room a black cat, which is not there,’ দর্শনশাস্ত্র হচ্ছে একজন অন্ধ লোক কর্তৃক এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে একটি কালো বেড়াল খুঁজে বেড়ানো, আর বেড়ালটিও সেখানে উপস্থিত নেই।’

ফিরে আসি কলেজের কথায়। কলেজে ভর্তি হয়ে প্রিন্সিপাল পদে যাকে পেয়েছিলাম তাঁর নাম ছিল সলমান চৌধুরী। তিনি ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ ভাদেশ্বর গ্রাম থেকে আগত ও তৎকালে শিক্ষা অঙ্গনে স্বনাম খ্যাত। এরূপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ ও একাডেমিক প্রশাসক আমার জীবনে আমি খুব কমই দেখেছি। কাকতালীয়ভাবে, পরবর্তীতে আমি যখন এমসি কলেজে ইংরেজির প্রভাষক পদে যোগ দিই তখনো তিনি কলেজটির প্রিন্সিপাল এবং আমি থাকা অবস্থায়ই অবসরে চলে যান। মনে পড়ে, তাঁর বিদায়-সভায় আমি বলেছিলাম, we shall be poorer without him.. বাঙালি স্বভাবতই পরশ্রীকাতর (পরস্ত্রীকাতরও বটে!) জাতি; তাই পরে শোনেছিলাম, আমার এ কথাটা নাকি তৎকালীন সহকর্মীদের কারও কারও পছন্দ হয়নি।

আর কলেজে আমার শিক্ষকমণ্ডলীর সবাই, আমার বিবেচনায়, ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও পণ্ডিত ব্যক্তি- অবশ্য ‘যিনি সবকিছু পণ্ড করিয়াছেন তিনিই পণ্ডিত’, সেই অর্থে পণ্ডিত নয়। এদের সবার কথা লিখতে গেলে সাতকাহন হয়ে যাবে; তবে একজনের ব্যাপারে না লিখলেই নয় :

প্রফেসর মুহিব আলী সাহেব আমাদের অঙ্ক পড়াতেন। তিনি ক্লাসে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে অনেক চটকদার কথা ও মজার গল্প শোনাতেন এবং পরবর্তীতে অধ্যাপনাকালে আমি খানিকটা হলেও তাঁর দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছিলাম। তো একবার তিনি একটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন : ‘তুমি যদি গরুকে ঘোড়া বল তাহলে বোঝা যাবে, তুমি গরুও চিন না; ঘোড়াও চিন না। আর যদি গরুকে দেখে বল চিন না তাহলে বোঝা যাবে, তুমি গরু চিন না বটে; তবে ঘোড়া চিনলেও চিনতে পার।’ বারান্তরে ব্রাহ্মণ ঠাকুরের গল্প তিনি আমাদের শুনিয়েছিলেন : ব্রাহ্মণ ঠাকুর গেছেন যজমানে। সেখানে আকণ্ঠ খাবার খেয়ে অস্বস্তিবোধ করায় তিনি গেলেন কবিরাজের কাছে। কবিরাজ তাঁকে একটা বড়ি খেতে দিলে তিনি অপারগতা জানিয়ে বললেন, ‘একটা খাওয়ার জায়গা থাকলে তো এতক্ষণে আরও একটুখানি পায়েস খেয়ে ফেলতাম।’ অবশ্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে সনাতন ধর্মের আর আমাদের ইসলাম ধর্মের ধর্মযাজকদের মধ্যে খুবই কম পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

এমসি কলেজে আমার সহপাঠীদের অনেকেই পরবর্তীতে লব্ধপ্রতিষ্ঠ হয়েছেন। এই যেমন- রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (প্রয়াত), ডাকসাইটে আমলা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছমরুদ্দিন (মরহুম), আতাউর রহমান চৌধুরী ও আশরাফ হোসেন, প্রখ্যাত অধ্যাপক আসাদুজ্জামান, হাই কোর্টের জজ মতিন, বি-কে দাশ (সদ্য-প্রয়াত), আবদুল মতিন ও আবদুল হাই, জেনারেল আজিজ বীরবিক্রম প্রমুখ। অনেকে আবার বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন।

আরেকটা কথা : কলেজে যখন ভর্তি হই তখন সবে আমার দাড়ি গোঁফ গজাচ্ছে। তো ইউ-ও-টি-সি

(u.o.t.c) যেটার বর্তমান নাম এন.সি.সি (N.C.C) সেটাতে যোগদান করলে পর সেনাবাহিনী থেকে কলেজ ইউ-ও-টি-সিতে ডেপুটেশনে আগত অবাঙালি সুবেদার, যাঁকে আমরা ওস্তাদ বলে সম্বোধন করতাম, একদিন বলেছিলেন যে পুরুষ মানুষের গোঁফ না থাকলে আওরাত কি মাফিক লাগ্তা হায় (মেয়েদের মতো দেখায়)। এটা শোনেই গোঁফ রাখতে শুরু করে দিয়েছিলাম, যেটা অদ্যাবধি অক্ষুণ্ন আছে। শুধু সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে গোঁফ-দাড়িতে বহুলাংশে পাক ধরেছে, এই আরকি।

এবারে এমসি কলেজে আমার অধ্যাপনা অধ্যায়।

১৯৬৬ সালের আগস্ট থেকে ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৩ বছর ৪ মাস ১০ দিন আমি এমসি কলেজের ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক পদে শিক্ষকতা করি। তত্পূর্বে স্থানীয় মদনমোহন কলেজে মোট ৯ মাস ছিলাম। তো যেদিন এমসি কলেজে যোগদান করতে যাই, তথায় আমার শিক্ষক ও তৎকালে ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর আলেম আলী খুশিতে গদগদ হয়ে বলেছিলেন, ‘এই কলেজে অনেকের ছাত্র তাদের সহকর্মী রূপে বহাল আছে। আমার ছিল না; তুমি আসাতে আমার সেই অভাব পূরণ হলো। আমি আপ্লুত হয়েছিলাম।

প্রফেসর আলেম আলী সাহেব একজন সহজ-সরল প্রকৃতির সজ্জন মানুষ ছিলেন। পরবর্তীকালে আমি আমলাগিরির চাকরিতে যোগদানের পর ভৈরব থেকে আগত আমার এক সহকর্মীর মুখে শোনেছিলাম, ভৈরবের মৌঢুপি নামক যে গ্রামটি আলেম আলী সাহেবের জন্মস্থান, সে গ্রামের লোকেরা নাকি সরলতার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। এ সম্পর্কে অনেক মজার গল্পও তিনি আমাকে বলেছিলেন; তবে তন্মধ্যে যেটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে এবং যেটি আমি বহুবার যথাযোগ্য স্থানে পরিবেশন করে হাসির ফোয়ারা ফুটিয়েছি, সেটি হচ্ছে : মৌঢুপি গ্রামের এক সহজ-সরল লোক একদা শুনতে পেল যে, তাদের গ্রামের বড় মসজিদের ইমাম সাহেবের এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। এটা শোনে সে নাকি বলেছিল, ‘আর ভালোমানুষ কারে কই, ইমাম সাবেরও ছেলেপুলে হয়!’

যাকগে, যা বলছিলাম। ছাত্ররা বিকালের দিকে স্বভাবতই ক্লাস করতে চাইতো না; আর আমি মুহিব আলী সাহেবের মতো পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে হাস্যরসের কথা ও গল্প বলে তাদের আটকিয়ে রাখতাম বিধায় আলেম আলী সাহেব বিকালের ক্লাসগুলোর অধিকাংশই আমাকে দিয়ে দিতেন। তবে কাঁহাতক আর রসগল্প বলা যায়। ছাত্ররা বারবার রসগল্পের বায়না ধরলে বাধ্য হয়ে বলতে হতো— সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেব এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘ঘর-দোর পরিষ্কার করে স্রষ্টার কাছে সন্তান চাইলেই পাওয়া যায় না, তজ্জন্য বিয়ে-শাদি করে অন্তত দুশো সত্তর দিন অপেক্ষা করতে হয়।’ রসগল্পের বেলায়ও তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ততক্ষণে কিছু পড়াশোনা করে নাও।

অবশ্য ছাত্রছাত্রীদের কাছে রসগল্প বলাও ছিল রীতিমতো রিস্কি ব্যাপার। একবার দুপুরে এক বিয়ের আসরে ভূরিভোজন শেষে ক্লাসে এসে ছেলেদের দই-এর গল্প শুনিয়েছিলাম : গাঁয়ের এক বিয়েতে দাওয়াত না পাওয়াতে পেটুক বাপকে সাবালক ছেলেরা যেতে দেবে না; তাই বাপকে তারা বারান্দার খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। যথাসময়ে বাপ বিয়েবাড়িতে ভোজের রানিং কমেন্টারি দিতে শুরু করে দিলেন ও আস্তে আস্তে বাঁধন আলগা করতে লাগলেন। অবশেষে ভোজের সর্বশেষ আইটেম দই-এর উল্লেখপূর্বক সজোরে এই দই ছিলো রে বলেই তিনি বাঁধন ছিঁড়ে এক দৌড়ে বিয়েবাড়িতে গিয়ে উপস্থিত। তো এই গল্প বলার দিনকয়েক পরে কলেজ মাঠে বার্ষিক প্রফেসারস-বনাম-স্টুডেন্টস ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। আমি ব্যাট করতে নেমেছি। ছাত্রাবস্থায় একটু-আধটু ক্রিকেট খেলতাম আর ছাত্ররাও কেউ তেমন নামকরা ক্রিকেটার ছিল না বিধায় প্রত্যাশা ছিল যে অন্তত কয়েক রান করেই তবে ঘরে ফিরব। কিন্তু প্রথম বলে ব্যাট করতে উদ্যত হতেই পেছনের উইকেট-কিপার ছেলেটি ‘এই দই ছিল রে’ বলে চিৎকার করে উঠলে আমাকে ‘ডাক’ হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যেতে হয়েছিল।

আরেকদিন কলেজের আর্টস বিল্ডিংয়ের গ্যালারি রুমে ক্লাস নিচ্ছিলাম। ছেলেরা সবাই গ্যালারিতে ও ৪/৫টি মেয়ে আমার পাশে বেঞ্চিতে উপবিষ্ট। একটি ছেলেকে আমার লেকচারের চেয়ে মেয়েদের দিকে তাকানোয় অধিক মনোযোগী লক্ষ্য করে তাকে মৃদু তিরস্কারপূর্বক একটি গল্প বলেছিলাম : একটি ছোট্ট শহরে দুজন চোখের ডাক্তার প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছিলেন। প্র্যাকটিসটাকে একচেটিয়া করার উদ্দেশে ওঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন— দুজনের পর একটি দুরূহ অপারেশন করবেন; যিনি বিফলকাম হবেন তিনি অন্যত্র চলে যাবেন। তদনুযায়ী প্রথমে এক ডাক্তার একজন সুস্থ লোককে অজ্ঞান করে তার দুই চোখ উপড়িয়ে আবার যথাস্থানে সংযোজনের পর আশানুরূপ ফল পাওয়া গেল। কিন্তু দ্বিতীয়জনের বেলায় বিপত্তি ঘটল— তিনি আরেকজন লোককে অজ্ঞান করে দুই চোখ উপড়িয়ে টেবিলে রাখতেই এক কাক খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশ করে একটি চোখ নিয়ে উধাও। অগত্যা তিনি একটি ছাগল জবাই করে ছাগলের এক চোখ যথাস্থানে সংযোজন করে দিলে লোকটি জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর বলে উঠল, ‘সবই ঠিক আছে, ডাক্তার সাব; কিন্তু একটা চোখ কেন জানি বারবার কাঁঠাল পাতার দিকে চলে যায়।’

ছেলেরা অতঃপর বলাবলি করতে লাগল, ‘স্যারে আমরারে ছাগল বানাইলা’। আর কলেজের সহকর্মীদের মধ্যে একজনের কথা বলতেই হয়— ফিজিক্সের অধ্যাপক হাক্কানি সাহেব। তাঁর পিতা বোধকরি তার নাম রেখেছিলেন আবুল হোসেন, কিন্তু তিনি ফি-বছর নামের সামনে ও পেছনে নতুন শব্দ যোগ করাতে শেষতক সেটা দাঁড়িয়েছিল : কুদরতে রব্বানী শরফুল ইসলাম শাহ্ মোহাম্মদ আবুল আ’লা আবুল হোসেন আল-হাক্কানী আল্লাখান চৌধুরী এলিয়াছ এ.কে. বাকিংহাম। দুর্ভাগ্যবশত অবিবাহিত অবস্থায় মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি পটল তোলেন। তা নইলে শেষাব্দি তার নাম কদ্দুর গড়াত, সেটা ভেবে ভেবে আমি হয়রান হয়ে যেতাম।

সার্বিক বিবেচনায় এমসি কলেজে অধ্যাপনা অধ্যায় আমার জীবনের সুবর্ণ সময়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিধির লিখন অনুসারে একদিন আমাকে কলেজটি তথা অধ্যাপনা ছেড়ে চলে আসতে হলো। এক্ষণে এটা দেখে গর্ববোধ হয় যে, এমসি কলেজের আমার প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা জাতীয় জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত। উদাহরণস্বরূপ যেমন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ইংরেজির অধ্যাপক ও সুসাহিত্যিক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে. চৌধুরী ও সাবেক জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস সহিদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী।

উপাধ্যক্ষ আবদুস সহিদকে অবশ্য আমি মদন মোহন কলেজে পড়িয়েছি। তো একবার একটি সভায় আমি বক্তৃতা করার পর উপাধ্যক্ষ আবদুস সহিদ বক্তৃতা দিতে উঠে আমার প্রসঙ্গ টেনে বলেছিল, ‘স্যার আমাদের ইংরেজি পড়াতেন এবং তখন তিনি খুব সুদর্শন ছিলেন।’ পরবর্তীতে এই প্রসঙ্গ টেনে ভিন্ন সভায় আমি যে একটি রসগল্প বলে সবাইকে বিমল আনন্দের খোরাক জুগিয়েছিলাম, পরিশেষে সেটাই পরিবেশন করে এই নাতিদীর্ঘ নিবন্ধটির সমাপ্তি টানছি :

একজন লোককে বলা হয়েছিল, ‘আপনি খুব হ্যান্ডসাম (সুদর্শন)।’ তদুত্তরে তিনি বললেন, আমার বাবাও ছিলেন হ্যান্ডসাম, আমার দাদাও ছিলেন হ্যান্ডসাম। তখন তাকে বলা হলো, ‘আপনি খুব লার্নেড (বিদ্বান) ব্যক্তিও’। শুনে তিনি বললেন, ‘আমার বাবাও ছিলেন লার্নেড, আমার দাদাও ছিলেন লার্নেড। অতঃপর তাকে ‘আপনি তো ব্যাচেলর (অবিবাহিত)’ বলতেই তিনি বলে ওঠলেন, ‘আমার বাবাও ছিলেন ব্যাচেলর, আমার দাদাও ছিলেন ব্যাচেলর।’ হা-হা-হা!

লেখক : রম্য লেখক ও ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

 

সর্বশেষ খবর