রবিবার, ১৮ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ক্লিনটন-মনিকা এবং সেই মেয়েটির আর্তনাদ

গোলাম মাওলা রনি

ক্লিনটন-মনিকা এবং সেই মেয়েটির আর্তনাদ

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের দুনিয়া কাঁপানো প্রণয়িনী মনিকার একটি সাম্প্রতিক মন্তব্য বিশ্ব মিডিয়ার শিরোনাম হয়েছিল। ক্লিনটনের সঙ্গে তার তথাকথিত প্রেম ও প্রণয় নিয়ে তিনি চমৎকার একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, তার ও বিল ক্লিনটনের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কোনো প্রেম ছিল না। ক্লিনটন তার প্রভাব, মোহনীয় ব্যক্তিত্ব এবং ছলচাতুরীর কলাকৌশল  দ্বারা ২২ বছর বয়সী মনিকাকে এমনভাবে ফাঁদে ফেলেছিলেন যেখান থেকে বের হওয়া একজন তরুণীর পক্ষে অসম্ভব।  মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের রাজকীয় ও বর্ণাঢ্য আকর্ষণের সুর লহরী নিয়ে একজন নিম্নপদস্থ শিক্ষানবিস কর্মচারীর সামনে যখন ক্লিনটন প্রেমের সংগীত বাজিয়েছিলেন তখন তার কন্যার বয়সী অর্থাৎ ক্লিনটনের চেয়ে ২৭ বছরের ছোট মনিকা লিউনিস্কি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন বয়স্ক পুরুষের বিকৃত যৌন লালসার অগ্নিকুণ্ডে।

ক্লিনটন-মনিকা স্ক্যান্ডাল এক সময় সারা পৃথিবীতে ঝড় তুলেছিল। ১৯৯৫-৯৭ সালে মনিকা যখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিসে শিক্ষানবিস কর্মচারী হিসেবে কাজ করছিলেন তখন ক্লিনটনের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়।  বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সারা বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়। মার্কিন বিচার বিভাগ বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কেনেথ স্টার নামক একজন বিজ্ঞ আইনবিদকে নিয়োগ দিলে পরিস্থিতি গুরুতর আকার ধারণ করে। কেনেথ স্টারের কাছে প্রদত্ত সাক্ষ্য এবং পরবর্তী জেরায় ক্লিনটন-মনিকার যৌন সম্পর্ক নিয়ে এমনসব তথ্য বের হয়ে আসে যা বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দেয়। ক্লিনটনবিরোধীরা তাকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরানোর জন্য যেমন প্রাণান্ত চেষ্টা করতে থাকেন তেমনি দেশ-বিদেশের সমাজবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা নরনারীর মনোজাগতিক ও দৈহিক রসায়ন নিয়ে নতুন গবেষণা শুরু করেন।

ক্লিনটন-মনিকার অবৈধ প্রণয়ের জেরে শুরু হওয়া রাজনৈতিক ঝড় শেষ হলেও এ সম্পর্কের আদিঅন্ত নিয়ে মনুষের আগ্রহ একটুও কমেনি। একজন ৪৯ বছর বয়স্ক অসাধারণ মেধাবী, অতিশয় সুদর্শন, চৌকস ব্যক্তিত্ববান, সুন্দরী স্ত্রীর স্বামী এবং প্রতিভাময়ী কন্যা সন্তানের জনক হওয়ার পরও কেন এবং কীভাবে ক্লিনটন একটি জঘন্য সম্পর্কে জড়িয়ে গেলেন এমনতরো প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বিশ্বখ্যাত মনোবিজ্ঞানীরা যে মতামত ব্যক্ত করেছিলেন ঠিক সে কথাগুলোই প্রায় দুই যুগ পর মনিকা লিউনিস্কি স্বীকার করে নিলেন। মনিকার মতে—ক্লিনটন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ ক্লিনটন যদি প্রেসিডেন্ট না হতেন এবং মনিকা যদি তার অধীনে ছোট একটি চাকরি না করতেন তাহলে হয়তো অসম প্রণয়টি হতো না। অধিকন্তু নিজের বাহারী যৌন অভিজ্ঞতার বিচিত্র কলাকৌশল ছলচাতুরী করে যখন একজন ২২ বছর বয়সী অনভিজ্ঞ তরুণীর ওপর প্রয়োগ করা হয়েছিল তখন তার শরীর ও মনে যে রসায়ন সৃষ্টি হয়েছিল সেটাকে পুঁজি করেই ক্লিনটন তার অভিলাস চরিতার্থ করার সুযোগ নিয়েছিলেন।

নারী-পুরুষের প্রেম প্রণয় ও যৌন সম্পর্ক নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের মতে প্রেম একটি সম্পূর্ণ অপার্থিব বিষয়, যার সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক খুবই কম। প্রেমকে কেন্দ্র করে প্রণয় ও দাম্পত্য একটি অনাদিকালের চিরায়ত উপাখ্যান। কিন্তু প্রেমের ফাঁদ সৃষ্টি করে যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার অভিলাষ মানব মনের জটিল একটি ব্যাধি। সাধারণত সুস্থ ও সবল নরনারীরা প্রেম-প্রণয় এবং পরিণয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। অন্যদিকে বিকৃত মানসিকতার ব্যাধিগ্রস্ত মস্তিষ্ক সেই অনাদিকাল থেকেই প্রেমের ফাঁদে ফেলে যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য সর্বদা সর্বাত্মক চেষ্টা-তদবির করে। এক্ষেত্রে নারী কিংবা পুরুষ কোনো বিশেষ শ্রেণিকে আলাদাভাবে কিংবা এককভাবে দায়ী করা যাবে না। বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন এবং পদ-পদবিধারী নারী কিংবা পুরুষ সময় ও সুযোগ পেলেই নিজেদের যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করে থাকে এবং এ কাজ করতে গিয়ে তারা হত্যা, যখম, গুম, ধর্ষণ ইত্যাদির মতো ফৌজদারি অপরাধ পর্যন্ত করে বসে। প্রভাবশালী ও সুদর্শন পুরুষ যেমন দিবানিশি ব্যাধিগ্রস্ত মস্তিষ্ক ও পাপী মন নিয়ে যৌনদাসী খুঁজে বেড়ায় তদ্রূপ ক্ষমতাশালী সুন্দরী ললনাদের ব্যাধিগ্রস্ত মস্তিষ্কের যৌনদাস শিকারের লিপ্সা আরও ভয়ঙ্কর এবং জটিল প্রকৃতির হয়ে থাকে।

অর্থবিত্ত এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী সুদর্শন পুরুষ এবং সুন্দরী নারীরা সাধারণত প্রেমের ফাঁদ তৈরি করে আসছে সেই অনাদিকাল থেকে। রাজা-বাদশাহদের হেরেম কিংবা রানী মহারানীদের একাধিক প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমের ফাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই। ক্ষমতাবান নারী-পুরুষের বহুগামিতার অভ্যাস থেকেই পুরুষের জীবনে বহু নারীর সংসর্গ কিংবা নারীর জীবনে বহু পুরুষের স্পর্শ অপরিহার্য ব্যাধিতে পরিণত হয়। পৃথিবীর অনেক নামকরা সম্রাট কিংবা সম্রাজ্ঞীর বিরুদ্ধে বহুগামিতার অভিযোগ ছিল। কিন্তু ক্লিনটনের মতো প্রেমের ফাঁদ সৃষ্টি করে অসম ও অবৈধ সম্পর্ক সৃষ্টি করে সময় ও সুযোগ মতো যৌন সঙ্গিনীকে দূরে ঠেলে দেওয়া বা তার কোনো দায়দায়িত্ব না নেওয়ার মানসিকতার সঙ্গে বহুগামিতা ও বহুবিবাহের আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, নর-নারীরা কেন ও কীভাবে প্রেমের ফাঁদ পাতে এবং কী প্রকারে তা বাস্তবায়ন করে!

পশ্চিমা মনোবিজ্ঞানীদের মতে— নারী ও পুরুষেরা যখন নিজেদের যৌনতার আকর্ষণ ও আবেদনময়তার ব্যাপারে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে ঠিক তখন থেকেই তাদের দেহমন ধীরে ধীরে ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তারা কথাবার্তা, পোশাক-আশাক, হাঁটাচলা ইত্যাদিতে নিজেদের যৌন আকর্ষণ ফুটিয়ে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা করতে করতে একসময় বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে যে, তাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য আশপাশের লোকজন পাগলপারা হয়ে আছে। সুতরাং এটা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে তাদের নিজেদের বিশেষ রূপ-যৌবনের অংশীদার বা ভাগিদার বানিয়ে নেওয়া। নর-নারীদের এ মনোবৃত্তিকে ইংরেজিতে বলা হয়েছে সিডাক্সেন। সিডাক্সেনে আক্রান্ত নারী-পুরুষেরা সর্বদা নিজেদের সর্বসেরা ও আকর্ষণীয় সেক্সবোম বলে মনে করে এবং স্থান-কাল-পাত্র ভুলে তারা সর্বদা এবং সর্বাবস্থায় নিজেদের যৌন আকর্ষণকে জনসম্মুখে ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে থাকে।

সিডাক্সেনে আক্রান্ত নারী কিংবা পুরুষেরা নিজেদের লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য অদ্ভুত সব ফাঁদ পাতে। তারা কখনো নিজেদের রূপ-যৌবন আবার কখনোবা পদপদবি কিংবা অর্থবিত্তকে পণ্য বানিয়ে প্রতিপক্ষকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। তারা নিজেদের পণ্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এবং রংচঙে বর্ণিল করে প্রতিপক্ষের মনে কামনা-বাসনার সৃষ্টি করে। কিন্তু শিকার সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা শিকারের পেছনে লেগে থাকে। তারা মিথ্যাচার, প্রতারণা ও ছলচাতুরীর মাধ্যমে শিকারের কাছে নিজেদের বহুগুণ বড় করে উপস্থাপন করে। তারপর রূপ যৌবন, বাকচাতুর্য ও বিত্তের সমন্বয়ে তৈরি করা প্রতারণার জালে প্রতিপক্ষকে বন্দী করে ফেলে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরিপূর্ণভাবে সফল হয় অর্থাৎ নিরাপদে নিজেদের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করে সিটকে পড়তে পারে অথবা যৌনসঙ্গীর কোনো দায়দায়িত্ব না নিয়ে নিরাপদে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতে পারে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাঝপথে এসে সবকিছু এলোমেলো করে ফেলে। অর্থাৎ তাদের জারিজুরি যখন ফাঁস হয়ে যায় তখন পরিস্থিতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য অনেকে ফৌজদারি অপরাধ পর্যন্ত করে বসে। সিডাক্সিনে আক্রান্ত বুদ্ধিমান ও সতর্ক শ্রেণির নারী-পুরুষরা অবশ্য ভিন্নভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়। তারা যখন বুঝতে পারে, তাদের প্রতারণার ফাঁদে কিছুতেই কাঙ্ক্ষিত নর বা নারীকে জড়ানো যাচ্ছে না কিংবা জড়ানো গেলেও শেষমেশ তার সঙ্গে প্রতারণা করা যাবে না তখন তারা লেজ গুটিয়ে হঠাৎ উল্টোপথে উধাও হয়ে যায়।

আমাদের সমাজে সিডাক্সিনে আক্রান্ত নারী-পুরুষের প্রেমের ফাঁদ ও প্রতারণার কাহিনী সাধারণত পত্রপত্রিকায় শিরোনাম হয় না। কারণ সমাজের উঁচুতলার নারী কিংবা পুরুষেরা নিজেদের পদপদবি, ক্ষমতা ও অর্থবিত্ত ব্যবহার করে যখন একটি অসম প্রণয়ের জন্য ফাঁদ পাতে তখন ভুক্তভোগীরা সেই ফাঁদে পড়ে প্রথমত আক্রান্ত এবং দ্বিতীয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের জনৈক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তার যৌন কেলেঙ্কারি বিয়ে নামক প্রতারণার ফাঁদ সারা দেশ তোলপাড় করেছিল। এ ঘটনার আগে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত কাস্টমস কমিশনারের ফাঁদে পড়ে জনৈকা নারী তার স্বামীকে খুন করতে প্ররোচিত হয়। আমাদের সমাজের তথাকথিত উঁচুতলায় কী ধরনের বাহারী প্রতারণার মাধ্যমে অসম প্রেমের অনৈতিক কর্ম চলে তার একটি উদাহরণ দিতে চাই ‘সেই মেয়েটির আর্তনাদ’ শিরোনামের একটি কল্পিত কাহিনীর মাধ্যমে।

মেয়েটির বয়স মাত্র ২৪ বছর। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়নরত। অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়েটিকে দেখে সহসা কেউ বুঝতে পারবেন না যে, তার মায়াবী চোখ দুটির অন্তরালে কত বড় বেদনার অশ্রুগ্রন্থি রয়েছে। একটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ও ভদ্র পরিবারের মেয়েটি গত ছয় বছর ধরে বৈধব্যের জীবনযাপন করছেন। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করার সময় হঠাৎ একটি দুর্ঘটনার কারণে মেয়েটির কিছু শারীরিক ত্রুটি দেখা দেয়। দেশ-বিদেশের নানামুখী চিকিৎসায় মেয়েটি সুস্থ হয় বটে কিন্তু ডাক্তাররা পরামর্শ দেন অতি দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণ দেরিতে বিয়ে হলে মেয়েটির আর সন্তান ধারণ করার ক্ষমতা থাকবে না। এ অবস্থায় পারিবারিক পছন্দে তড়িঘড়ি করে প্রায় অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হয় এবং তার চেয়েও দ্রুততরভাবে একটি কন্যা সন্তানের মা হওয়ার কিয়ৎকাল পরে স্বামীর অকাল প্রয়াণে বৈধব্য বরণ করে।

স্বামী মারা যাওয়ার পর কিশোরী মেয়েটি তার শিশু সন্তানটিকে নিয়ে যেন বিপদের মহাসাগরে নিপতিত হয়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন মেয়েটিকে এবং তার নবজাতক কন্যাকে অপয়া ভেবে তখন তুচ্ছতাচ্ছিল্য আরম্ভ করে, যার কারণে সে পিত্রালয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এর কিছু দিন পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তার মৃত স্বামীর যাবতীয় সহায়সম্পত্তি ও অর্থবিত্ত করায়ত্ত করে ফেলে। মেয়েটি তার বাবাকে নিয়ে বিভিন্ন মহলে দেনদরবার করে স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কারণ শ্বশুর পক্ষের লোকেরা স্থানীয়ভাবে অতিশয় প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মেয়েটি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে পুনরায় পড়াশোনা শুরু করে এবং ভালো ফলাফল করে কৃতিত্বের সঙ্গে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে। জীবনযুদ্ধের এক জটিল সমীকরণের মধ্যে পড়ে মেয়েটি এবং তার পরিবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না— তাদের আসলে কী করা উচিত। মেয়েটি কি সারাজীবন বিধবা হিসেবে কাটিয়ে দেবে নাকি পুনরায় দেখেশুনে বিয়েশাদি করবে। অথবা সে কি পুনরায় স্বামীর ভিটায় ফিরে যাওয়ার সংগ্রাম করবে নাকি স্বামীর সম্পত্তির অধিকার ছেড়ে পিতার গলগ্রহ হয়ে অথবা একটা চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করবে।

মেয়েটির জীবনে যখন উপরোক্ত অনিশ্চয়তার দোলাচল চলছিল ঠিক তখনই সিডাক্সিনে আক্রান্ত প্রভাবশালী এক বয়স্ক রাজনীতিবিদ কাম ব্যবসায়ীর নজর পড়ে মেয়েটির ওপর। ভদ্রলোকের সঙ্গে তার বয়সের পার্থক্য প্রায় ৩০ বছর অর্থাৎ মেয়েটির বাবার বয়সের চেয়েও ভদ্রলোকের বয়স তিন-চার বছর বেশি। তিনিও কিছুকাল আগে বিপত্নীক হয়েছেন। অঢেল অর্থ, দেশব্যাপী পরিচিতি, সুদর্শন চেহারা, মেয়ে পটানোমূলক কথাবার্তার চৌকসতা এবং নিজের মাতৃহারা মাত্র ১০ বছরের একটি ছেলে সন্তানকে উপস্থাপন করে তিনি মেয়েটির পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মেয়েটির পরিবার রাজি হয়ে গেল এবং আনুষ্ঠানিকভাবে পাত্রপাত্রীর পারস্পরিক দেখা সাক্ষাতের জন্য ঢাকার পূর্বাচলের একটি মনোরম লোকেশন ঠিক করা হলো। ভদ্রলোক মেয়েটির ফোন নম্বরে রাতের পর রাত নানারকম কথাবার্তা বলে তাকে এমনভাবে স্বপ্ন দেখাতে লাগলেন যার কারণে মেয়েটিও বিয়ের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব এবং ভদ্রলোকের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলেন।

নির্দিষ্ট দিনে ভদ্রলোক তার দুটো রাজকীয় গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন মেয়েটির বাড়ির সামনে। মেয়েটি তার ছোট বোন ও কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো ভদ্রলোকের মুখোমুখি হলেন। ভদ্রলোক ও তার মাতৃহারা সন্তানটিকে নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে পরিচিত হলেন। পূর্বাচল যাওয়ার পথে ভদ্রলোক তার গাড়ি, বাড়ি, প্লট, জায়গাজমি, মিল-কারখানা, ব্যাংক-বীমা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদির মালিকানা ফিরিস্তি দিয়ে মেয়েটিকে প্রলুব্ধ ও বশীভূত করার চেষ্টা করলেন। বিয়ের পর কোন দেশে হানিমুন, কীভাবে ফ্ল্যাট সাজাবেন এবং মেয়েটির কন্যাকে দত্তক কীভাবে নেবেন ইত্যাদি বলে পুরো পরিস্থিতিকে আবেগময় করে তুললেন। এরপর পূর্বাচলে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি এবং রাতে একটি হোটেলে খেয়েদেয়ে মেয়েটিকে বাড়ি পৌঁছানোর জন্য গাড়িতে ওঠে বসলেন। রাতের আঁধারে গাড়ি এগিয়ে চলছিল। ভদ্রলোক এবার কৌশল করে তার পুত্র ও মেয়েটির কন্যাকে ভিন্ন গাড়িতে উঠিয়ে নিজেরা একান্ত কথা বলার জন্য এক গাড়িতে পাশাপাশি বসলেন। তারপর হঠাৎ কোনো কথা না বলে প্রথমে একটি হাত মেয়েটির হাতের ওপর রাখলেন এবং পরে অন্য হাত মেয়েটির কাঁধ, গণ্ডদেশ প্রভৃতি স্থানে রেখে তাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করলেন।

মেয়েটি তার বাসায় ফিরে রুমে ঢুকে বহুক্ষণ কাঁদলেন। কাউকে কিছু বলতে পারলেন না। অন্যদিকে তার পরিবার বিয়ের আশায় বাড়িঘর নতুন করে সাজাতে আরম্ভ করলেন। ভদ্রলোক গভীর রাতে মেয়েটিকে ফোন করে নানা কথা বলে তাকে পুনরায় স্বাভাবিক করলেন। এরপর প্রায় প্রতি রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নানা সুড়সুড়িমূলক কথাবার্তা বলে মেয়েটিকে যৌনতার ফাঁদে আটকানোর জন্য বিয়ের আগে বিদেশ ভ্রমণ, তার গুলশানের বাসায় আসার নিমন্ত্রণ অথবা ঢাকার বাইরে কোনো রিসোর্টে বেড়িয়ে আসার প্রস্তাব দিয়ে তাকে রাজি করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। মেয়েটি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে তিনি একজন মন্দ স্বভাবের ভণ্ড ও প্রতারকের কবলে পড়েছেন। তবুও তিনি মুখ ফুটে কিছু না বলে কেবল বিয়ের ব্যাপারে চাপ দিতে লাগলেন।  কিন্তু ভদ্রলোক বিয়ের কথা শুনলেই তার বড় ভাই, শ্যালিকা ও অন্যান্য মুরব্বির অনুমতি সংক্রান্ত বিরাট এক আমলাতান্ত্রিক জটিলতার প্রসঙ্গ তুলে খাজুরে আলাপে মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করেন।  এ অবস্থায় হঠাৎ মেয়েটি একদিন ভদ্রলোককে ফোন করলেন এবং স্পস্ট ভাষায় বলে দিলেন যে, আপনার সঙ্গে বিয়েশাদি সম্ভব নয়। মেয়েটির কথা শুনে ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পড়লেন।  তিনি চক্রান্তের নতুন এক প্লট রচনা করে পুনরায় জটিল এক ফাঁদ পাতলেন শিকারকে ধরাশায়ী করার জন্য।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর