শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

জীবনযুদ্ধের রঙ্গমঞ্চে প্রকৃতির রসায়ন!

গোলাম মাওলা রনি

জীবনযুদ্ধের রঙ্গমঞ্চে প্রকৃতির রসায়ন!

ভিনসেন্ট ভ্যানগগের জীবনের একটি নির্মম এবং করুণ ঘটনা দিয়ে আজকের নিবন্ধ শুরু করতে চাই। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন, বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই মেধাবী চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবিগুলোই বর্তমান জমানার সবচেয়ে দামি চিত্রকলা। তার একেকটি ছবির বাণিজ্যিক মূল্য প্রায় সাড়ে আটশত কোটি টাকা। অথচ জীবদ্দশায় অর্থাভাবে তিনি প্রায়ই অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে জীবন কাটাতেন।  পার্থিব জীবনের দুর্বিষহ যাতনা, সর্বমহলের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং নিজের শারীরিক অসুস্থতা ও কুৎসিত চেহারায় অভিমান করে তিনি একবার নিজ হাতে নিজের কান কেটে ফেলেছিলেন। তার দরিদ্রতা ও বিদঘুটে চেহারার জন্য কোনো পতিতাও তার সঙ্গে সময় কাটাতে চাইত না। এ কারণে তিনি বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টার পর শেষবারে গিয়ে সফল হন।

জীবনের একপর্যায়ে ভ্যানগগ হঠাৎ করেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। জনৈক চিকিৎক দয়া পরবশ হয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। কৃতজ্ঞ ভ্যানগগ চিকিৎককে উৎর্গ করে একটি ছবি আঁকেন। তিনি যখন ছবিটি চিকিৎককে উপহার দেন তখন একটি বিদঘুটে লোকের অঙ্কিত ততধিক বিদঘুটে ছবিটি তিনি ভদ্রতা করে গ্রহণ করেন বটে তবে ভ্যানগগ বিদায় হওয়ার পর সেটি তাচ্ছিল্যভরে পাঠিয়ে দেন পুরনো জিনিসপত্র রাখার ভাগাড়ে। এ ঘটনার বহু বছর পর সেই চিকিৎকের পরবর্তী বংশধররা ছবিটি খুঁজে পান এবং আন্তর্জাতিক নিলামে তা সর্বকালের রেকর্ড চড়া দামে বিক্রি করতে সমর্থ হন।

ফ্রান্সে জন্ম নেওয়া চিত্রশিল্পী ভ্যানগগ মারা যান ১৮৯০ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে। তার মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতাব্দী পর তার চিত্রকর্মের কদর বেড়ে যায় এবং ১৯৭০ সালের পর তা রীতিমতো বিশ্ববাজারে হৈচৈ ফেলে দেয়। আজ এত বছর পর হঠাৎ করে আমার মনে ভ্যানগগের প্রসঙ্গ উদয় হলো বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে তথাকথিত বিরোধী দলের চেয়ারে বসা বেগম রওশন এরশাদের একটি খেদোক্তি শোনার পর। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি এক নজিরবিহীন প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলেন। তার দেওয়া সেই বক্তব্য দেশের সব পত্রপত্রিকা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপিয়েছে। অথচ বিগত চারটি বছর কিংবা তার পূর্বেকার ৩৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কোনো পত্রপত্রিকা বেগম রওশন এরশাদের বক্তব্য এতটা গুরুত্ব দিয়ে ছাপেনি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে তার বক্তব্য শোনার পর কেন আমার ভ্যানগগের কথা মনে এলো, সেটা বলে নিই। দেশের চলমান রাজনীতির প্রকাশ্য এবং নেপথ্যের খেলাধুলা এবং বহুমুখী সমীকরণ নিয়ে কয়েক দিন যাবৎ চিন্তা করছিলাম। বেগম জিয়ার কারাদণ্ড, জামিন নিয়ে নানামুখী তৎপরতা, গুজব, আগামী সংসদ নির্বাচন, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির একটি সাধারণ সমীকরণ করার জন্য সাধ্যমতো চিন্তাভাবনা করছিলাম। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যখন হিসাব মেলাতে পারছিলাম না, তখন হঠাৎ করেই প্রকৃতির কিছু অদ্ভুত খেয়াল এবং জীবজগতের ঐশ্বরিক রসায়ন, সমীকরণ ও পরিণতির কথা চিন্তায় চলে এলো। আমাদের প্রকৃতি অনাদিকাল থেকে ভূপৃষ্ঠের নরম কাদামাটি এবং উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর পচা জীবাশ্ম আপন কুদরতে ভূ-অভ্যন্তরের শত শত মাইল গভীরে ঢুকিয়ে দিয়ে যেগুলোর রূপান্তর ঘটায় এবং নির্দিষ্ট সময় পর সেগুলো থেকে সোনা, রুপা, হীরা, জহরৎ ইত্যাদির পাশাপাশি কয়লা, আলকাতরা, জিংক, জিপসাম ইত্যাদি বানিয়ে ফেলে!

প্রকৃতির অপার খেলায় কাদামাটি পরিণত হয় নুড়ি পাথরে। আবার সেসব নুড়ি পাথর পৃথিবীর পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং মাটির চাপও তাপে জ্বলন্ত লাভায় পরিণত হয়ে পাহাড় ফুটো করে পৃথিবীকে প্লাবিত করে দেয়। প্রকৃতির ইচ্ছায় শস্য-শ্যামলা নদীমাতৃক ভূখণ্ড পরিণত হয়ে যায় ঊষর মরুভূমিতে। আবার শত শত মাইলব্যাপী বিস্তৃত মরুভূমির মাঝে পানির ঝরনাধারা সৃষ্টি করে সেখানে গড়ে তোলা হয় বিস্ময়কর মরূদ্যান। প্রকৃতির দয়ায় বিরানভূমিতে গড়ে ওঠে মহাকালের বিস্ময়কর সব সভ্যতা। আবার কালের বিবর্তনে সেসব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে ধূলি ধূসরিত স্তূপ কিংবা নিহায়েত ইতিহাস হয়ে আমাদের অদ্ভুতভাবে নাড়া দিয়ে কি যেন শেখাতে চায়। গতকালের মহারাজা আজকের দিনে যেরূপ ভিখারির বেশে মানুষের দয়া ও করুণার পাত্রে পরিণত হচ্ছে তেমনি আজকের মহারাজার নিয়তি আগামীকাল কোথায় এবং কীরূপে দৃশ্যায়িত হবে তার রসায়ন ও সমীকরণ মানুষের মন-মস্তিষ্ক সব সময় কল্পনা করতে পারে না। মানুষ যখন তার পরিণতি কল্পনা করতে পারে না এবং কেন পারে না— এসব বিষয় নিয়ে যখন আমার চিন্তার স্তর খুব নাক ঘামাচ্ছিল, ঠিক তখনই বেগম রওশন এরশাদের বক্তব্য আমার চিন্তার স্রোতকে ক্ষণিকের তরে থামিয়ে দিল।

বাংলাদেশের আরও অনেক লোকজনের মতো আমারও কেন জানি বেগম রওশন এরশাদের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ নেই। যদিও তার স্বামী হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি আমার এক ধরনের ব্যক্তিগত দুর্বলতা এবং আকর্ষণ ও শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। জনাব এরশাদের উত্থান ও পতনের পেছনে তার স্ত্রী রওশনের কতটুকু ভূমিকা রয়েছে তা হয়তো তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ, গৃহদাহ এবং নজিরবিহীন নানা ঘটনা ও দুর্ঘটনার জন্য দেশবাসী জনাবা রওশনকেই এককভাবে দায়ী মনে করেন। জাতীয় সংসদে তথাকথিত বিরোধীদলীয় নেতার আসন অলঙ্করণ এবং গত চার বছরের জগাখিচুড়ি  মার্কা রাজনীতির  কারণে এরশাদ এবং তার জাতীয় পার্টি দেশবাসীর কাছে কতটা হাস্যকর অবস্থায় পৌঁছেছে তা জাতীয় পার্টি সংশ্লিষ্ট সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেলেও লোকজন মনে করতেন, বেগম রওশন এরশাদ এবং তার অনুসারীরা হয়তো বিষয়টি কেয়ার করেন না। সেই তিনি হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই এমন বক্তব্য দিলেন যা দেশবাসীর চিন্তা ও চেতনাকে এক লাফে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরিয়ে দিল।

বেগম রওশন এরশাদ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বীরদর্পে বললেন—মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে নিয়ে জাতীয় পার্টিকে বাঁচান। কারণ জাতীয় পার্টি বিগত চারটি বছর ধরে পরিচয় সংকটের কবলে পড়ে বিলীন হওয়ার পূর্বক্ষণে অস্তিত্বের লড়াই করছে। দেশ-বিদেশের লোকজনের কাছে তারা হাস্যকর উপাদানে পরিণত হয়েছে। তাদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ নিয়ে লোকজন নানা কিসিমের প্যারোডি তৈরি করে। তারা যখন নিজেদের বিরোধী দলের লোকজন বলে পরিচয় দেয় তখন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা মুখ টিপে হাসে। কেউ কেউ অবমাননাকর ও অস্বস্তিকর প্রশ্ন করে তাদের বিব্রত করে তোলে।  লজ্জায় তারা অবাধে সাংবাদিক, সুধী সমাজ ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে খোলামেলা করতে পারে না। তাদের দলের যেসব লোককে সরকারি দল মন্ত্রী বানিয়েছে সেসব লোক কি বর্তমানে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আছেন নাকি তারা সরকার ও সরকারি দলে একাত্ম হয়ে গেছেন তা নিয়ে জনমনের নানান প্রশ্ন বেগম রওশন এরশাদকেও প্রভাবিত  করেছে। তাই তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতীয় পার্টির প্রাণ বাঁচানোর জন্য আবেদন করেছেন অভিনব এক আবদারের মাধ্যমে। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি মন্ত্রিসভা থেকে আমাদের দলের সদস্যদের প্রত্যাহার করুন অথবা আমাদের দলের বাদ বাকি সব এমপিকে মন্ত্রী বানিয়ে আমাদের সরকারি দলে অন্তর্ভুক্ত করে নিন।

বেগম রওশন এরশাদ এমন একটি সময়ে উপরোক্ত বক্তব্য দিলেন যখন পুরো দেশ নানা অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে হিমশিম খেতে খেতে সংকটাপন্ন সময় পার করছে। বিএনপি নেত্রীর কারাবাস, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা বা না করা, বিএনপি ভাঙার নানামুখী গুজব। বেগম জিয়ার জামিন হওয়া বা না হওয়া, সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী বহুমুখী রাজনৈতিক সমীকরণ ইত্যাদি নিয়ে যখন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা গলদঘর্ম হচ্ছেন ঠিক তখন বেগম রওশন এরশাদের উপরোক্ত বক্তব্য নতুন গুঞ্জনের জন্ম দিচ্ছে। কেউ কেউ সন্দেহ করছেন তিনি হয়তো সরকারের প্রভাবশালী মহলের গ্রিন সিগন্যাল, অথবা প্রেসক্রিপশনে উল্লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন। কারণ যে কথাটি বলানোর জন্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গত চারটি বছর প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন সে কথাটি কোনো কারণ ছাড়াই তিনি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে সাক্ষী রেখে বীরদর্পে বলে দিলেন। এটা নিশ্চয়ই কোনো সাধারণ ঘটনা হতে পারে না—এর পেছনে অবশ্যই বিরাট রহস্য রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বেগম রওশন এরশাদের বক্তব্য নিয়ে যাই বলুন না কেন—আমি মনে করি প্রকৃতির ইঙ্গিতে প্রকৃতিগতভাবেই তিনি একটি নির্মম বাস্তবতা বহুদিন পরে হলেও স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি হঠাৎ করে কীভাবে প্রকৃতির কবলে পড়লেন এই সমীকরণ মেলাতে গিয়েই আরও অনেক প্রসঙ্গের সঙ্গে ভিনসেন্ট ভ্যানগগের কথা মনে পড়ে গেল। প্রকৃতির কতগুলো সরল সমীকরণ রয়েছে। প্রথমত মানুষ যখন এলোমেলো, অগোছালো কিংবা নিয়মবহির্ভূত কাজকর্ম করে, সবকিছু ওলটপালট করে দেয়, তখন প্রকৃতি তার আপন কর্তৃত্ব ও প্রভাব খাটিয়ে ধরাধামে সঠিক সমীকরণটি মিলিয়ে দেন ঠিক যেন ফ্রুটিকা খেয়ে সত্য কথা বলার মতো করে। কখনো ঘটনা দ্বারা আবার কখনো দুর্ঘটনা দ্বারা; কিংবা শব্দ দ্বারা প্রকৃতি তার অভীষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে থাকে।

প্রকৃতির দ্বিতীয় সমীকরণ হলো—বর্তমানের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অযত্ন-অবহেলা কিংবা ঠাট্টা-মশকারার বিষয়বস্তুকে সে অনাগত দিনে মহামূল্যবান বিষয়বস্তুতে রূপান্তর বা পরিণত করে। ভিনসেন্ট ভ্যানগগের চিত্রকর্ম কিংবা ভূ-অভ্যন্তরের মহামূল্যবান রত্ন-মণি মানিক্যের উদাহরণ থেকেই প্রকৃতির খেয়ালখুশি অনুধাবন করা যায়। কাজেই বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যারা জুলুম, নির্যাতন, হয়রানি, অপমান অথবা ঠাট্টা-মশকারার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছেন, তারা অনাগত দিনে নিয়ম মোতাবেক প্রকৃতির আনুকূল্যের মধ্যে পড়ে যাবেন। বর্তমানে যাদের মূল্যহীন বলে ধ্যান-জ্ঞান করা হচ্ছে, তারাই প্রকৃতির দয়ায় আগামী দিনে মূল্যবান বস্তুতে পরিণত হবেন। বাংলাদেশের সংসদে বেগম রওশন এরশাদ কোনো দিন বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ারে বসবেন— এ কথা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। এরশাদ শাসনামলে যারা বেগম রওশন এরশাদকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কিংবা ঠাট্টা-মশকারা করতেন তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সেই ১৯৯০ সাল থেকে তিনি সংসদ সদস্যের পদ অলঙ্কৃত করতে করতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন একটি ব্যতিক্রম নজির সৃষ্টি করলেন—যা হয়তো আগামী দিনে দ্বিতীয়বার ঘটবে না।

প্রকৃতির উল্লিখিত দুটো সমীকরণের বিপরীতে দুটো রসায়ন রয়েছে। প্রথমত, প্রকৃতি মানুষ, সমাজ, স্থান ও কালকে মাঝে-মধ্যে পুরস্কৃত করে অথবা তামাম সুযোগ-সুবিধা অবারিত করে দেয়। মানুষ যখন প্রকৃতির আনুকূল্য লাভ করে তখন সে যা চায়, তাই হয়। অথবা সে যেখানে হাত লাগায় সেখানেই সোনা ফলে যায়। প্রকৃতি কখনো মন্দ লোককে আনুকূল্য করে নাফরমান, পাপী, শরাবি, কাবাবি প্রভৃতি জাত ও শ্রেণিকে শাস্তি দিয়ে থাকে। অথবা প্রকৃতির অনুকূল্য পেয়ে অনেক জাতপাপী নিজেকে জাহান্নামের উত্তম মেহমান বানিয়ে নেয়। এ ক্ষেত্রে প্রকৃতির খেলা বড়ই নির্মম। মন্দ লোকের জীবনে পার্থিব বিপদ-আপদ কার্যত তার মঙ্গল ডেকে নিয়ে আসে। কারণ বিপদের সময় সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। সে বিনয়ী হয়ে যায় এবং তওবার জন্য অন্তরকে বিধাতার কাছে সমর্পণ করে দেয়। অন্যদিকে মন্দলোক যদি সফলতা পায় তবে দাম্ভিকতা ও নিত্যনতুন পাপাচার দ্বারা সে যেমন অন্যের জীবন বিশেষত তার মতো মন্দ লোকদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে তেমনি নিজেকে দুর্বার গতিতে জাহান্নামের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। প্রকৃতির এই রসায়নের কার্যকরণ হলো—মন্দ লোকের জন্য বিপদ-আপদ আশীর্বাদ এবং সুযোগ-সুবিধা ও সফলতা হলো অভিশাপ।

প্রকৃতির দ্বিতীয় রসায়ন হলো সে প্রতিশোধ নেয়। প্রকৃতি কখনো ক্ষমা করে না। বিশেষত রাজনীতি ও সামাজিক দুরাচারের বিরুদ্ধে প্রকৃতি জমিনে দৃষ্টান্তমূলক প্রতিশোধ গ্রহণ করে থাকে। প্রকৃতি তার আপন কর্তৃত্বে মন্দ লোকদের বিভিন্নভাবে নির্মূল করে দেয় এবং ভালো লোকদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়ে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধির এক অনন্য নজির স্থাপন করে। সাধারণত শত বছর পর বা কয়েকশত বছর পর কোনো দেশ, জাতি এ ধরনের প্রাকৃতিক আনুকূল্য পেয়ে থাকে। যখন সাধারণ জনগণের মধ্যে ভালো মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায় তখন মন্দ মানুষ নিধনে প্রকৃতি অলৌকিকভাবে এগিয়ে আসে। বাংলার জমিনে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এবং শায়েস্তা খাঁর শাসনামল ছাড়াও শশাঙ্ক ও গোপালের ক্ষমতা লাভকে প্রকৃতির প্রতিশোধ পরবর্তী দয়া ও করুণা বলে বিবেচনা করা হয়।

জমিনে প্রকৃতির আইনের সাধারণ নিয়ম মোতাবেক আমরা যদিও জানি না এই মুহূর্তে কার জন্য কোন সমীকরণ প্রযোজ্য এবং কোন রসায়ন করে ভাগ্য কীরূপে আগামীতে দোলা দেবে। তবে যারা ভুক্তভোগী তারা কিন্তু প্রকৃতির আভাস যথানিয়মে আগাম বার্তা হিসেবে পেয়ে যান স্বপ্নযোগে অথবা হৃদয়ের ঘড়ির কাঁটার ধুক ধুক শব্দের মাধ্যমে।  রাজা কংস জেনে গিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণের আগমন বার্তা।

অন্যদিকে, ফেরাউন যেমন হজরত মুসা (আ.) জন্মের বহু আগে তাঁর আগমনের অশনি সংকেত পেয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি পারস্য রাজ নওশের ওয়াহ ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখের ভোর রাতে স্বপ্নযোগে জেনে গিয়েছিলেন যে, মক্কায় ভূমিষ্ঠ হওয়া অনাগত দিনের বিস্ময়কর মহামানবের অনুসারীদের হাতেই হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী এবং  প্রবল পরাক্রান্ত পারস্য সাম্রাজ্যের পতন হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

 

সর্বশেষ খবর