রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

রুপু : আমার আনন্দ বেদনার স্মৃতি

হানিফ সংকেত

রুপু : আমার আনন্দ বেদনার স্মৃতি

আলী আকবর রুপু একজন মেধাবী সংগীত পরিচালক। তার তুলনা তিনি নিজেই। সংগীত পরিচালনার বাইরেও আমার কাছে আলী আকবর রুপু একজন সুন্দর মনের মানুষ। ভালো মানুষ। নির্ভেজাল। নিরহংকার। ইত্যাদির দীর্ঘদিনের পথচলার সাথী— অধিকাংশ গানের সুরস্রষ্টা। গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে রুপু আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, নিয়েছে শেষ বিদায়। বিদায় একটি চিরন্তন সত্য। মানুষ পৃথিবীতে আসে, পৃথিবীকে ভালোবাসে, মায়ায় জড়িয়ে কাঁদে হাসে, তারপর একসময় বিদায় নিলে সবাই শোকে ভাসে। রুপুর এই আকস্মিক বিদায়েও পুরো সংগীতাঙ্গন শোকাহত। শোকাহত পুরো ইত্যাদি পরিবার। আমার সঙ্গে রুপুর সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো। দীর্ঘদিনের পথচলায় রুপুর সঙ্গে আমার অসংখ্য স্মৃতি, কোনটা রেখে কোনটা বলব। ইত্যাদির দীর্ঘ তিন দশকের যাত্রায় প্রচুর দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হয়েছে। এর প্রায় সব কটিরই সুর করেছে আলী আকবর রুপু। সেই অর্থে রুপুর মতো এত বেশিসংখ্যক দেশাত্মবোধক গানের সুর আর কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই। রুপুর কম্পজিশনে দেশকে খুঁজে পাওয়া যেত। ইত্যাদির প্রতিটি গান তৈরির ক্ষেত্রে আমরা গানের কথা এবং সুরের ওপর খুবই গুরুত্ব দিই। যে কারণে ইত্যাদির অধিকাংশ গান লিখেছেন খ্যাতিমান গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান এবং কিছু লিখেছেন লিটন অধিকারী রিন্টু। বলতে গেলে এ দুজনই ইত্যাদির নিয়মিত গীতিকার। তাই ইত্যাদির একটি গান সৃষ্টির পেছনে ত্রিমুখী চিন্তা কাজ করে— গীতিকার, সুরকার এবং নির্মাতা। রুপুর সঙ্গে রফিক ভাইয়েরও ছিল চমৎকার সম্পর্ক। রুপু রফিক ভাইকে ডাকত ‘বাবা’, আর রফিক ভাইও তাকে সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। ইত্যাদির প্রতি রফিক ভাইয়েরও একটু অন্যরকম ভালোবাসা রয়েছে। তাই ইত্যাদি ছাড়া তাকে অন্য কোনো অনুষ্ঠানে খুব একটা গান লিখতে দেখা যায় না। গানের কথা হাতে পেলে সুর নিয়ে বসতাম। বেশ সময় নিয়ে গানের সুর করত রুপু। কম্পজিশন করতে গিয়ে কখনো লুপের আশ্রয়ও নিত না। কোনো সফটওয়্যার ব্যবহার করে বেসুরো গানকেও সুরে আনত না। সবসময়ই আসল যন্ত্র এবং যন্ত্রশিল্পীকে ডেকে এনে বাজাত। আজকাল তো ঘরে ঘরে স্টুডিও। অনেকেই নিজের ইচ্ছামতো সুর এবং কম্পজিশন করে নিজেই গান গেয়ে দেয়, হয়ে যায় শিল্পী। কিন্তু এত বছর হয়ে গেল রুপুর ঘরে কোনো স্টুডিও হয়নি। আমরা বিভিন্ন পেশাদার স্টুডিওতে গিয়েই কাজ করেছি সবসময়। শুরুতেই বলেছি, রুপু ছিল অত্যন্ত ভালো মনের একজন মানুষ। তার আচার-আচরণ ছিল অনেকটা শিশুর মতো। শুধু গানের সুর সৃষ্টির সময় মনে হতো ও যেন একজন সাধক-সুরের ধ্যানে রয়েছে। রুপু কথা বলত কম, শুনত বেশি। আমার দীর্ঘ ৩০ বছরের সম্পর্কে আমি রুপুকে কখনো রাগতে দেখিনি। কারও সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে দেখিনি। সংগীতাঙ্গনে তাকে ভালোবাসত না এমন শিল্পী খুব কম আছে।

রুপু বরাবরই একজন ডায়াবেটিস রোগী ছিল, তাই সবসময় খাওয়া-দাওয়াটা ছিল নিয়ন্ত্রিত। আর মামি (রুপুর স্ত্রী) অসাধারণ একজন মহিলা। (উল্লেখ্য, রুপুকে সংগীতাঙ্গনে অনেকেই মামা বলে ডাকত।) যিনি সবসময় রুপুকে আগলে রাখতেন একটি শিশুর মতো। এত কিছুর পরও ২০১৫ সালে রুপুর হার্টে ব্লকেজ ধরা পড়ে। তিনটি রিং পরানো হয়। রুপুর জীবন হয়ে যায় আরও নিয়ন্ত্রিত। একদিন মামিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘রুপুর এই স্বাস্থ্য জটিলতার কারণে ইত্যাদির গানের সুর করা সম্ভব হবে কিনা।’ কারণ সুর করতে গেলে তার ওপর বাড়তি মানসিক চাপ পড়বে। মামি বললেন, ‘ইত্যাদির গান না করলে ও আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।’ রিং লাগানোর পরে যে অনুষ্ঠানটি ছিল সেটা হলো ঈদের অনুষ্ঠান। বেশ জটিল গান। ইত্যাদির ঈদ পর্বগুলোয় আমরা চেষ্টা করি বিষয়ভিত্তিক গান করতে, যেখানে থাকে মা, মাটি ও মানুষের কথা। জটিল হলেও এই অসুস্থ অবস্থায়ও রুপু অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গানটির সুর করেছিল এবং এটিই ছিল ইত্যাদিতে রুপুর করা শেষ গান। অসাধারণ সুরের এ গানটিতে অভিনয় করেছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, সাবেরী আলম ও সাঈদ বাবু। আগে সুর করতে রুপু আমার অফিসে এলেও অসুস্থ হওয়ার পর আমিই ওর বাসায় গিয়ে কাজ করতাম।

দেশে যখন প্রথম টেরিস্টেরিয়াল চ্যানেল একুশে টিভি এলো, সায়মন ড্রিং একুশে টিভির পুরো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি নির্মাণের দায়িত্ব তুলে দিলেন আমার কাঁধে। অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করতে গিয়ে প্রথমেই মাথায় এলো একটি ‘থিম সং’ করতে হবে। তখন থিম সং করার কোনো রেওয়াজ ছিল না, আমরাই শুরু করেছিলাম। সুতরাং কাজটি যেহেতু আমি করব তাই কথার জন্য মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান এবং সুরের জন্য আলী আকবর রুপুই আমার প্রথম পছন্দ। গানটি নিয়ে আমরা ১৫ দিন পরিশ্রম করেছি। গানটির চিত্রায়ণ কেমন হবে, কী কী থাকবে রুপুকে বুঝিয়ে দিলাম। চমৎকার সুর করে ফেলল রুপু। গাইলেন সাবিনা ইয়াসমিন ও এন্ড্রু কিশোর। দেশে প্রথমবারের মতো প্রায় চার হাজার শিল্পীর অংশগ্রহণে, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে গানটি চিত্রায়িত হলো। এখনো একুশে টেলিভিশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গানটি শুনলে মন ছুঁয়ে যায়। এভাবেই এনটিভির উদ্বোধনী সংগীত, এটিএন বাংলার উদ্বোধনী সংগীত সব কাজই আমি আর রুপু একসঙ্গে করেছি।

গানের ক্ষেত্রে রুপু ছিল আমার পরম নির্ভরতার জায়গা। সেই ভালোবাসার মানুষটি ২০১৫ সাল থেকেই ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে শুরু করল। কেমন যেন নির্বিকার, ভাবলেশহীন চেহারা। যত অসুস্থই থাক না কেন ইত্যাদির গান শুনলেই রুপু এমন ভাব করত যেন তার কিছুই হয়নি, আমরা শুধু শুধু তাকে নিয়ে ভাবছি। ২০১৭-এর রোজার মাসে রুপুর আর একটি শারীরিক বিপর্যয় ঘটল। তার দুটি কিডনিই বিকল হয়ে যাওয়ায় তাকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে হচ্ছিল। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, কিডনির অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। এ সময় মাঝে মাঝে রুপুর সঙ্গে কথা হতো, দেখা হতো। দেখা হলে, উল্টো জিজ্ঞাসা করত, ‘ভালো মামা?’ কেমন যেন শিশুর মতো এদিক-ওদিক তাকাত। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ করে ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে মামির ফোন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘রুপু ব্রেন স্ট্রোক করেছে, আছে ইবনে সিনায়।’ ছুটলাম সেখানে। আমাকে দেখে রুপু অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। স্ট্রোকের কারণে একদিক অবশ হয়ে গেছে। তাই স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছে না। রুপুকে এ অবস্থায় কখনো দেখিনি, কখনো দেখব ভাবিনি। হঠাৎ এ অবস্থায় প্রচণ্ড কষ্ট পেলাম। দু-তিন দিন এখানে থাকার পর চিকিৎসকরা জানালেন রুপুর এই অবস্থায় এখানে ডায়ালাইসিস করানো সম্ভব নয়, ইউনাইটেড হাসপাতালে নিতে হবে। সেদিনই ইউনাইটেডে নেওয়া হলো। বিকালে হাসপাতালে গিয়ে জানলাম রুপুর শরীরে আরও দুটি অসুখ যুক্ত হয়েছে নিউমোনিয়া ও শাসকষ্ট। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বললে, তারা হতাশা ব্যক্ত করলেন। বললেন, ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, যা বেশ ব্যয়বহুল।’ এ অবস্থায় মামি কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সাহস দিলাম, অন্তত অর্থের অভাবে রুপুর চিকিৎসা বিঘ্নিত হবে না। চিকিৎসকরা যেভাবে চাইবেন সেভাবেই চিকিৎসা চলবে। চলল ১২ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এর মধ্যে কখনো একটু ভালো হচ্ছে আবার কখনো খারাপ অর্থাৎ মাঝে মাঝে আশার আলো দেখা গেলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে সব আশার আলো নিভিয়ে আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে রুপু চিরবিদায় নিল।

পরিশেষে দু-একটি কথা না লিখলেই নয়। সে সময় রুপুর চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছি। ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক প্রতিষ্ঠিত ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশন’-এর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। টেলিফোন করলে এই ফাউন্ডেশনের একজন অফিসকর্মী সোহানা বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি সেদিন রাতেই হাসপাতালে রুপুকে দেখতে এলেন, সে সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম এবং রুপুর জন্য ফাউন্ডেশন কিছু করবে বলে আশ্বাস দিলেন। পরদিন রুপুর স্ত্রীকে ফোন করে জানানো হলো রুপুর জন্য ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এ কথা শুনে মামি কষ্ট পেলেন। তিনি বিষয়টিকে ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না। কারণ যেই ফাউন্ডেশন শিল্পী লাকী আখন্দকে ৪০ লাখ, সুরকার আলাউদ্দিন আলীকে ২০ লাখ ও শিল্পী শাম্মী আখতারকে ১০ লাখ টাকা দিতে পারে তারা কীভাবে মৃত্যুপথযাত্রী আলী আকবর রুপুর মতো একজন সংগীত পরিচালকের চিকিৎসার জন্য মাত্র ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিল? এ বিষয়টি রুপুর পরিবারকে বিস্মিত করেছে। বিষয়টি নিয়ে আমি কমিটির দুজন সদস্যের সঙ্গে কথা বললাম। তাদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কমিটির সবার মতামত ছাড়া আপাতত কিছু করা সম্ভব নয় বলে জানালেন, এও জানালেন ফাউন্ডেশনে ফান্ডের স্বল্পতা রয়েছে। তার পরও তাদের সুপারিশে পরে ১ লাখ টাকা পাওয়া গেল। সোহানা এবং তাদের কাছ থেকে জানলাম, এই ফাউন্ডেশনের অর্থ পেতে হলে কমিটির সব সদস্যের উপস্থিতিতে বিষয়টি সভায় পাস হতে হবে এবং যে সভা প্রতি তিন মাস পরপর অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে রোগী মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন সেই রোগীর পাশে দাঁড়াতে গিয়ে যদি তিন মাস পর সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় সেটা বড়ই দুঃখজনক। কারণ মুমূর্ষু রোগী অত দীর্ঘ সময় না-ও বাঁচতে পারেন। যেটা ঘটেছে আলী আকবর রুপুর ক্ষেত্রে। তবে ‘শিল্পীর পাশে ফাউন্ডেশনে’ এখন ফান্ডের স্বল্পতা আছে শুনে প্রয়াত আনিসুল হকের কথা খুব করে মনে পড়ছিল। যিনি এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা। তিনি জীবিত থাকলে হয়তো এমন কথা শুনতে হতো না। যেভাবেই হোক তিনি রুপুর পাশে এসে দাঁড়াতেন। পরিশেষে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বাংলাভিশন পরিবারকে। কারণ তারাই রুপুর চিকিৎসার সহায়তায় এগিয়ে এসেছিল আন্তরিকভাবে। বাংলাভিশনই ছিল রুপুর শেষ কর্মস্থল। বাংলাভিশনের চেয়ারম্যান জনাব আবদুল হকের কথা না বললেই নয়। রুপুর চিকিৎসার জন্য অর্থ সহযোগিতা চাইতেই তিনি বললেন, ‘আপনি যত টাকা চাইবেন তত টাকাই দেব।’ সেই ভরসাতেই রুপুর চিকিৎসার কোনো ত্রুটি হয়নি। পরে হাসপাতালের সব বিল তার প্রদত্ত অর্থেই পরিশোধ করা হয়েছে। যেটি সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দেওয়া।

রুপুর চিকিৎসা চলার সময় প্রায় দিনই হাসপাতালে যেতে হয়েছে। মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরও গিয়েছিলাম। সংগীতাঙ্গনে শিল্পীর ছড়াছড়ি, খুব কম শিল্পীই আছেন রুপু যাদের গান করেননি। অনেক যন্ত্রশিল্পী আছেন, সমিতি আছে, শিল্পী সংগঠন আছে কিন্তু রুপুর এই অসুস্থতার সময়ে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া কাউকেই চোখে পড়েনি। আমাদের মনে রাখা উচিত, শুধু রুপুই নয়— একজনের দুঃসময়ে আমরা সবাই যদি এগিয়ে না আসি আমাদের দুঃসময়েও আমরা কাউকে পাব না। কারণ সময় কারও সমান যায় না। রুপুর আত্মার শান্তি কামনা করছি।

            লেখক : গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়ন কর্মী।

সর্বশেষ খবর