শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

দুনিয়ার মোহ ও পরকাল ভাবনা

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

দুনিয়ার মোহ ও পরকাল ভাবনা

আলোচ্য শিরোনামটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক. দুনিয়ার মোহ ত্যাগ। দুই. পরকালের ভাবনা। দুনিয়ার পরিচয়: দুনিয়া হলো মরুভূমির বালিকণর ন্যায়, দূর থেকে মনে হয় পানি। দৌড়ে গেলে দেখা যায় বালি আর বালি। সহজ সরল মানবজাতিকে ধেঁকা দিতেই দুনিয়া অভ্যস্ত। অথচ রহমাতুল্লিল আলামিনের উসিলায় আল্লাহতায়ালা এ দুনিয়াকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ইবলিস-শয়তানের প্ররোচনায় কিছু কিছু মানব সৃষ্টির মোহে দুনিয়াকে স্থায়ীভাবে আঁকড়ে ধরে নিজের এক খালিক (স্র)কে ভুলে যায়। দুনিয়ার প্রতি অতি আসক্তি ও বিশ্বাসের কারণে তারা বলে থাকে, যেমন পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তারা বলে : আমরা কি উল্টো পায়ে প্রত্যাবর্তিত হবই। গলিত অস্থি হয়ে যাওয়ার পরও। তবে তো এ প্রত্যাবর্তন সর্বনাশা হবে।’ (সূরা নাজিআত:১০,১১,১২)। অপর আয়াতে আল্লাহতায়ালা  ইরশাদ করেন, আপনি তাদের জীবনের প্রতি সবার চাইতে এমনকি মুশরিকদের চাইতেও অধিক লোভী দেখবেন। তাদের প্রত্যেকে কামনা করে, যেন হাজার বছর আয়ু পায়। অথচ এরূপ আয়ুপ্রাপ্তি তাদের শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। আল্লাহ দেখেন যা কিছু তারা করে। (সূরা বাকারা:৯৬)। আলোচ্য আয়াতসমূহে দুনিয়ার প্রতি অতি আসক্তির কারণে অবিশ্বাসীরা এ ধরনের উক্তি করে থাকে। তারা বিশ্বাস করে দুনিয়ার আরাম-আয়েশ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সবই হলো পার্থিব। তাইতো তারা দীর্ঘ হায়াত কামনা করে থাকে। কিন্তু বাস্তব হলো সম্পূর্ণ বিপরীত। আল্লাহপাকের ফায়সালা যখন এসে যাবে তখন কে কোন অবস্থায় আছে তা দেখার সময় থাকে না। মালাকুল মউত ঠিকই তার প্রাণ বায়ু কব্জা করে নিয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যই একেকটি ওয়াদা রয়েছে, যখন তাদের সে ওয়াদা এসে পৌঁছে যাবে, কখন না একদণ্ড পেছনে সরতে পারবে, না সামনে ফসকাতে পারবে।’ (সূরা ইউনুস:৪৯)। বোঝা গেল দুনিয়ার মোহ মানবজাতিকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে ফেলে। ফলে সে কোনটা হক আর কোনটা না হক পার্থক্য করতে ভুলে যায়। অনেক সময় রসুল বা  সঠিক ও সত্য পথকে সঠিকভাবে বোঝার পরও না বোঝার ভান করে থাকে। তাদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহান রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘আমি যাদের কিতাব দিয়েছি, তারা তাকে চেনে, যেমন করে চেনে নিজেদের পুত্রদের। আর নিশ্চয়ই তাদের একটি সম্প্রদায় জেনেশুনে সত্যকে গোপন করে।’ (সূরা বাকারা:১৪৬)। দুই. পরকালের ভাবনা : পরকাল বলতে আমরা পরের কাল বা সময়কে বুঝি, সংক্ষেপে মৃত্যু-পরবর্তী জিন্দেগিকে পরকাল বলা হয়। প্রকৃত মুসলমান হতে হলে পরকালকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে। এবং পরকালে আরাম-আয়েশে থাকার জন্য এ দুনিয়াতেই  সামানা তৈরি করতে হবে। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে মুমিনদের উদ্দেশ্যে বলেন, ইরশাদ হচ্ছে, ‘মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহতায়ালাকে ভয় কর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত, আগামীকালের জন্য সে কি প্রেরণ করে, তা চিন্তা করা। আল্লাহতায়ালাকে ভয় করতে থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহতায়ালা সে সম্পর্কে খবর রাখেন।’ (সূরা হাশর:১৮)। উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহতায়ালা (গাদ) শব্দ ব্যবহার করেছেন, তাফসিরে মারেফুল কোরআনে এর ব্যাখ্যা এসেছে, এর অর্থ হলো— আগামীকাল। মৃত্যু পরবর্তীকাল ও কেয়ামতকে বোঝানো হয়েছে। এখানে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এক. পরকালের মোকাবিলায় দুনিয়ার জীবন একেবারেই নগণ্য যাকে মাকড়সার জালের সঙ্গে তুলনা করা যায়। দুই. আখেরাতের জীবন সুনিশ্চিত বোঝানো হয়েছে, আগামীকাল যেমন সুনিশ্চিত আখেরাতের জীবনও অনুরূপ সুনিশ্চিত। তিন. আগামীদিন যেমন অতি নিকটে অনুরূপ মানবজাতিকে বোঝানো হয়েছে তাদের দুনিয়ার জীবনও অতি স্বল্প এবং পরকাল অতি কাছে। সুতরাং তোমরা পরকালের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ কর। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে মাজহারিতে এসেছে, যে ব্যক্তি মারা যায় সঙ্গে সঙ্গে তার কেয়ামত শুরু হয়ে যায়। উক্ত আয়াতে ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতি মনোযোগী না হয়ে আখেরাতমুখী হওয়ার তালিম দেওয়া হয়েছে। বাস্তবিকই আখেরাতের ভাবনা একজন ব্যক্তিকে দুনিয়াবিমুখ বানিয়ে পরকালমুখী করে দেয়। হজরতে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) দুনিয়াবাসীকে দুনিয়াবিমুখ হয়ে পরকালমুখী হওয়ার শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আল্লাহপাক প্রতিটি মানুষকে  সঠিক রাস্তায় রাখার জন্য যুগে যুগে নবীদের বিশাল জামাত দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে মানুষদের হেদায়েত ও কামিয়াবীর রাস্তা দেখিয়ে গেছেন। নবীদের আহ্বানে যারা সাড়া দিয়েছেন তারা উম্মতে নাজী তথা নাজাতপ্রাপ্ত উম্মত হতে পেরেছেন। কেয়ামত পর্যন্ত যারাই এ জামাতের অনুসরণ করবে তারাও নাজাতপ্রাপ্ত উম্মত হবে। দুনিয়া মোহে পড়ে যারাই পরকালকে অস্বীকার করেছে। দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়েছে তাদের পরিণাম সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহপাক ইরশাদ করেন। ‘অতঃপর যে ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘন করেছে; এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার ঠিকানা জাহান্নাম। (সূরা নাজিয়াত:৩৭,৩৮,৩৯)। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত রসুলের আনুগত্য ছেড়ে দিয়ে শয়তানের অনুকরণ ও অনুসরণে লিপ্ত হয় এবং সে দুনিয়ার মোহে পড়ে দুনিয়াকে প্রাধান্য দিয়ে পরকালের ভাবনা থেকে সিটকে পড়ে। দুনিয়ার খেল তামাশায় লিপ্ত থাকে তার ঠিকানা জাহান্নাম। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর পূর্ণ একিন ও বিশ্বাস করে পরকালের ভাবনায় নিজেকে ব্যস্ত রেখে পরকালের সামানা তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেছে এবং খেয়াল-খুশি হতে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত।’ (সূরা নাজিআত:৪০,৪১)।

লেখক : মুহাদ্দিস, মুফাসসির  ও খতিব, বারিধারা, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর