সোমবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

মোদি ঠিক কথা বলেননি

সুখরঞ্জন দাশ

মোদি ঠিক কথা বলেননি

সদ্য সমাপ্ত ভারতের সংসদের উভয় কক্ষ অধিবেশনে ভারত কী পেল, তার পর্যালোচনা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। ইতিহাসের ছাত্র, অধ্যাপক এবং গবেষকরা সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনে তাকে সতর্ক করে দিয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা মনে করিয়ে দিয়ে তারা তাকে সচেতন করে বলেছেন, আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, কিন্তু দেশের ইতিহাস সম্পর্কে আপনার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। ইতিহাস সম্পর্কে আপনার এত স্বল্প জ্ঞান জাহির করতে গিয়ে ভুলভাল বলছেন। ইতিহাসবিদরা বলেছেন, ‘আপনি বলেছেন জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতা সংগ্রাম করেননি; এবং তিনি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতে দেননি।’ তার এই ঐতিহাসিক অসত্য কথার জবাব দিয়েছেন রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা গুলাম নবি আজাদ। তিনি ’৪৭ সালের কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত তুলে ধরে বলেছেন, নেহরুকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলই দিয়েছিলেন। আর তা সমর্থন করেন ওয়ার্কিং কমিটির আরেক সদস্য মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং স্বয়ং গান্ধীজি। ভারতবর্ষের জনগণ এই অসত্য, অনৈতিক এবং ইতিহাসকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা মানবে না। সংসদের ভাষণে গণতন্ত্র সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে মোদি কংগ্রেস দল তথা স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রসঙ্গ টেনে জওহরলাল নেহরু ও কংগ্রেসের প্রতি বিষোদগার করেছিলেন। ইতিহাসবিদদের পাশাপাশি প্রতিবাদ জানিয়েছেন কংগ্রেস তথা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সাংসদরাও। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীসহ বিরোধীরা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার সময় এবং আগামী ২০২০ সালে কী হতে চলেছে তা নিয়ে অনেক কথা বললেন। কিন্তু বর্তমানে কী চলছে তা নিয়ে একটা প্রশ্নেরও ধারকাছ দিয়ে গেলেন না। রাফাল বিমান নিয়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে যে প্রশ্ন উঠেছে, জিএসটি চালু করায় দেশের মানুষের ওপর যে সর্বনাশ নেমে এসেছে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোসহ গোটা ভারতে যে লাগাতার কৃষক আত্মহত্যা হয়েছে, গোরক্ষার নামে একের পর এক সংখ্যালঘু ও দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের ওপরে প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে, মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীদের কতল করা হয়েছে, হঠাৎ পুরনো নোট এক ধাক্কায় বাতিল করে দিয়ে মধ্যবিত্ত এবং সাধারণ গরিব মানুষ দিনের পর দিন হয়রান হয়েছে— সে ব্যাপারে একটা কথাও সেদিন মোদির মুখে শোনা যায়নি।

সিপিএম সাংসদ মুহাম্মদ সেলিম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ইতিহাসের ভ্রান্ত, মনগড়া একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য আশার বাণী শুনিয়েছেন। কিন্তু দেশবাসী তার ওপর একের পর এক প্রতারণায় ক্লান্ত। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী নিজেও জানেন যে, লোকে আর তাকে বিশ্বাস করছেন না। সে কারণেই তিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ ছেড়ে অবান্তর কথাবার্তা বলেছেন। এর পাশাপাশি রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে বিপুল টাকা কাট মানির হাতবদলের অভিযোগ এনেছেন রাহুল গান্ধী। তার স্পষ্ট বক্তব্য— রাফাল বিমান নিয়ে সব তথ্য সামনে প্রকাশ করতে হবে মোদিকে। কারণ, প্রথমে রাফাল বিমানের জন্য যে দাম ধার্য করা হয়েছিল, এখন তার থেকে অনেক বেশি দাম ভারতকে দিতে হচ্ছে। এই কথা এখন আর গোপন নেই। ভারতের প্রতিটি মানুষ তা জানে। আর এই বর্ধিত দামের বোঝা চাপছে সাধারণ মানুষের ওপর। তাই তাদের এ ব্যাপারে জানার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে।

প্রসঙ্গত, প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতা রামন এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, এটা জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। তাই এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংসদে দেওয়া যাবে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, রাফাল বিমান নিয়ে ভারত ও ফ্রান্সের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তাতেই এই গোপনীয়তার কথা রয়েছে। রাহুল গান্ধীসহ বিরোধীরা বলেছেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্য আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এই লেনদেনের মধ্যেই রাফাল বিমানের দাম এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গেছে। ফলে সরকারকে এই চুক্তির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংসদের সামনে পেশ করতে হবে। বস্তুত, রাহুল গান্ধীসহ কংগ্রেস নেতারা শুক্রবারও রাফাল চুক্তির সর্বশেষ অবস্থান প্রকাশ করার দাবি জানান।

৩৫ বছর আগে সুইডেনের বোফর্স কোম্পানি থেকে যে কামান কেনা হয়েছিল সে সময় অভিযোগ উঠেছিল, ওই কোম্পানি থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ৫০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। কিন্তু তার তদন্ত করতে গিয়ে সিবিআইসহ কেন্দ্রের সব গোয়েন্দা সংস্থা দিল্লি থেকে সুইডেন, লন্ডন ঘুরেছেন। দিল্লি হাই কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট এই অভিযোগের কোনো সারবত্তা নেই বলে খারিজ করে দিয়েছে। ৩৫ বছর পর আবার সিবিআইকে দিয়ে নতুন মামলা রুজু করতে চলেছেন মোদি। মোদির অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণু গোপাল প্রকাশ্যেই বলেছেন, বোফর্স কাণ্ডে রাজীব গান্ধীকে দোষী প্রমাণ করার মতো কোনো নথিপত্র আমাদের কাছে নেই। তাই নতুন করে মামলা করারও প্রয়োজন নেই। অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন একদিন একান্তে পেয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, রাজীব গান্ধী কত টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন? বাজপেয়ি তার চিরাচরিত কায়দায় মাথা নেড়ে বলেছিলেন, ‘ম্যায়নে ফাইল দেখা। কুছ নেহি হ্যায়।’ পরে তিনি বলেছিলেন, এটা ছিল ভি পি সিংয়ের ব্যক্তিগত ঈর্ষা এবং জেদ। প্রসঙ্গত, রাজীব গান্ধীর পরে কয়েক মাসের জন্য প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ভি পি সিং। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তিনি নতুন দল গঠন করেছিলেন। সুতরাং বর্তমানে মোদি ও তার দলবল বোফর্স নিয়ে চিৎকার করছেন, তার একটাই কারণ। আর তা হলো তার নিজের রাফাল কেলেঙ্কারি চাপা দেওয়া। কারণ বিরোধীরা ‘রাফাল’ নিয়ে যত বিক্ষোভ করবে ততই নরেন্দ্র মোদিদের ২০১৯ সালে নির্বাচনের ময়দান আরও কঠিন হতে থাকবে।

ইতিহাসবিদদের আরও হুঁশিয়ারি— ইতিহাস বিকৃত করলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। এটাই নিয়ম। মোদিজিকে এটা স্মরণ রেখেই বাকি কয়েক মাস দেশ চালাতে হবে। নির্বাচনী বৈতরণী মিথ্যা দিয়ে পার হওয়া যাবে না। বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন, মোদির জনধন যোজনার টাকা যাদের দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তারা কি সব গেরুয়া বাহিনীর লোক? ‘মোদিজি ভুলে গেছেন, ’৪৭ সালে বিজেপি বা জনসংঘের জন্ম হয়নি।  সুতরাং তিনি কী করে ১৩০ বছরের পার্টির আদ্যশ্রাদ্ধ করে চলেছেন! আর সর্দার প্যাটেলের জন্য তার কুম্ভীরাশ্রুর কারণ কী, তিনি গুজরাটের লোক বলে? সর্দার প্যাটেল তো আদ্যোপান্ত কংগ্রেসের নেতাই ছিলেন।

লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর