সোমবার, ১৯ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বর্তমান সমাজে ও সময়ে নারীরা কতটা স্বাধীন!

নবনীতা চক্রবর্তী

বর্তমান সমাজে ও সময়ে নারীরা কতটা স্বাধীন!

এখন স্বাধীনতার মাস। কালের হাত ধরে বহু বেদনার সাক্ষী আমরা। অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন। তাই স্বাধীনতা শব্দটি বড় প্রিয় আমাদের কাছে, বড় মূল্যবান। মানুষ মাত্র স্বাধীন থাকতে চায়, স্বাধীনভাবে ভাবতে চায়, বলতে চায়। কিন্তু সবসময় কি তা পারা যায়? ধরা যাক নারীকুলের কথা, বর্তমান সমাজে ও সময়ে তারা কতটা স্বাধীন! অনেক বড় একটি প্রশ্ন এটি, হয়তো অনেকে ভ্রু কুঁচকে বলবেন, এখনকার থেকে মেয়েরা আর কবে এত স্বাধীন ছিল, এখন মেয়েরা ঘরের বাইরে যাচ্ছে, চাকরি করছে, সংসার করছে, অমুক-তমুক কত শত সুবিধা তাদের জন্য বরাদ্দ ইত্যাদি ইত্যাদি। আগের যুগে এরকম ছিল নাকি, আহা সে সময় তো মেয়েদের অসূর্যস্পশ্যা দশা ছিল। এখন মেয়েরা মুক্ত-স্বাধীন। সত্যি কি তাই! এখনো তো মেয়েদের জীবন শুরু হয় মেয়েমানুষ নাম নিয়ে। তাকে উঠতে-বসতে এটাই ভাবানো হয়, তুমি একটা মেয়ে। তাকে শিক্ষা দেওয়া হয় কীভাবে সে সারা জীবন মেয়েমানুষ হয়ে থাকতে হবে। মেয়েদের এভাবে কথা বলতে নেই, এভাবে চলতে নেই, এভাবে ভাবতে নেই, শুধু নেই আর নেই। তাকে হয়ে থাকতে হবে লক্ষ্মী, সাত চড়েও যার মুখে রা থাকবে না, সে হবে সর্বংসহা, যার সহ্যশক্তি অসীম, পরিবারের মান-সম্মানের ভার শুধু একা তার। কোনো ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে দেখতে হয় চোখ রাঙানি, মেয়ে আর ছেলেতে কখনো বন্ধুত্ব হয় নাকি? আর প্রেম যদি হয়েও যায় তবে তার সমস্ত দায় তোমার, প্রাণপণ যুদ্ধ করে যেতে হবে সেটাকে মধুর রাখার জন্য, নইলে তোমার সুন্দর মুহূর্তগুলো নিমিষেই কুিসত হয়ে ঘুরতে থাকবে মুঠোফোনে ফোনে। সাইবার আইন কোনো কাজেই লাগবে না, কারণ তুমি মেয়ে, একবার বদনাম যদি তোমায় স্পর্শ করে, তবে সভ্যসমাজ তোমাকে অস্পৃশ্য ঘোষণা করবে। ইচ্ছা হলেই সাইকেল নিয়ে ছুট লাগাতে পারবে না, পারবে না রাতের আকাশ দেখতে, ফুলের গন্ধ নিতে, এসব ইচ্ছা থাকতে আছে নাকি! কারণ তুমি মেয়ে। তোমার গলার স্বর কখনো উঠবে না পঞ্চমে, তোমার চোখে জুড়ে থাকবে লজ্জা-ভয়, তুমি নিজেকে নিয়ে সবসময় অস্বস্তিতে থাকবে, তোমার কোনো ক্রোধ থাকবে না, বড় জোর অভিমান থাকতে পারে, তুমি আজীবন সংসারের মঙ্গল কামনা করবে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ধুর বোকা মেয়ে, নিজের জীবনেরই সিদ্ধান্ত নিতে পারার অধিকার নেই তোমার, কারণ তুমি মূর্খ মেয়েমানুষ, ঘটে বুদ্ধি কম! তোমার প্রত্যাখ্যান করার অধিকার নেই, নইলে কোপ পড়বে মগজে, অ্যাসিডে পুড়ে যাবে মুখ, না শব্দটি তোমার অভিধানে নেই, সব পারতে হবে তোমাকে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে হবে প্রথম।

ভালো চাকরি করতে হবে, ভালো মা হতে হবে, ভালো গৃহিণী হতে হবে, যা কিছু পুরুষশাসিত সমাজে ভালো তার সবটা হতে হবে। পান থেকে চুন খসলে তোমার নিস্তার নেই, হুমকি-ধমকি তো আছেই, সঙ্গে কিল-ঘুষিও পড়তে পারে, তাতে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই—এ তো নিতান্তই পারিবারিক ব্যাপার! মুখে কলুপ এঁটে থাকতে হবে, কারণ তুমি মেয়ে। বিধাতার অপরূপ সৃষ্টি! তাই কাব্যসাহিত্যে তোমার এত বন্দনা! তুমি, অর্থাৎ তোমার রূপ তোমার মুখমণ্ডল। তোমার শরীর তোমার সৌন্দর্য বিচারের মাপকাঠি। রূপকথা, গল্প-সিনেমা সবকিছুতে তুমি বন্দী তোমাকে উদ্ধার করতে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে রাজপুত্র ছুটে আসছে, অথবা গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে নায়কের হঠাৎ আবির্ভাব। হায়রে নারী তুমি বন্দিনী সে কাব্য হোক, আর হোক সেই বাস্তবতা। তুমি এই পুঁজিবাদী সমাজে পচে যাওয়া মগজের কাছে নিছক পণ্য, কত সমারোহ করে তোমাকে পণ্য বানানো হচ্ছে, কত অবলীলায় তুমি পর্যবসিত হচ্ছে মুনাফায়। তবুও তুমি প্রতিবাদ করতে পারবে না, চিৎকার করে বলতে পারবে না, এ অন্যায় মানি না, আর মানব না। তোমার জিব কেটে রাখা হবে, মেয়ে মানুষের এত কথা কিসের! মনে আছে খনার কথা, আমাদের বাংলার মেয়ে খনা, জ্যোতিষ শাস্ত্রে ছিল যার গভীর পাণ্ডিত্য, করতে পারতেন নির্ভুল গণনা, যার কথা খনার বচন নামে খ্যাত। সেই খনাকেও তার জ্ঞানবিদ্যা বিসর্জন দিতে হয়েছিল স্বামীর গৌরবের জন্য। ইতিহাসে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি, এ কি গৌরব না গ্লানি! এ তো গেল অনেক আগের কথা। এবার ফিরি নারী স্বাধীনতার যুগে। এই সময়ে, তনু-রূপাদের কথা মনে আছে? কত নৃশংসতা, কত হিংস্রতার সঙ্গে ওদের হত্যা করা হলো, নির্যাতন করা হলো, ওরা শিকার হলো আদিম বীভৎস লালসার, আবার চারুকলার সিমি যে লোকনিন্দা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করল। পৃথিবীজুড়ে রোজ কত না কত তনু, রূপা, সিমি, খাদিজারা মরে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে, বাস্তুহারা হচ্ছে, ব্রেকিং নিউজ হচ্ছে, পত্রিকাদি ভরে যাচ্ছে তাদের অসহায়ত্বের কাহিনীতে অথচ আমাদের বিবেক টলছে না। কত নির্বিকার আমরা!

কারণ তুমি মেয়ে! তোমার শৈশবও আর নিরাপদ নয়, শ্লীলতাহানি শব্দটি বুঝে ওঠার আগেই তোমার শ্লীলতাহানি হচ্ছে। তুমি মুখোমুখি হচ্ছো চরম নোংরামির। কিছু মানুষরূপী ঘৃণ্য পশুর লোলুপতা টুঁটি চেপে ধরছে তোমার কোমল শৈশব ও কৈশোরের।

সময় নারীর জন্য খুব বেশি বদলায়নি, এখনো তার আগমন অনভিপ্রেত চিন্তার, এখনো গায়ের রং দুধে-আলতা নাহলে মুখ কালো হয় অনেকের, এখনো মেয়ের বাবা শুধু পিতা নন, কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা। শত শত ‘না’ আর ‘বাধা’র শিকলে বন্দী নারীর স্বপ্ন, ইচ্ছা এবং জীবন। যদি অনেক অনেক আগে, এই সভ্যসমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে, সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়ে ফিরে যাই, তবে দেখতে পাই এমন তো ছিল না আগে। শক্তি, বুদ্ধি ও প্রেমের গুণে নারী ছিল মানবসভ্যতার অবিসংবাদিত নেতা। নারীকে বলা হতো মানবজাতির ধারক ও পালক। কিন্তু কি হায় কালের পরিহাসে নারীর নাম হয়েছে অবলা, সরলা, বামা ইত্যাদি ইত্যাদি...। নারীরা নেতা হতে চায় না, চায় মানুষ হিসেবে তার প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান। কাগুজে সমঅধিকার নয়, মগজ মননপ্রসূত বাস্তব অধিকার। তবে কি মেয়ে তুমি থমকে যাবে! না, পৃথিবী বিপদাপন্ন জেনেও তার চারদিকে কামনার হিংস্র থাবা ওতপেতে আছে জেনেও, শত শত অর্বাচীন সংস্কারের বেড়ি পায়ে নিয়েও, সারা পৃথিবীর ব্যঙ্গোক্তিকে উপেক্ষা করে দৃপ্ত পায়ে মেয়েরা সামনে এগিয়ে যাবে। সে পথে যদি আসে অন্ধকার তবে আসুক, যদি ওঠে ঝড়, উঠুক। মেয়েরা লড়বে তাদের অধিকারের জন্য, তাদের স্বাধীনতার জন্য। একবিংশ শতাব্দীর নারী আন্দোলনের প্রতিভূ কমলা বাসিনের সুরে বলতে চাই, পৃথিবী স্বাধীন, রাষ্ট্র স্বাধীন; কিন্তু নারীরা এখনো সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপে স্বাধীন নয়, স্বাধীনতার জন্য পথ পাড়ি দিতে হবে অনেকটা, তাই চোখের জল নয়, এই দীর্ঘ সংগ্রামে সাথী হোক আশা, আনন্দ আর মনোবল। পরিশেষে বলতে চাই, মেয়ে তুমি এগিয়ে চলো, শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে—

‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে

লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার...’

            লেখক : গবেষক, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।

সর্বশেষ খবর