রবিবার, ৪ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

পাটের সোনালি দিনের প্রতীক্ষায় কৃষক

শাইখ সিরাজ

পাটের সোনালি দিনের প্রতীক্ষায় কৃষক

৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস। আবহমান বাংলার কৃষি অর্থনৈতিক ঐতিহ্যের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পাট এবং আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের প্রথম বুনিয়াদ। পাটের জিন নকশা আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী আমাদের কৃষিবিজ্ঞানের সাফল্য উচ্চে তুলে ধরেছে। পাট নিয়ে এখন আমাদের অনেক দীর্ঘ স্বপ্ন। কিন্তু এই স্বপ্ন নিয়ে আমরা কতটা এগিয়ে যেতে পারছি, দেখার বিষয়। পাট নিয়ে কৃষকের স্বপ্নও অনেক বড়। তারা দারুণ উৎসাহে পাট চাষে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কিন্তু বাজারমূল্য প্রাপ্তি নিয়ে রয়েছে তাদের মিশ্র মতামত। গত কয়েক বছর আমরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাট চাষ ও বাজার পরিস্থিতি লক্ষ্য করছি। অনেক এলাকায় পাট নতুন করে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। গত বর্ষায় পাটের ভরা মৌসুমে রংপুরের গঙ্গাচড়ার পাট চাষ এলাকার দৃশ্যপট ছিল যথেষ্টই আশাজাগানিয়া। কিন্তু সব এলাকার পরিস্থিতি একরকম নয়। গত সপ্তাহে শরীয়তপুরের জাজিরায় গিয়ে পেলাম কিছুটা ভিন্ন চিত্র। দেখলাম পাটের মৌসুম নয়, তবুও মোকামগুলোয় পাট শুকানো ও পাট মাপামাপির কাজ চলছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার পাটের বাজারমূল্য ভালো। তবে পাটের মান ভালো না হওয়ায় দাম কম পাচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন কেউ কেউ। বাড়তি শ্রমিক মজুরির কারণেও পুষিয়ে ওঠা যায় না বলে জানিয়েছেন কৃষক। তবে দেখেছি পাটের মূল্যের সঙ্গে পাটকাঠির মূল্য হিসাব করেন না কৃষক। যারা পাটকাঠির বাণিজ্যিক মূল্য হিসাব করেন, তারা ঠিকই পুষিয়ে উঠতে পারেন।

জাজিরার পাট চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম পাট চাষের ক্ষেত্রে কৃষক পর্যায়ে এখনো বড় চাহিদা হয়ে আছে ভালো বীজ। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি পাটজাত পণ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করা। পাট ব্যবসায়ী হাজী দেলোয়ার মাতব্বরের মতে, পাটের মূল্য নিয়ে কৃষকের অসন্তুষ্টির কোনো কারণ নেই। তবে সরকারি পাট কেনা প্রসঙ্গে কিছু কথা রয়েছে এই ব্যবসায়ীর। সেখানকার চাষি ও ব্যবসায়ীরা বেশি জোর দিচ্ছেন পাটের মানের দিকে। তারা বলছেন, জাগ দেওয়ার পানির উৎস কমে যাওয়ায় পাটের মান ভালো হচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা যথেষ্টই আশাবাদী পাটের সোনালি ভবিষ্যৎ নিয়ে।

অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি করতে ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহারের নির্দেশ দেয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। নতুন করে আরও ১১টি পণ্য যুক্ত হয় এই তালিকায়। নতুন পণ্যগুলো হলো— পিয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, আলু, আটা, ময়দা, মরিচ, হলুদ, ধনে ও তুষ-খুদ-কুঁড়া। আইন অনুযায়ী পণ্যের ওজন ২০ কেজির বেশি হলে প্রযোজ্য হবে এই নিয়ম। ফলে দেশে ও বিদেশে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাটের জমি ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১০ সালে গড়ে ৭.০০ থেকে ৭.৫০ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে এবং গড়ে ৭০-৮০ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৭ সালে ৮.১৭ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করে ৯১.৭২ লাখ বেল পাট আঁশ উৎপাদিত হয়েছে, যা স্বাধীনতা-পরবর্তী পাটের আবাদি জমি ও উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড।

আমরা অনেকেই জানি না, আমাদের দেশের পাটতন্তু থেকে কত রকমের ব্যবহারিক পণ্য তৈরি হচ্ছে। পোশাকসামগ্রী থেকে শুরু করে জীবনের অনেক কিছুতেই করা যায় পাটের শৈল্পিক ও রুচিসম্মত ব্যবহার। এ বিষয়গুলো একনজরে দেখতেই গত বছর জানুয়ারিতে দেশে ১৩৫টি পাটজাত পণ্যের স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র চালু করা হয়েছে।

পাটের সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা জানান দিচ্ছেন আমাদের দেশের পাটশিল্প উদ্যোক্তারা। যারা বিশেষ করে শতভাগ রপ্তানিমুখী পাটজাত পণ্য উৎপাদন করছেন। বিদেশের বাজারে আমাদের দেশের পাটজাত পণ্যের রয়েছে বিপুল চাহিদা। সেই চাহিদা মাথায় রেখে যেসব প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাচ্ছে তারই একটি নরসিংদীর ঘোড়াশালে অবস্থিত জনতা জুট মিলস লিমিটেড। ৪৭ একর জায়গার ওপর মিলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের আধুনিক উৎকর্ষে অনন্য দৃষ্টান্ত গড়েছে এই প্রতিষ্ঠান। ৭০ থেকে ৮০ রকমের পাটপণ্য প্রস্তুত হয় এই কারখানায়। প্রতিদিন গড়ে রপ্তানি ১১৫ টন। বছরে ১৪ লাখ মণ কাঁচা পাট কেনে এই মিল কর্তৃপক্ষ। ৬ হাজার লোকবলের বিশাল প্রতিষ্ঠানটিতে পাট নিয়ে চলছে বিস্ময়কর কর্মযজ্ঞ।

সবচেয়ে উৎকর্ষের দিক হলো আমাদের পাটজাত পণ্যের মান ও চাহিদা। কোথায় ব্যবহার হচ্ছে না আমাদের সোনালি আঁশ! তবে জনতা জুট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল হক বলছেন, আমাদের ভোক্তা বাজারে পাটপণ্যের চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু ঐতিহ্যভিত্তিক পাটপণ্য উৎপাদনে আমাদের আরও দক্ষতা ও উৎকর্ষ প্রয়োজন। জানা গেল, জনতা জুট মিলস বিশ্বের ১২৪টি দেশে পাটজাত পণ্য রপ্তানি করছে। এই সম্ভাবনা দিন দিন বাড়ছেই। এসব ক্ষেত্রে সরকারও নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম।

গত পাঁচ বছরে বহুমুখী পাটপণ্যের রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশের পাটের তৈরি আধুনিক বিলাসসামগ্রী এখন ব্যবহূত হচ্ছে ব্রিটিশ রাজপুত্র প্রিন্স চার্লসের বাসায়। স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের রানীর হাতে পৌঁছে গেছে পাটের তৈরি বাহারি ব্যাগ। একসময় দড়ি, চট, ছালা, বাজারের ব্যাগ বা বস্তার মতো সস্তা পণ্যের মধ্যে সীমিত ছিল পাটের ব্যবহার। সেই পাট এখন বিশ্বের নামিদামি গাড়ি তৈরির কোম্পানি বিএমডব্লিউর সর্বাধুনিক আই থ্রি মডেলের ইলেকট্রিক গাড়ির ভিতরের বাক্স, বডি ও অন্যান্য উপাদান তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। আর তা রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। জার্মানির ভক্সওয়াগন, জাপানের নিশান ও টয়োটা গাড়ির বডি তৈরির কাঁচামাল হিসেবেও বাংলাদেশের পাটের সমাদর রয়েছে।

পাট খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে একসঙ্গে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের প্রাকৃতিক ব্যাগের চাহিদা তৈরি হচ্ছে প্রতি বছর।  এই চাহিদার একটি অংশ ধরতে পারলেও বাংলাদেশের পাটপণ্যের রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব।

দেশের কৃষক চায় সোনালি আঁশের সোনালি দিন আবার ফিরে আসুক। এর বিপুল সম্ভাবনাও হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বিশ্ববাজারের চাহিদা পূরণের জন্য শুধু প্রয়োজন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ ও পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারে প্রয়োজন দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সচেতনতা ও আন্তরিকতা।  আমি বিশ্বাস করি, সবার সম্মিলিত সচেতনতায় আবার ফিরে আসবে সোনালি আঁশের সোনালি সময়। আবারও অর্থনৈতিক সাফল্যে কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছে যাবে বাংলার পাট।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

            [email protected]

সর্বশেষ খবর