বৃহস্পতিবার, ১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

আমরাও অন্ধকারে ফিরতে চাই না

তুষার কণা খোন্দকার

আমরাও অন্ধকারে ফিরতে চাই না

বাংলাদেশের বয়স ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। মানুষের জীবনে ৫০ বছর অনেক লম্বা সময় কিন্তু একটি দেশের জন্য ৫০ বছর এমন কিছু বেশি সময় নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একটি জাতির থিতু হতে এটুকুু সময় কেটে যায়। তবে ভাঙা-গড়ার সময়টায় মানুষ একটি বিষয়ে আশ্বস্ত হতে চায়। তারা মনে করে গন্তব্য দূরে হলে অসুবিধা নেই যদি পথের নিশানা সঠিক হয়। জাতি সঠিক দিকনির্দেশনায় সঠিক পথে এগোচ্ছে। সেক্ষেত্রে চড়াই উতরাই নিয়ে মানুষ মাথা ঘামায় না। টুকটাক হোঁচট খেয়েও মনের বল ঠিক রাখে। মানুষ দেখে, তাদের রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব কলুষমুক্ত। কাজেই তাদের মনের মধ্যে ভয় দানা বাঁধে না। কিন্তু দেশের রাজনীতির দিকনিশানা যখন ঘোলাটে হয়ে যায়, বুদ্ধিজীবীরা যখন কাঠের পুতুলের মতো মাথা দোলায় তখন সাধারণ মানুষ চোখে আঁধার দেখে।

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষ স্বস্তিতে নেই। জনমনে এখন যে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে সেটা দূর করার আন্তরিকতা কোথাও চোখে পড়ছে না। কিন্তু আমরা জানি, জনমনের অস্বস্তিকে হেলা করার পরিণাম দেশের জন্য কখনো শুভফল বয়ে আনে না। দেশের অর্থনীতি যথেষ্ট সবল, দেশের মানুষ খেয়েপরে ভালো আছে এটাও সত্য। কিন্তু সামনের দিনগুলেতে কখন কী ঘটবে এ দুশ্চিন্তা মানুষের মন থেকে সরছে না। অর্থাৎ জনমনে অস্বস্তির কাঁটা সারাক্ষণ খচখচ করছে। দেশে গণতন্ত্র চর্চার ভবিষ্যৎ কী এ বিষয়ে কোনো মানুষ সুনিশ্চিত নয়। বর্তমান সরকার দেশ ভালো চালাচ্ছে নাকি মন্দ চালাচ্ছে এটি একটি তাত্ক্ষণিক বিচার্য বিষয় কিন্তু দেশে গণতন্ত্র চর্চা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল কি পেল না সেটার উপরে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা বিএনপিকে গালাগালি দেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত। ইদানীং তাদের গালাগালির সঙ্গে দামি উপদেশ যুক্ত হয়েছে। সেসব বাক্যে বলা হচ্ছে বিএনপি অমুক পদক্ষেপ নিলে দলটি বাঁচবে, না হলে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। এটি সত্যি মূল্যবান। আওয়ামী লীগ যদি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে বিএনপির মতো জনভিত্তিসম্পন্ন বড় একটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব টিকে থাকা দেশের স্বার্থে প্রয়োজন তাহলে এমন সুস্থ পথে চিন্তা করার জন্য আমি আওয়ামী লীগকে সাধুবাদ জানাব। আওয়ামী লীগের নেতারা মুখে এ কথা বললেও বাস্তবে তারা যেসব আচরণ করছে সেটি মোটেও সুস্থ ধারায় রাজনীতি চর্চার অনুকূলে যায় না। পুলিশ বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে বিএনপির মিছিল মিটিং পণ্ড করা, তাদের নেতা-কর্মীদের নামে অনর্গল মামলা রুজু করা গণতন্ত্র চর্চার পথে গুরুতর বাধা।

একের পর এক ভুলের পাকে আটকে গিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি রীতিমতো খাবি খাচ্ছে। কবে তারা এ পরিস্থিতি থেকে উতরাতে পারবে সে সম্পর্কে তারা নিজেরাও তেমন কিছু জানে বলে মনে হয় না। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দুর্দশা কি আওয়ামী লীগের জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে বলে কেউ বিশ্বাস করে? বিএনপির দুর্দশা দেখে আওয়ামী লীগ দারুণ আহ্লাদিত। ভাবছে, ওরা নিঃশেষ হলে আমরা আরামছে অনন্তকাল রাজত্ব করতে পারব। বিএনপির চ্যালেঞ্জ না থাকলে আওয়ামী লীগের গদি উল্টানোর আশঙ্কা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। তারপর, রূপকথার গল্পের উপসংহারের মতো অতঃপর রাজা সুখে রাজত্ব করিতে লাগিল। আওয়ামী লীগকে কোনোদিন কোনো কাজের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের গায়ে সেঁটে থাকা আঠালু ইনু মেনন বাহিনী যে ভাবনা ভাবছে তার সঙ্গে কি দেশের সাধারণ মানুষ সুর মেলাতে পারছে? বিএনপির দুর্দশাকে জনগণ আওয়ামী লীগের মতো আহ্লাদিত চোখে দেখছে না। কারণ বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র চায়। নির্বাচনের সময় সে কাকে ভোট দেবে সেটি তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। গণতন্ত্র চর্চার জন্য রাজনীতির মাঠে একাধিক শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি অপরিহার্য। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির অপমৃত্যু হলে গণতন্ত্র বেঁচে থাকবে কিনা সেটা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, আমরা আর অন্ধকারে ফিরে যেতে চাই না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রতিধ্বনি তুলে আমি বলছি, আমরা অন্ধকারকে ভয় পাই। সে জন্য খুব দ্রুত আমরা আলোতে ফিরে যেতে চাই। অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চার নিশ্চয়তা চাই। ঘরের পাশে ভারত তার জন্মের পর থেকে একদিনের জন্য গণতন্ত্র চর্চার পথ থেকে সরে আসেনি। অব্যাহত গণতন্ত্র চর্চার কারণে বিজেপির মতো ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক দল ভারতের ক্ষমতায় এসেছে এটি যেমন সত্য তেমনি ওই দেশে গণতন্ত্রের উপস্থিতির কারণে বিজেপি তার সাম্প্রদায়িক নখদাঁত পুরোপুরি বের করতে পারছে না। গণতান্ত্রিক ভারতে যে কোনো ক্ষমতাসীন দল বিরোধী মতকে অস্বীকার করে দেশ চালাতে পারে না। কাজেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারবিরোধী মতামতকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই গ্রহণ করে। ওখানে ক্ষমতাসীন দল জানে তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাঁচ বছরের বৃত্তে বাঁধা। সরকারের মেয়াদ শেষ হলে আর একবার ক্ষমতায় আসার জন্য নির্বাচনের মাঠে তাদেরকে বিরোধী দলের সঙ্গে এক সমতলে দাঁড়িয়ে খেলতে হবে। জনগণ চাইলে ক্ষমতাসীন দল আবার ক্ষমতায় আসবে, জনগণ না চাইলে তাদের দিল্লির মসনদ ছেড়ে মাঠে ফিরে যেতে হবে। পেছন দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আসার কোনো দরজা ভারতে খোলা নেই।

নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্র চর্চার প্রসঙ্গ এলে আমি ইসরায়েলের প্রসঙ্গ না তুলে পারি না। ইসরায়েল দেশটি জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত অনর্গল যুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের চারপাশে প্রতিটি দেশই তার শত্রু দেশ। শত্রুবেষ্টিত দেশ ইসরায়েল অবিরাম বৈরিতার মধ্যে এত বছর টিকে আছে কোন শক্তির বলে? আমেরিকা এবং ইউরোপ ইসরায়েলের বন্ধু বলেই কি ইসরায়েল শক্তিশালী? এ কথা কীভাবে মানা সম্ভব! এক ইরান ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশই আমেরিকা এবং ইউরোপকে জানি জিগির দোস্ত বলে মনে করে। সব কটা দেশের রাজা বাদশা তাদের জন্মলগ্ন থেকে আমেরিকা ইউরোপের পায়ের তলে মাথা পেতে দিয়ে আছে। মাটির তলা থেকে তেল তুলে বিক্রি করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজা বাদশারা সব পেট্রো ডলার ইউরোপ-আমেরিকায় জড়ো করেছে। ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে এত দোস্তির পরও ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে রাজা বাদশাদের সম্মিলিত শক্তি ইসরায়েলের এক ফুয়ে উড়ে যায় কেন? গবেষকরা যুদ্ধমান পক্ষগুলোর রণকৌশল চুলচেরা বিশ্লেষণ করে অনেক যুক্তি দেখাতে পারবেন। কিন্তু আমার মতো সাধারণ মানুষ অনুমান করে, ইসরায়েল গণতান্ত্রিক দেশ। জন্মের পর থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্র একদিনের জন্য গণতন্ত্র চর্চার পথ থেকে সরে আসেনি। ১৯৬৭ সালে মিসর ইসরায়েল যুদ্ধ চলাকালীন গোল্ডামায়ারের মতো লৌহমানবী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পর্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব এসেছে। কাজেই ইসরায়েল যখন যুদ্ধ করে তখন যুদ্ধটি তার দেশের জনগণের যুদ্ধ। কারণ ইসরায়েলের সরকার সে দেশের জনগণের নির্বাচিত সরকার। অন্য পক্ষে ইসরায়েলের শত্রু আরবীয় দেশগুলো যখন যুদ্ধ করে সেই যুদ্ধ সে দেশের রাজার অথবা স্বৈর শাসকের। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল ছাড়া আর কোনো দেশে গণতন্ত্র চর্চার সংস্কৃতি নেই। আরবীয় দেশগুলোতে হয় কোনো বাদশার রাজত্ব নয় কোনো স্বৈরশাসক বাদশার বড় বাদশা হয়ে বসে আছে। আমার মনে হয়, ইসরায়েল যদি নিরবচ্ছিন্ন গণতন্ত্রের চর্চা না করত তাহলে ইসরায়েল নামের দেশটি বহু আগে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যেত।

পাকিস্তান আমলে আমরা গণতন্ত্র চেয়েছিলাম। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো দাবি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উত্থাপন করেনি। পাকিস্তানি শাসকরা গণতন্ত্র চর্চা করতে জানলে একাত্তরের যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্ম হতো না, আমরাও বাংলাদেশের জন্ম দিতাম না। ছয় দফা এগারো দফায় পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের দাবি অত্যন্ত জোরালো ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্ম হয়েছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চা করার জন্য। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চাকে বন্ধ করে যখন বাকশাল গঠন করলেন তখনই মানুষ হোঁচট খেয়েছিল। গণতন্ত্র চর্চার সুস্থ ধারা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় মানুষের মধ্যে অস্বস্তির জন্ম হয়েছিল। বাকশাল বিনে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া এবং সংবাদপত্র প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতি ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে একের পর এক সামরিক শাসন দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার পরে আশির দশকে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার পথ সুগম হলে বাকশালের খোলস কেটে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে নতুন করে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু দেশে গণতন্ত্র সংহত রূপ পেতে আরও অনেক বছর কেটে গেছে। এরশাদের স্বৈরশাসনের হাত থেকে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে হাসিনা-খালেদা দুই নেত্রীকে কম বেগ পেতে হয়নি। আন্দোলন করতে গিয়ে সেলিম-দেলোয়ার-ডাক্তার মিলন-জিহাদ অনেক তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। আমরা এ ধরনের অন্ধকারের প্রত্যাবর্তন চাই না। আমরা আশা করি, বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগ পরিচয়ে বেঁচে থাকুক। দেশে সব দলের অংশগ্রহণে নিয়মিত সুষ্ঠু স্বাভাবিক নির্বাচন হোক। দেশের মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে আওয়ামী লীগ অনন্তকাল দেশ শাসন করুক তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। আমাদের পড়শি দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর সিপিআইএম জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে একনাগাড়ে ২৮ বছর রাজত্ব করেছে। বেশিদিন ক্ষমতায় থাকলে জনগণ তাদের পছন্দ করে না এমন মনগড়া ধারণা থেকে শাসক দল একদলীয় শাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। আসলে এমন ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। মানুস সুশাসন চায়। আওয়ামী লীগ দেশকে সুশাসন দিলে আওয়ামী লীগ বারবার ক্ষমতায় আসবে এটা আমরা বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাস থেকেই বলছি, বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত রাখুন। তাহলে আওয়ামী লীগ বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। আগামীতে দেশে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে জনমনে এ আস্থা ফিরে আসা খুব জরুরি।

            লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর