সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজনীতির জন্য এখনই উপযুক্ত রেনেসাঁর সময়

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

রাজনীতির জন্য এখনই উপযুক্ত রেনেসাঁর সময়

রেনেসাঁ ফরাসি শব্দ, যার ইংরেজি হচ্ছে রি-বার্থ, অর্থাৎ পুনর্জন্ম। চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী, এই সময়ে ইউরোপের কলা, সাহিত্য ও দর্শন শাস্ত্রে ধ্রুপদী অর্থাৎ প্রাচীন গ্রিক ও রোমের আলোকিত ধারার পুনরুত্থানকে উনিশ শতকের সংস্কৃতির ইতিহাসবিদগণ রেনেসাঁ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। রেনেসাঁ আন্দোলনকারীরা কলা, সাহিত্য ও দর্শন শাস্ত্রের পাশাপাশি পৃথিবীর সব কিছু শুধুমাত্র চার্চ (গির্জা) কেন্দ্রিক ধর্মীয় গোঁড়ামিপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গির বিবেচনা থেকে বের করে মানুষের অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করেন সব কিছুর কেন্দ্রস্থলে। চতুর্দশ শতকে ইতালির বিখ্যাত কবি পেটর‌্যাক (১৩০৪-৭৪) সর্বপ্রথম ইউরোপের ডার্ক এইজ বা অন্ধকার যুগের অসারতা ও ভয়াবহতাকে তুলে ধরেন এবং এর থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য প্রাচীন গ্রিক ও রোম সভ্যতার আলোকিত দর্শনের দিকে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এখান থেকেই ইউরোপের রেনেসাঁর যাত্রা শুরু। এ সময়ের বহুল ব্যবহূত মানবতাবাদ বা হিউম্যানইজমের জনক বলা হয় কবি পেটর‌্যাককে। অ্যাডওয়ার্ড গিবনের বিখ্যাত বই ‘The Declinc and Fall of the Roman Empire’ গ্রন্থের বর্ণনায় আছে প্রাচীন গ্রিকদের থেকে প্রাপ্ত সেক্যুলার ও আলোকিত মূল্যবোধকে পরিত্যাগ করে যখন চার্চকেন্দ্রিক অযৌক্তিক খ্রিস্টবাদের অন্ধত্ব ও অসহিষ্ণুতা শাসন ব্যবস্থার অবলম্বন হয়ে ওঠে তখন থেকেই রোমান সাম্রাজ্যের পতনের যাত্রা শুরু হয়। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটাইন খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বানিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দেন। তারই ধারাবাহিকতায় চার্চকেন্দ্রিক হলি রোমান সাম্রাজ্যের আবির্ভাব, যেখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রধান ভূমিকায় আসেন প্রধান ধর্মগুরু পোপ। ধর্মগুরুদের চরম বাড়াবাড়ি, অনৈতিকতা এবং একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে ১৫২৯ সালে খ্রিস্টধর্ম বিভক্ত হয়ে প্রোটেস্ট্যান্ট অংশের আবির্ভাব। তারপর থেকে ইউরোপব্যাপী ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদি ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ। ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩০ বছর দুই পক্ষের ধর্ম রক্ষার যুদ্ধে কয়েক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু এবং ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতায় ইউরোপ এক বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। ৩০ বছরের যুদ্ধে সমগ্র ইউরোপের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়। খাদ্যাভাবে মানুষ অন্য মানুষের মাংস খেতে বাধ্য হয় বলে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বর্ণনা করেছেন। ১৬৪৮ সালে জার্মানির ওয়েস্টফেলিয়া নগরে দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটে। চুক্তিটি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে ওয়েস্টফেলিয়া শান্তি চুক্তি নামে। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউরোপের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চার্চকেন্দ্রিক ধর্মগুরুদের শাসনের অবসান ঘটে। হলি রোমান অ্যাম্পায়ার সংকুচিত হয়।

সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে রেনেসাঁ, তারপর ধর্মতান্ত্রিকতামুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থার হাত ধরে এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকিত যুগে প্রবেশ করে ইউরোপ, যেখানে ফ্রান্সের দার্শনিক রেনি ডেসকটিস (১৫৯৬-১৬৫০), ভলতিয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮), মল্টিসকিউ (১৬৮৯-১৭৫৫) এবং ইংলিক দার্শনিক জনলক (১৬৩২-১৭০৪) ইউরোপকে জ্ঞানভিত্তিক যৌক্তিকতায় ফিরিয়ে আনতে শুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৬৩৭ সালে রেনি ডেসকার্টিস তত্ত্ব দেন, কোনো ডিসকোর্সই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয় এবং যুক্তিহীন কোনো কিছু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ১৬৮৬-৮৭ তে নিউটনের গতিসূত্র এবং গ্রাভিটেশন থিওরি ধর্মবত্তাদের সব পৌরাণিক তত্ত্বকে অসার করে দেয়। এনলাইটেনমেন্ট যুগের প্রভাবে সংঘটিত হয় ইংলিশ রেভ্যুলেশন (১৬৪২-৫১), ফ্রেন্স রেভ্যুলেশন (১৭৮৯) এবং আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ। সুতরাং প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সভ্যতার চিরন্তন মূল্যবোধ রেনেসাঁ (পুনর্জন্ম) আন্দোলনের মাধ্যমে ফিরে এসেছিল বলেই ইউরোপ নতুন আধুনিক আলোকসমৃদ্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। তারপর থেকে ইউরোপকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তী দুইশ থেকে আড়াইশ বছর তারা পুরো পৃথিবীকে শাসন করেছে। আজকের প্রবন্ধের মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু লম্বা প্রেক্ষাপটের উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে আধুনিক আলোকসমৃদ্ধ দর্শন প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও সেটির শেকড় প্রসারিত হয়ে শক্ত হওয়ার আগেই একাত্তরের পরাজিত গোষ্ঠী ১৯৭৫ সালে সেটিকে উপড়ে ফেলে পরিত্যক্ত ও অন্ধত্বপূর্ণ পাকিস্তানিতন্ত্রকে ফিরিয়ে এনে বাংলাদেশকে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজনীতির মধ্যে ফেলে দেয়। ক্রিশ্চিয়ানইজমকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কেন্দ্রে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে ইউরোপ যেমন অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছিল, তেমনি ১৯৭৫ সালের পরে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মকে টেনে আনার ফলে বাংলাদেশও রাজনীতির অন্ধকার যুগে ঢুকে যায়। হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্র হয়ে দাঁড়ায় এই রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। ফলে হুন্ডা, গুণ্ডা, দুর্নীতি, কালো টাকা এবং পবিত্র ইসলাম ধর্মের চরম অপব্যবহারে রাজনীতি হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের জন্য বিষফোঁড়া স্বরূপ। মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ে কালো টাকার রাজনীতির কাছে। হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশকে একটি মনোলিথিক ধর্মীয় রাষ্ট্র বানানোর জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ধর্মীয়সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উত্খাত ও বিতাড়নের কাজ চলে। পরপর দুজন সামরিক শাসক ১৪ বছর ধরে অস্ত্রের জোরে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজনীতিকে এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সক্ষম হয়। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজনীতির সবচেয়ে সুবিধাভোগী দল বিএনপি। জিয়াউর রহমানের আমল, এরশাদের আমল এবং বিএনপির সাম্প্রতিক আমল মিলে দীর্ঘ সময় এই রাজনীতির প্রাধান্য থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, মিডিয়াসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র একটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যারা এই রাজনীতিকে বাংলাদেশে টিকিয়ে রাখতে চায়। তাছাড়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের লেগেসির সূত্রে বাইডিফল্ট দেশের প্রায় শতকরা পঁচিশ ভাগ মানুষ মরিয়া হয়ে ওই রাজনীতির পক্ষে। শতকরা ২৫ ভাগ হলেও ১৬ কোটি জনসংখ্যার হিসাবে বিরাট সংখ্যক মানুষের সমর্থন তাদের প্রতি থাকায় বিএনপিসহ ওইসব রাজনৈতিক দল ওই জায়গায়ই অটল থাকতে চায়। তাই সংগত কারণে মুক্তিযুদ্ধের দর্শন সংবলিত আলোকিত মূল্যবোধের রাজনীতি এখনো বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারেনি। তবে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জামায়াত-বিএনপি সরকারের দুঃশাসন, দুর্নীতি, উগ্র জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর উত্থান এবং তারপর থেকে এ পর্যন্ত একের পর এক ভুল রাজনৈতিক কৌশল ও ষড়যন্ত্র এবং ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথে হাঁটার কারণে আজ এ সময়ে এসে বিএনপি মহারাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। বেগম খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে জেলে যাওয়ার কারণে এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। বিএনপির মধ্যে সুষ্ঠু আচরণের একটা লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে। বহু হুমকি-ধমকি, হুঙ্কার দেওয়ার পরও বিএনপি শান্তিপূর্ণ পন্থায় থাকতে বাধ্য হয়েছে। গত আড়াই-তিন বছর আগের মতো হরতাল-অবরোধ এবং জ্বালাও-পোড়াওয়ের ধ্বংসাত্মক পথে তারা যায়নি। আগামী দিনে অন্য রাজনৈতিক দল, যারাই বিরোধী দলে থাকুক তারাও হরতাল-অবরোধের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচি দিতে পারবে না। নৈরাজ্যের পথ ছেড়ে রাজনীতি সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ ধারায় ফিরে আসার পথে এটিকে অবশ্যই একটি ইতিবাচক পরিবর্তন বলা যায়। দুর্নীতির মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার দণ্ড ও জেলে যাওয়া বর্তমান ও আগামী দিনের সব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। তারা সতর্ক হলে রাষ্ট্র ও সমাজের অন্য অঙ্গনেও তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। সুতরাং আলোচ্য বিচার ও দণ্ডপ্রাপ্তি অবশ্যই সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রগামী ভূমিকা রাখবে। আর সুশাসন এলে রাজনীতিও সুপথে আসবে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থই কালো টাকা হিসেবে ভোটের রাজনীতিতে ব্যাপকহারে ব্যবহূত হয় বলে সৎ, ন্যায়পরায়ণ এবং সত্যিকার অর্থে জনসেবার মানসিকতা যাদের রয়েছে তারা রাজনীতিতে আসতে পারছেন না। সুষ্ঠু রাজনীতির পথে আরেকটি বাধা অবৈধ অস্ত্র, সেটিও জোগাড় হয় কালো টাকা, অর্থাৎ দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার দ্বারা। সুতরাং দুর্নীতি হ্রাস পেলে রাজনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই বিগত কয়েক বছরের ঘটনা প্রবাহের পথ ধরে এবং তার সঙ্গে সাম্প্রতিক চালচিত্র, সব মিলিয়ে এই সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি একটা টার্নিং পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। টার্নিংটি সুসম্পন্ন হলে রাজনীতির গুণগতমান ফিরবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। কিন্তু শুধু এ পর্যন্ত থেমে গেলে মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আলোকিত মূল্যবোধের রাজনীতিতে ফেরা হবে না। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার রহিতকরণসহ ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি থেকে বের হতে পারলেই কেবল সেটা হবে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য রেনেসাঁ। নিজেদের ভুল এবং উদার আধুনিক সেক্যুলার দর্শনের চিরন্তন ও ইউনিভারসাল আবেদনের ধাক্কায় মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের বিরুদ্ধবাদী এবং ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে যারা এতদিন টিকিয়ে রেখেছে তারা অনেকটাই এখন পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। নিজেদের উপলব্ধিতে সময়ের চাহিদাকে তারা যদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়, তাহলে রাজনীতিতে আকাঙ্ক্ষিত রেনেসাঁ সহজেই অর্জিত হতে পারে। কিন্তু তাদের এমন সুমতি হবে তা এখনো বিশ্বাস করা কঠিন। তাই মুক্তিযুদ্ধের দর্শনে বিশ্বাসী সমস্ত রাজনৈতিক দল যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই সময়ের সুযোগটিকে কাজে লাগাতে পারে তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এখনই উপযুক্ত রেনেসাঁর সময়।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

নিউ অরলিনস, ইউএসএ

            [email protected]

সর্বশেষ খবর