শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

দোহাই রাজনীতিবিদরা আতঙ্ক ছড়াবেন না

কাজী হায়াৎ

দোহাই রাজনীতিবিদরা আতঙ্ক ছড়াবেন না

ও মিয়া কাজীর বিটা, এট্টু দাঁড়ান দেহি আমার এট্টা কথা শুনেন। পিছন ফিরতেই দেখি খালি গায়ে গামছা কাঁধে এক বৃদ্ধ আমাকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলছেন। লোকটার হাতে একখানা ধান নিড়ানো কাঁচি। মুখে একগাল সাদা দাড়ি। মাথায় পোকা ধরা ধানখেতের মতো আধমরা কয়েক গোছা সাদা চুল। হাত-পায়ে কাদা লাগানো। এই মাত্র বোধহয় কাজ করে খেত থেকে উঠে এসেছেন। অথবা কাজের মাঝে একটু জিরিয়ে নিতে এসেছেন। আমি গিয়েছিলাম ভাটিয়াপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত যে রাস্তা সেই রাস্তার পাশে আমার একটা পৈতৃক জমি আছে। জমিটা সঠিক কোথায় আমি তা ভালো করে চিনিও না। শুনলাম রাস্তাটা ফোর লেন হতে যাচ্ছে। ভাবলাম জমিটা কি ফোর লেনের মধ্যে পড়ে গেল কিনা তাই। আমি বৃদ্ধকে বললাম, কী বলবেন চাচা মিয়া বলেন। তিনি বললেন, আপনারা রাজধানীতি থাহেন। বড় বড় লোকদের সঙ্গে ওঠা বসা। ওই যে রেললাইনডা হতিছে, ওই রেললাইনের উপর দিয়া রেলগাড়ি চলবে কবে? কেউ কয় এক মাস পর। কেউ কয় ছয় মাস পর। কেউ কয় পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে। এই রেললাইন কি ভাটিয়া পাড়ার ত্যা গোপালগঞ্জি পর্যন্ত শ্যাষ? না তারপরও লম্বা হবি। বৃদ্ধের অনেক প্রশ্ন। যার একটিরও সঠিক উত্তর আমার জানা ছিল না। তবু খবরের কাগজের মাধ্যমে যে তথ্যগুলো আমার জানা ছিল, এক এক করে তা বলতে থাকলাম। ভাটিয়াপাড়া থেকে গোপালগঞ্জ রেললাইন চালু হবে আগামী জুন মাস অর্থাৎ বাংলা আষাঢ় মাসে। আর পদ্মা সেতু চালু হবে আগামী বছর। আর রেললাইনের কথা শুনেছি পরে এই লাইনটা গোপালগঞ্জ থেকে মোংলা পোর্ট পর্যন্ত যাবে। কাজীর বিটা রেলগাড়িডা যদি আষাঢ় মাসে চালু অয় তাহলি মনে হয় আল্লাহ করলি আমার আশাডা পূরণ হতি পারে। আপনার কি আশা পূরণ হবে চাচা মিয়া? স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলে একবার ভাইটা পাড়ার ত্যা রেলগাড়িতে চইড়া মধুখালী গেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই রেলগাড়ি দিয়া ফরিদপুর থেইকা রাজবাড়ী হইয়া ভাটিয়াপাড়া যে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল, ওই ক্যাম্পের খাবার-দাবার গোলাগুলি আসত। সেই জন্য আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের সোমায় একটা ব্রিজ উড়াইয়া দিছিল। যাতে ওরা আর আসতি না পারে। তারপরের ত্যা ওই যে লাইনডা বন্ধ হইয়া গেল আর কেউ ওই লাইনডা চালু করে নাই। শুনছি কিছুদিন আগে ভাইটা পাড়ার ত্যা একটা অথবা দুইডা বগি দিয়া লাইনডা আবার চালু অইছে। এত সব ঘটনা আমার বিবি মানে আপনার চাচি কিছুই জানে না। এর মদ্দি সে একদিন ডাঙ্গার মদ্দি আইছিল আমার ভাত নিয়া। ওই যে দেহেন রেললাইনের কাজ হতিছে ওইডা দেইখা আমারে আপনার চাচি জিজ্ঞেস করল, যে রাস্তার কথা শুনছি, সে রাস্তাডা কি অইযে নাকি? কলাম হ। তারপর আমার বিবি কত যে কথা কতি লাগল ওই রাস্তা দিয়া রেলগাড়ি কবে চলবি? রেলগাড়ি কত বড়? রেলগাড়ি দেখতি কেমুন? রেলগাড়ি ক্যাম্বায় চলে দেহ তোমারে কিন্তু কইয়া রাখথিছি, রেলগাড়ি চালু হলি আমারে কিন্তু রেলগাড়িতে চড়াইয়া গোপালগঞ্জি নিয়া যাতি অবি। আমি আপনার চাচির এত কথার উত্তর না দিয়া, কইছি শিগগির রেলগাড়ি চালু হবি, আমি তোমারে রেলগাড়িতি কইরা গোপালগঞ্জি নিয়ে যাব। তহন তুমি নিজি নিজি সব বুঝতি পারবা, রেলগাড়ি ক্যামন, রেলগাড়ি কত বড়, রেলগাড়ি ক্যাম্বায় চলে। বুড়ো হইয়া গেছি তো চাচা মিয়া, কবে মইরে যাই আপনার চাচির শরীলডাও ভালো না, সেও যে কোনো সময় মইরা যাতি পারে। যদি মইরেই যায়, তাহলি তো সবই গেল। বাঁইচে থাকতি দেইহ্যা যাতি পারল না রেলগাড়ি ক্যামন? চাচা মিয়ার একটানা এত কথা শুনতে বিরক্ত হচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম হ্যাঁ তাই তো। এখনো এ দেশে অনেক মানুষ আছে যারা কোনো দিন রেলগাড়িতে চড়ে নাই, এমনকি দেখেও নাই। চাচা মিয়াকে আশ্বস্ত করে বললাম, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে রেল চালু হবে, আমার মনে হয় আপনার আশা পূরণ হবে। তাহলি তো ভালো হয়। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো যদি আগামী বছর চালু হয়, তাহলি তো ভয় আছে। কিসের ভয় চাচা? কাজীর বিটা, আপনার তো আমার চাইয়া ভালো কইরা বোঝা উচিত। এই বছর না ইলেকশন হবি? হ্যাঁ ইলেকশন হবে তাতে কী? যদি কোনো ওলটপালট হইয়া যায়, তালি তো বিরাট বিপদ হবি।

বৃদ্ধের এই আতঙ্কে বেশ কিছুটা বিস্মিত হলাম। আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞেস করলাম, ইলেকশনে ওলটপালট হলে বিপদ হবে কীভাবে? এ তো সোজা কতা বোঝলেন না চাচা? ইলেকশনে যদি আওয়ামী লীগ হাইরা যায়, তাহলি তো এসব কাজ বন্ধ অইয়া যাবি। শুনছি বিএনপির সবচেয়ে বড় নেতা খালেদা জিয়া কইছে, আপনারা পদ্মা সেতু চালু হইলেও কেউ ওই সেতু দিয়া চলাফেরা করবেন না। কারণ পদ্মা সেতু জোড়াতালি দিয়া বানানো হতিছে। ওডা বলে ভাইঙ্গা পড়তি পারে। তাহলি তো সহজ কথা, উনি ক্ষমতায় আসলি পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ কইরা দেবেন। না হয় ভাইঙ্গা আবার নতুন কইরা বানাবেন। আরও শুনছি উনি যদি ক্ষমতা পায় তাহলি গোপালগঞ্জি নামই বলে থাকপে না। বৃদ্ধের এত আতঙ্কের কারণ বুঝতে পারলাম। আরও বুঝতে পারলাম, রাজনীতিতে অতিকথন কত খারাপ।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতায় প্রবেশ এবং প্রস্থানের রাস্তা খুবই সুন্দর। নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হয়। আবার বিদায়ের সময় জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে বিদায় নিতে হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যদি কেউ ক্ষমতায় এসে নিজেই অতিকথন, দুর্নীতি এবং আইনের শাসনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে নিজের মতো চলতে থাকেন, তাহলে প্রস্থানের পথও এক সময় বন্ধ হয়ে যায়। তখন ওই দল অথবা ব্যক্তিকে খুবই বিপদগ্রস্ত হতে হয়। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য ১৯৭৫-এর ভয়াবহ জাতীয় বিপর্যয়ের পর থেকে এ দেশে একবার কেউ কোনোভাবে ক্ষমতায় গেলে নিজেরাই তাদের প্রস্থানের পথ বন্ধ করে দেন। তারপর শুরু হয় টানাহিঁচড়া। তাতে ক্ষতি হয় দেশের অর্থনীতির, মৃত্যু হয় অনেক নিরপরাধ নাগরিকের। আর আতঙ্কিত হতে হয়, নিষ্কলুষ বৃদ্ধ চাচা মিয়ার মতো অত্যন্ত স্বচ্ছ মানুষদের। এ জন্য আমি মনে করি, রাজনীতিতে অতিকথন, দুর্নীতি অত্যন্ত খারাপ।

মনে পড়ে গত অক্টোবর মাসে একটা আমন্ত্রণে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম সমগ্র চেকোস্লোভাকিয়ায় মাত্র ৯৮ জন বাংলাদেশি আছেন। গ্রাগ শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলেই নোয়াখালীতে বাড়ি ইউনুস মিয়ার একটি খাবার হোটেল। হোটেল সংলগ্ন দোতলায় একটা বাসাও আছে তার। ওই বাসাতেই আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। আর খাবার ব্যবস্থা হলো নিচতলার ওই বাংলা খাবারের দোকানে। পরে জানলাম, এই দোকান দিয়েই ইউনুস মিয়া বেশ অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এক সপ্তাহ ছিলাম সেখানে। দেখে অবাক হলাম তার সমস্ত কাস্টমার চেকোস্লোভাকিয়াবাসী। সাত দিনের মধ্যে একদিন একজন বাঙালি কাস্টমারকে দেখেছিলাম। প্রাগের স্থানীয় মানুষদের নাকি আমাদের বাংলা খাবার খুব পছন্দ। এর মধ্যে সবচেয়ে পছন্দের আইটেম নাকি ডালের স্যুপ। এত সব দেখে-শুনে বেশ অবাক হচ্ছিলাম। এর মধ্যে সবচেয়ে অবাক হলাম একদিন। ইউনুস সাহেব আমাকে ওপর থেকে নিচে নামিয়ে এনে হোটেলে খাবার খাচ্ছেন একটা লোক দেখিয়ে বললেন, আঙ্কেল ওই লোকটাকে একবার দেখেন। দেখলাম প্রাগের সাধারণ মানুষের মতোই একজন মানুষ বসে বসে খাচ্ছেন। ইউনুস সাহেব বললেন, এখন আর ওইদিকে তাকাবেন না। আমার কাছে শোনেন, উনি কে? আমি বললাম কে? উনি চেকোস্লোভাকিয়ার অর্থমন্ত্রী। মাঝে মাঝে উনি আমার এখানে খেতে আসেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সঙ্গে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের গাড়ি নাই? না কাকা ওসব তো নাই-ই ড্রাইভারও নাই। উনি নিজেই ড্রাইভ করে আসেন। আমি বললাম এখানে কোনো তদবিরবাজ তদবির নিয়ে অথবা দরখাস্তের সুপারিশের স্বাক্ষর নেওয়ার জন্য আসে না? না কাকা আসে তো নাই-ই, উনি যে অর্থমন্ত্রী তাই-ই অনেকে জানে না। আমিও তো এখানকার নাগরিক। আমিও উনি এখানে আসার প্রায় মাস ছয়েক পরে জানতে পেরেছি, উনি এ দেশের অর্থমন্ত্রী। ভাবলাম, এমন ঘটনা আমাদের দেশে কি ভাবা যায়? জানি ভাবা যায় না, তার পেছনে অনেক কারণ, আমাদের দেশে এমন ঘটনা ঘটার জন্য অনেক কিছুই অনুপস্থিত। আমাদের অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, আমাদের দেশপ্রেম, আমাদের রাজনীতির দূষণ, এসব মিলিয়ে আমাদের দেশের অবস্থা এমনটি হতে অনেক সময় লাগবে।

অনেক কিছু বলে ফেললাম। সবশেষে এ দেশের সব মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষকে বলতে চাই। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। সব মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষের প্রতি আমার অনুরোধ—মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা না বলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করুন। তাহলেই দুর্নীতি কমে যাবে। তাহলেই মনের মধ্যে দেশপ্রেমের জন্ম হবে। এ বছরের টিআইবির রিপোর্টে জেনেছি, দুর্নীতি কিছুটা কমেছে। বিষয়টি সত্যিই আনন্দের। কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। এটাও আনন্দের। দেশের অনেক উন্নয়ন হচ্ছে এ কথাও সত্য। নির্দ্বিধায় এটিও সমগ্র দেশের মানুষের কাছে আনন্দের বিষয়। মানুষের এত আনন্দ। কোনোভাবেই যেন নিরানন্দে পরিণত না হয়। যারা দেশ নিয়ে ভাবেন, জনগণের কল্যাণ করতে চান, যারা দেশের ভালো চান, আমি জানি তারাই সাধারণত রাজনীতি করেন। তাই রাজনীতিবিদদের প্রতি অনুরোধ—আমার সহজ-সরল কৃষক চাচা মিয়াকে আতঙ্কিত করবেন না। তাকে আশাহত করবেন না। তার প্রিয় বিবি যেন রেলগাড়িতে চড়তে পারে সেই ব্যবস্থা করবেন।

            লেখক : চলচ্চিত্র পরিচালক।

সর্বশেষ খবর