শনিবার, ১০ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

ইসলামের দৃষ্টিতে গৃহকর্মীর অধিকার

মাওলানা মুহিবুল্লাহিল বাকী, পেশ ইমাম

সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য। অগণিত দরুদ ও সালাম বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর। যার অন্তিম যাত্রার শেষ উপদেশ ছিল : ‘তোমরা তোমাদের গৃহকর্মীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর।’ (সুনানে আবু দাউদ)। ‘তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন কর। কেননা, তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার দুর্ভাগ্যের কারণ।’ (সুনানে আবু দাউদ)। আর এই শ্রেণির মানুষের প্রতি ইনসাফ কায়েম করা ছিল তাঁর দীর্ঘ ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনের দাওয়াতি মিশনের অন্তর্ভুক্ত। আদিকাল থেকে তাদের ওপর চলে আসা সব অত্যাচার ও নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে ইসলাম তাদের ভ্রাতৃত্বের কাতারে দাঁড় করিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইসলামের সর্বপ্রথম মুয়াজ্জিনের মর্যাদা দান করা হয়েছে ক্রীতদাস হজরত বিলাল বিন রবাহ (রা.)-কে। হাদিসে এসেছে : ‘তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন।’ (বুখারি)। অতএব, তাদের প্রতি অবিচার করা হলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

মানুষের অধীনে থাকা বিষয়ের দায়িত্বের ব্যাপারে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন : ‘জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ আওতাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব শাসক যিনি তার জনগণের দায়িত্বশীল; তিনি তাদের প্রতি দায়িত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবেন। গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির ওপর দায়িত্বশীল; সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। দাস তার মনিবের সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক; তাকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে তত্ত্বাবধায়ক ও সংরক্ষক। তোমাদের প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি)। জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাঝে রয়েছে আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি গৃহকর্মীদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি সর্বদা তাদের প্রয়োজন পূরণ করতেন। কাজে-কর্মে তাদের কৃত ভুলত্রুটির জন্য রাগ ও তিরস্কার করতেন না। তাই ইসলামী শরিয়তের চাহিদা হলো : কাজ-কর্মে গৃহকর্মীদের সঙ্গে কঠোরতা প্রদর্শন না করে তাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করা। হজরত আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি ১০ বছর যাবৎ রসুল (সা.)-এর সেবা করেছি। আল্লাহর কসম! তিনি কখনো আমার বেলায় “উহ” শব্দটি উচ্চারণ করেননি (অসন্তুষ্টির ভাব প্রকাশ করেননি)। অথবা কখনো আমাকে কোনো কাজের জন্য এতটুকুও বলেননি যে, কেন এমনটা করেছ? কেন এমন করনি?’ (মুসলিম)। সামান্য ভুলত্রুটি ও কর্মে অমনোযোগিতার কারণে গৃহকর্মীদের মারধর ও অপমান করা যাবে না। কিন্তু আজ সভ্যতার উৎকর্ষে আমাদের বর্তমান সময়ে মানবতা বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়তই পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মীদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করা হচ্ছে। তাদের ঠিকমতো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান দেওয়া হচ্ছে না। শোনা যায়, ওইসব বাড়ির কর্তারা নাকি আবার উচ্চশিক্ষিত! ধিক! তাদের এ ধরনের শিক্ষাকে। যেন খুব কৌশল করে আবারও আইয়ামে জাহিলিয়াতের সূচনা করছে। অথচ শান্তি, নিরাপত্তা ও মানবতার ধর্ম ইসলামে গৃহকর্মীদের মারধর ও অপমান করতে নিষেধ করা হয়েছে। রসুল (সা.) কখনো কোনো ক্রীতদাসকে মারধর করেননি। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রসুল (সা.) কোনো দিন কাউকে নিজ হাতে প্রহার করেননি। এমনকি কোনো মহিলা ও খাদিমকেও মারধর করেননি। কেবল আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়েছে।’ (মুসলিম)। হজরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘একদা রসুল (সা.) দুজন গৃহকর্মীকে নিয়ে এলেন। একজনকে হজরত আলী (রা.)-কে দিলেন। তখন তিনি বলেন, দেখো! তাকে মারধর করবে না। কেননা, নামাজিকে মারধর করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন।’ (আল আদাবুল মুফরাদ)।

রসুল (সা.) বলেন, ‘যে তার গৃহকর্মীকে চপেটাঘাত করল, অথবা শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছাড়াই প্রহার করল, তার মাশুল হলো— সে তাকে মুক্ত করে দেবে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ)।

বলা হয়, ক্ষমা হলো মহৎ গুণ। অনেক সময় আমাদের গৃহকর্মীরা ভুল করে। দেখা যায়, একই ভুল তারা বার বার করে। কেননা, ভুল করা মানুষের মজ্জাগত অভ্যাস, কেউই তা থেকে মুক্ত নয়। তাই গৃহকর্মীদের কৃত অপরাধের শাস্তি না দিয়ে তাদের ক্ষমা করা উত্তম। এ অবস্থায় আমাদের উচিত তাদের এ ভুলের ওপর ধৈর্যধারণ করা। তাদের সদুপদেশ দেওয়া। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার এক ব্যক্তি রসুল (সা.)-এর কাছে এসে বললেন : ‘হে আল্লাহর রসুল (সা.)! আমি আমার গৃহকর্মীকে কতবার ক্ষমা করব? নবী করিম (সা.) তার প্রশ্নে চুপ থাকলে সে আবারও একই প্রশ্ন করে। তখনো তিনি চুপ থাকেন। লোকটি তৃতীয়বার একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, তোমরা তাদের প্রতিদিন সত্তর বার ক্ষমা করবে।’ (সুনানে আবু দাউদ)।

শান্তির ধর্ম ইসলামে গৃহকর্মীর (চাকর ও কর্মচারী) অধিকার সংরক্ষিত। তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। বিশ্বনবীর গোলাম হজরত আনাস (রা.) ১০ বছর তার সেবা করার পর বলেছেন, তিনি কখনো আমার ব্যাপারে ‘উহ’ শব্দটি ব্যবহার করেননি।

খুতবা লেখক : ড. মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আযহারী।

সর্বশেষ খবর