রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্যাংকের অগ্রিম-আমানত হার নিয়ে দু-চার কথা

তপন কুমার ঘোষ

সঞ্চয়কারীদের জন্য সুখবর! ব্যাংকে আমানতের ওপর সুদের হার বেড়েছে। প্রায় সব ব্যাংকই বাড়িয়েছে সুদের হার। এক বছর মেয়াদি আমানতের ওপর সুদের হার ইতিমধ্যে দুই অঙ্কের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বিগত কয়েক বছর আমানতের সুদহার ছিল নেতিবাচক অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির হারের চেয়েও কম। রক্তজল করা সঞ্চয় ব্যাংকে জমা রেখে যে লাভ পাওয়া যেত সেই লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলত। আমানতের সুদহার বাড়ায় আমানতকারীরা এখন খুশি।

কিন্তু সুদহার বৃদ্ধির খবরে স্বস্তিতে নেই ব্যবসায়ীরা। আমানতের সুদহার বৃদ্ধির ফলে বেড়েছে ঋণের সুদহার। ব্যাংক ঋণের সুদহার ফের দুই অঙ্কে। অনেক বেসরকারি ব্যাংকের ঋণের সুদহার এখন গড়ে ১৩ শতাংশের ওপরে বলে জানা যায়। ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই বলে আসছেন, দুই অঙ্কের সুদে ঋণ নিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন। কাজেই ব্যবসায়ীদের জন্য এটা দুঃসংবাদই বলতে হবে।

হঠাৎ করে ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থের টান পড়েছে। এর কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করছেন ব্যাংকাররা। অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, ব্যাংকের আমানতের বিপরীতে অগ্রিম বিতরণের সীমা (এডি রেশিও) কমিয়ে দেওয়া। এ ছাড়া গেল বছর আমানত বৃদ্ধির তুলনায় ঋণ বিতরণ বেশি হয়েছে। মূলত, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। এ ছাড়া রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের তুলনায় যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি হওয়ায় ডলারের দাম বেড়েছে। বাড়তি চাহিদার কারণে নগদ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রায় ১৫০ কোটি ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছে।

তারল্য সমস্যার শুরু গত ডিসেম্বর থেকে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়লেও সে হারে আমানত বাড়ছে না। বাজারে নতুন আমানত কম। তাই সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহের জন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন ডিপার্টমেন্ট থেকে সার্কুলার জারি করে ব্যাংকের অগ্রিম-আমানত হার (এডি রেশিও) কমানো হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৮৩.৫ টাকা অগ্রিম দিতে পারবে, আগে যা ছিল ৮৫ টাকা। ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকগুলো আমানতের সর্বোচ্চ ৮৯ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারবে, আগে যা ছিল ৯০ শতাংশ। যে সব ব্যাংকের এডি রেশিও সংশোধিত মাত্রার বেশি তাদের এডি রেশিও নতুন সীমার মধ্যে নামিয়ে আনার জন্য আগামী জুন মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটারি পলিসি ডিপার্টমেন্টের সার্কুলার অনুসারে বাংলাদেশে অনুমতিপ্রাপ্ত সব তফসিলি ব্যাংককে তাদের মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের সাড়ে ছয় শতাংশ দ্বিসাপ্তাহিক গড় ভিত্তিতে (ন্যূনতম ছয় শতাংশ দৈনিক ভিত্তিতে) বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা রাখতে হয়। এটাকে বলা হয় ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সংক্ষেপে সিআরআর। এ অর্থের ওপর কোনো সুদ পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বাংলাদেশে সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ হিসেবে মোট তলবি ও মেয়াদি দায়ের ১৩ শতাংশ সংরক্ষণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এটাকে বলা হয় স্ট্যাটিউটরি লিকুইডিটি রেশিও বা সংক্ষেপে এসএলআর। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডকে ছাড় দেওয়া আছে। এসএলআর হিসেবে মূলত ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করে থাকে। ইসলামী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে এসএলআর সাড়ে পাঁচ শতাংশ। বাজারে ইসলামী বিনিয়োগ বন্ড আছে। নির্ধারিত হারে সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে ঘাটতি অর্থের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক দণ্ডসুদ ও জরিমানা আরোপ করে থাকে। ব্যাংকের মোট দায় (শুধু আমানত দায় নয়) থেকে সিআরআর ও এসএলআর বাদ দিলে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল দাঁড়ায় ৮০.৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় বাংকের নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো ব্যাংক মূলধন ভিত্তি, তারল্য পরিস্থিতি, আন্তঃব্যাংক নির্ভরশীলতা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বিবেচনায় রেখে আমানতের সর্বোচ্চ ৮৩.৫ শতাংশ অগ্রিম দিতে পারবে।

খবরে প্রকাশ, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চারটি ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। মানসম্পন্ন ঋণ নিশ্চিত করতে এসব ব্যাংক ভেবেচিন্তে ঋণ দিচ্ছে। তাই অগ্রিম-আমানত হার অনেক কম। এই ব্যাংকগুলো এখন সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বিধিবদ্ধ তারল্য সংরক্ষণের (এসএলআর) জন্য সরকার অনুমোদিত সিকিউরিটিজে ন্যূনতম যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সরকারি সিকিউরিটিজে তার অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করা হলে ওই পরিমাণ অর্থকে উদ্বৃত্ত তারল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চায়, ব্যাংকগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোদ্যোগ ও কৃষি খাতে ঋণ বৃদ্ধি করুক। কিন্তু তা না করে নিম্নসুদহারে সরকারি সিকিউরিটিজে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করে ঝুঁকিমুক্ত অবস্থানে থাকা ব্যাংকের মূল কাজ নয় বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে। অবশ্য, এ বিষয়ে ব্যাংকারদেরও জবাব আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয় সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ব্যাংক খাতে কোনো তারল্য সমস্যা নেই। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সংকট তৈরি হবে না বলে তিনি আশ্বস্ত করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সাতান্নটি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে আটত্রিশটি ব্যাংকের অগ্রিম-আমানত অনুপাত নতুন সীমার মধ্যেই আছে। কিছু বেসরকারি ব্যাংক আগ্রাসী হয়ে মাত্রাতিরিক্ত অগ্রিম প্রদান করায় ঋণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লাগাম টেনে ধরার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত, তারল্য সংকট না থাকলেও সমস্যা যে আছে, হঠাৎ করে আমানতের সুদহার বৃদ্ধির ঘটনা তারই ইঙ্গিতবহ। তবে অভিজ্ঞ ব্যাংকাররাও মনে করেন, ব্যাংক খাতে সাময়িক একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। জুন মাসের পর এই চিত্র বদলে যেতে পারে। ব্যাংকের সম্পদ-দায় ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হচ্ছে তারল্য ব্যবস্থাপনা। এ কাজে আমাদের ব্যাংকগুলোর দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যাবে আগামী মাসগুলোতে।

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি), জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর