বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে নিবেদন জেলা আ.লীগে কী হচ্ছে

পীর হাবিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে নিবেদন জেলা আ.লীগে কী হচ্ছে

সম্প্রতি আওয়ামী লীগ দলের চারটি জেলা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে শরীয়তপুর, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জ। গেল বৃহস্পতিবার রাতে এই কমিটি অনুমোদন ও ঘোষিত হওয়ার পর চার জেলায় কমবেশি স্থানীয়ভাবে দলের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়া ঘটেছে। এর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া, বিস্ময়, ক্ষোভ ও কৌতুক দেখা দিয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের গঠিত কমিটি নিয়ে।

সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদে উপনির্বাচন থাকায় তার ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেনি। দুই বছর আগে অনুষ্ঠিত দলের জেলা সম্মেলনে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম হাজার হাজার নেতা-কর্মীর সামনে সাবেক এমপি মতিউর রহমানকে সভাপতি এবং জেলা যুবলীগের বিদায়ী আহ্বায়ক এনামুল কবির ইমনের নাম সাধারণ সম্পাদক পদে ঘোষণা দেন। সভাপতি পদে মতিউর রহমানকে নেতা-কর্মীরা মেনে নিলেও সম্মেলনস্থলে এনামুল কবির ইমনকে মেনে না নেওয়ায় চেয়ার ছোড়াছুড়ি, বিক্ষোভ-স্লোগানে তাত্ক্ষণিক অসন্তোষের প্রকাশ ঘটেছিল। সে সময় নেতা-কর্মীদের কাছে জনপ্রিয় সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ছিলেন বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুট ও নন্দিত পৌর মেয়র সম্প্রতি অকালপ্রয়াত সাবেক জেলা সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব বখত জগলুল। কিন্তু কেন্দ্র থেকে তৃণমূলসম্পৃক্ত কর্মীবান্ধব এ দুই নেতার নাম বাদ দিয়ে সুনামগঞ্জের রাজনীতির সঙ্গে ছাত্রজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন এনামুল কবির ইমনের নাম ঘোষণা করায় সবাই স্তম্ভিত হন ও প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এর আগে জেলা পরিষদের প্রশাসক পদে সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে তাকে নিয়োগ দেওয়ায় বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার নেতা-কর্মী শহরে প্রতিরোধের আগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। সেই পরিস্থিতি মরহুম আইয়ুব বখত জগলুল রাস্তায় নেমে সামাল দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আগে আবারও এনামুল কবির ইমনকে সুনামগঞ্জ সদর আসনে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেওয়ায় হাজার হাজার নেতা-কর্মী প্রতিবাদ মিছিল বের করেছিলেন। তবু কী এক রহস্যজনক কারণে রাজনীতিতে নাবালক অবুঝ ছেলেটিকে কর্মীদের আবেগ-অনুভূতি উপেক্ষা করে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি ঘোষিত না হলেও বহুল বিতর্কিত মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগে অভিযুক্ত হন নতুন নেতৃত্ব। সর্বশেষ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন এলে স্থানীয় জেলা আওয়ামী লীগ নুরুল হুদা মুকুটকে প্রার্থী হিসেবে চাইলেও আওয়ামী লীগ মনোনয়ন বোর্ড এনামুল কবির ইমনকেই মনোনয়ন দেয়। কিন্তু নেতা-কর্মীদের আবেগ-অনুভূতির পক্ষে জেলা সভাপতি মতিউর রহমান ও পৌর মেয়র মরহুম আইয়ুব বখত জগলুল বিদ্রোহী প্রার্থী নুরুল হুদা মুকুটকে নিয়ে মাঠে নামেন। জেলার দলীয় এমপিরা ইমনের পক্ষে অবস্থান নিলেও নির্বাচনে ইমনের শোচনীয় পরাজয় ঘটে মুকুটের কাছে। মুকুটের প্রাপ্ত ভোটের অর্ধেকের কম ভোট ‘ফোর টুয়েন্টি’ ভোট লাভ করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইমন।

’৯৭ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতারা গিয়ে সম্পন্ন করেছিলেন। উদ্বোধনী অধিবেশনের পর কাউন্সিল অধিবেশনে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সর্বসম্মতভাবে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন মরহুম আবদুজ জহুর। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন আইয়ুব বখত জগলুল। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুজ জহুর দলের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে আমৃত্যু সভাপতি থাকলেও তার মৃত্যুর পর জেলা আওয়ামী লীগ একটি শোকসভার আয়োজনও করেনি। সুনামগঞ্জের রাজনীতির ইতিহাসে এ ঘটনা বড়ই বেদনাদায়ক। সেই সম্মেলনের ১৯ বছর পর ২০১৬ সালে বিশাল আয়োজনে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে যেসব নেতা-কর্মী নিজেদের রাজনীতির ময়দানে গত দুই যুগে শেখ হাসিনার কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মহিমায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; তাদের বড় অংশের এবারের কমিটিতে জায়গা হয়নি।

’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর যে দমন-পীড়ন ও সামরিক শাসনকবলিত অভিশপ্ত অন্ধকার সময় বাংলাদেশে নেমে এসেছিল, সেই অমাবস্যার আঁধার থেকে অন্যান্য এলাকার মতো সুনামগঞ্জও মুক্তি পায়নি। জননেতা আবদুজ জহুর, কেন্দ্রের আবদুস সামাদ আজাদের মতো নেতা টানা তিন বছর জেল খেটেছিলেন। জেলা নেতাদের অনেকেই কারাবরণ করেছেন। ছাত্রলীগ নেতাদের ওপরও দমন-পীড়ন এসেছিল। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নুরুজ্জামান চৌধুরী শাহীর শ্বশুরালয় পর্যন্ত সেনা শাসকদের পুলিশ তছনছ করেছে। শাহী পালিয়ে জার্মানি চলে গিয়েছিলেন। সাধারণ সম্পাদক শামছুল ইসলাম এখলাছকেও হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে পলাতক জীবনের মুখোমুখি করা হয়।

’৭৫-উত্তর সেই দুঃসময়ে আমার অগ্রজ অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান পীরকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয় ’৭৭ সালে। ’৭৬ সালে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের নাম নিয়ে অনেকের কাছে যাওয়া যেত না। মতিউর রহমান পীরের পাশে সেই সময় মারুফ চৌধুরী, আমির হোসেন রেজা, মরহুম সাহামাল মিয়া ও পরবর্তী রাকসুর পত্রিকা সম্পাদক মরহুম আমানুল্লাহরা দাঁড়িয়েছিলেন। মরহুম জুবের আহমদ, রশীদ বখত নজরুল এদেরও সাহসী ভূমিকা ছিল। ’৭৮ সালে জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে মতিউর রহমান পীরকে সভাপতি ও হায়দার চৌধুরী লিটনকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের জেলা কমিটি গঠিত হয়। নান্টু রায়, এ বি এম ফজলুল করিম, করুণা সিন্ধু বাবুল, দেওয়ান শের জাহান রাজা চৌধুরী, সুবীর তালুকদার বাট্টু, আনোয়ার চৌধুরী আনুল, প্রয়াত কাঞ্চন ভদ্রসহ অসংখ্য সংগঠক ও ছাত্রনেতাই তৈরি হননি, সুনামগঞ্জে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে প্রথম ছাত্রলীগ শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়। ’৭৯ সালের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ এজিএস পদে বিপুল ভোটে বিজয়ী আনোয়ার চৌধুরী আনুলের নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ’৮০ সালের সম্মেলনে সেই সময়ের ছাত্রলীগের সব নেতা-কর্মী প্রিয় নেতা মতিউর রহমান পীরকে সর্বসম্মতিক্রমে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পদে আবারও নির্বাচিত করেন। সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন আনোয়ার চৌধুরী আনুল। ’৮১ সালের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি পদে মানিক লাল দে ও জিএস পদে আইয়ুব বখত জগলুলের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ দুটি পদ বাদে পূর্ণ প্যানেলে বিজয়ী হয়।

’৮১ সালে ছাত্রলীগের ভাঙনের আগে মতিউর রহমান পীর পারিবারিক কারণে ছাত্র রাজনীতি থেকে সাময়িক বিরতি নেন। কেন্দ্রীয়ভাবে ছাত্রলীগ ভাঙনের মুখে পড়লে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের প্রায় সবাই মরহুম আবদুর রাজ্জাকের আশীর্বাদপুষ্ট ফজলু-চুন্নুর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হন। জেলা আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দিন আহমদ ও আবদুস সালাম, যুবনেতা আমির হোসেন রেজা ও ইমানুজ্জামান চৌধুরী মহি শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট জালাল-জাহাঙ্গীর নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগকে সমর্থন দেন। আর এই অংশের নেতৃত্বে হাল ধরেন আইয়ুব বখত জগলুল। সেই থেকে ধীরে ধীরে জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দলের কাণ্ডারি। ’৮১ সালে ছাত্রলীগ ও ’৮৩ সালে আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দিলেও সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মরহুম আবদুর রইসসহ অধিকাংশ নেতার সন্তানরা আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন বাকশালের রাজনীতিতেই যুক্ত হন। সুনামগঞ্জের ছাত্র রাজনীতিতে এই ধারাটি শক্তিশালী ছিল। ’৭৯ ও ’৮১ সালে সুনামগঞ্জ কলেজ ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠান জাসদ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে পণ্ড করে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। ছাত্রলীগ নেতাদের অপরাধ ছিল সংসদে বিজয়ী হয়ে তারা অভিষেক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছিলেন। সেই ’৭৫-উত্তর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সুনামগঞ্জে সামরিক শাসকদের দ্বারা বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধকালে অতিবিপ্লবী দ্বারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকালে আমার বড় ভাই মতিউর রহমান পীর একজন আদর্শিক ছাত্রনেতা হিসেবে সাহসের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নামে ছাত্রলীগকে পুনর্জন্ম, সুসংগঠিত ও জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠনে পরিণত করতে যে শ্রম, মেধা ও ভূমিকা রেখেছেন আজকাল কেউ কেউ ব্যক্তিস্বার্থে অস্বীকার করলেও ইতিহাস বা সেই সময়ের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক কর্মীরা অস্বীকার করতে পারবেন না। সেই দিনের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ওবায়দুল কাদের থেকে শুরু করে কোনো ছাত্রলীগ নেতা তার সেই দিনের গৌরবময় ভূমিকাকে মুছে দেবেন না। সেই দুঃসময়ে মাকে দেখতাম গভীর রাত পর্যন্ত মতিউর রহমান পীর ঘরে না ফেরা পর্যন্ত বারান্দায় বসে থাকতেন। একদিকে সেনাশাসনকবলিত অন্ধকার সময়, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও মুজিববিদ্বেষী উগ্রপন্থি বিপ্লবী সংগঠনের সশস্ত্র তৎপরতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মীদের জন্য ত্রাসের পরিস্থিতি তৈরি করেছিল।

প্রতিটি ছাত্রলীগ পরিবারের সদস্যদের মা-বাবার চোখে-মুখে এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল। আদর্শের প্রতি গভীর বিশ্বাস, দলের প্রতি আনুগত্য, নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ছিল নিঃশর্ত। খেয়ে না খেয়ে একটি পরিবারের ভাইবোনের মতো সবাই মিলেমিশে সেদিন সংগঠন করেছেন। সেনাশাসক এরশাদ জমানায় মতিউর রহমান পীর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আইন পেশার পাশাপাশি ফিরে এলেও কখনই মূলধারা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি। জাতীয় পার্টি থেকে দুবার এমপি হওয়ার সুযোগ পেয়েও গ্রহণ করেননি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রতি শেষ আনুগত্য ও বিশ্বাস রেখে ইমানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কর্মী হিসেবে মরতে চেয়েছেন আজীবন। ব্যক্তিগত পাওয়া-না পাওয়াকে কখনো বড় করে দেখেননি। দলের সিদ্ধান্তের প্রতি কখনো দ্বিমত করেননি। সেই মতিউর রহমান পীর বিগত জেলা কমিটিতে থাকলেও গত বৃহস্পতিবার রাতে ২০ বছর পর ঘোষিত জেলা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে কোথাও রাখা হয়নি। আজীবন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সহচর, আমৃত্যু আওয়ামী লীগার, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু যাকে জেলা গভর্নর করেছিলেন, সেই আবদুল হেকিম চৌধুরীর পুত্রদের কাউকে কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়নি। জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে একদিন যারা কলেজ ছাত্র সংসদের অভিষেকে বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়ায় তীব্র আপত্তি তুলে অনুষ্ঠান পণ্ড করেছিল তাদের ঠাঁই দেওয়া হয়েছে। কমিটিতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুগত রাজাকারপুত্র, হাইব্রিড, রাজনীতি ও সমাজে জনবিচ্ছিন্ন, ব্যক্তিত্বহীন কিছু মুখ ঠাঁই পেয়েছে। এককালের জাসদ-বাসদ ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের জয়জয়কার হয়েছে। জেলা সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমন তার এক ভাই খায়রুল কবির রুমেনকে সহসভাপতি ও লন্ডনপ্রবাসী আরেক ভাই ফজলুল কবির তুহিনকে জেলা কমিটির সদস্য করেছেন। তার এক মামাকে জেলা কমিটিতে ঠাঁই দিয়েছেন। জেলা সভাপতি মতিউর রহমান তার প্রবাসী পুত্র যার সুনামগঞ্জের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই, সেই মশিউর রহমান জুয়েলকে কমিটিতে স্থান দিয়েছেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী কামরুল হাসানকে যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে বসিয়েছেন। যার ভাই জেলা ছাত্রদলের নেতা। যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সৈয়দ কাশেমকে সহসভাপতি করা হয়েছে। এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াহিদুর রহমান সুফিয়ানের কমিটিতে ঠাঁই হয়নি। ’৮১ সালের পর স্থানীয় রাজনীতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে আইয়ুব বখত জগলুলের সঙ্গে ভূমিকা রাখা যুবলীগ নেতা আমির হোসেন রেজাকে কমিটিতে রাখা হয়নি। কমিটিতে রাখা হয়নি সেই সময়ে ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি শাহ আবু তারেক ও সাধারণ সম্পাদক জিতেন্দ্র তালুকদার পিন্টুকে। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আক্তারুজ্জামান সেলিম, সাবেক সভাপতি তনুজকান্দি দে, আজহারুল ইসলাম শিপার, কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি জনপ্রিয় তরুণ সংগঠক মনিশকান্তি দে মিন্টু, ছাত্রলীগের সাবেক জেলা সাধারণ সম্পাদক নবনীকান্তি দাস, পলিন বখত, দীপঙ্কর সেন রিবু কেউ জেলা কমিটিতে জায়গা পাননি।

সুনামগঞ্জ জেলার ১১টি উপজেলা থাকলেও সভাপতি মতিউর রহমানের দিরাই ও সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমনের পৈতৃক ঠিকানা জগন্নাথপুর উপজেলা থেকে কমিটিতে বেশি লোক রাখা হয়েছে। সহসভাপতি পদে চারজনকে জগন্নাথপুর থেকে রাখা হলেও মরহুম আবদুস সামাদ আজাদের পুত্র আজিজুস সামাদ ডনের ভাগ্যে একটি সহসভাপতির পদ জোটেনি। জেলার এমপিদেরও সহসভাপতি পদে রাখা হয়নি।

সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আক্তারুজ্জামান সেলিম বিএনপি শাসনামলে জেল খেটেছিলেন। বর্তমানে আইনজীবী সেলিম আক্ষেপ করে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যার পর ছাত্রলীগের রাজনীতিতে আমাদের অভিভাবক ছিলেন আওয়ামী লীগের আজকের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। অথচ ২০ বছর পর গঠিত জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে পরীক্ষিত ছাত্রলীগ নেতাদের যখন ঠাঁই হয় না, তখন আমরা যাব কোথায়? বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা দলের প্রবীণ নেতা ইদ্রিস আলী বীরপ্রতীকের জেলা কমিটিতে ঠাঁই হয়নি! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক আবুল কালাম চৌধুরীকে জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তাকে চেনেন না। শোনা যায়, শাল্লা উপজেলার এক স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারে তার জন্ম। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান ঢাকায় থাকেন। সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবির ইমনও ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। কোষাধ্যক্ষ পদে সিলেটে বসতি গড়া একসময়ের বাসদের এক কর্মীকে ঠাঁই দিয়েছেন। স্থানীয় রাজনীতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও আওয়ামী লীগের মূলধারার জন্য আজীবন লড়াকু আইয়ুব বখত জগলুল দেড় মাস আগে আকস্মিক মারা গেলেও তার নাম শোভা পাচ্ছে সহসভাপতি পদে! যারা তার সঙ্গে মাঠে-ময়দানে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে সংগঠক হিসেবে দুর্দিনে দলের কাজ করেছেন, তাদের কাউকে দলের জেলা কমিটিতে রাখা হয়নি। জামালগঞ্জের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ কমিটিতে ঠাঁই পাননি। জেলার রাজনীতিতে নবগঠিত আওয়ামী লীগের জেলা কমিটি নিয়ে কেউ কেউ বলছেন, হাইব্রিডের দুর্গে পরিণত হয়েছে। কোনো দিন আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিতে যাননি; অথচ ব্যাংকের চাকরি থেকে সদ্য অবসর নেওয়া অভিজিৎ চৌধুরীকে জেলা কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক করা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এই কমিটি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের অনুগতদের নিয়ে ভাগাভাগির কমিটিই নয়, এটি হয়েছে বাপ-বেটার কমিটি, ভাই-ভাই কমিটি, মামা-ভাগ্নে কমিটি কখনো বা বাপ-বেটির কমিটি। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুটকে দুই নেতা ছোটখাটো ভাগ দিয়েছেন মাত্র। সভাপতির পরিবার থেকে তিনজন, সাধারণ সম্পাদকের পরিবার থেকে তিনজন, সহসভাপতির পরিবার থেকে দুজন, যুগ্মসাধারণ সম্পাদকের পরিবার থেকে দুজন এ কারণে একে পরিবারকেন্দ্রিক কমিটিও বলা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সবিনয় নিবেদন, জেলা আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের আকুতিতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে অনুরোধ, জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যে কমিটি পাস করিয়ে নিয়েছেন এটি আওয়ামী লীগের কমিটি নয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের ব্যক্তিগত পছন্দের কমিটি। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সুনামগঞ্জ গেলে যার বাড়িতে থাকেন সেই সফিকুল আলমকেও সহসভাপতি পদ দিয়েছেন। অথচ বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আলী আমজাদ ও অ্যাডভোকেট রইস উদ্দিনের মতো নেতারা বাদ পড়েছেন। শুধু তাই নয়, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক পাওয়ার গ্রিডের পরিচালক হয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। তার যে ভাইকে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি করেছেন, তাকে পাবলিক প্রসিকিউটরও করা হয়েছে। এ দুই ভাইয়ের কর্মকাণ্ড-তৎপরতা সম্পর্কে স্বচ্ছ-স্বাধীন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পোড় খাওয়া আদর্শিক নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়ন ও দুর্নীতিপরায়ণ সুবিধাভোগীদের আস্ফাালন কেবল সুনামগঞ্জেই কিনা— বঙ্গবন্ধুকন্যার বিবেচনায় নেওয়ার সময় এসেছে। এই চিত্র কেবল সুনামগঞ্জের নাকি সারা দেশের— তার পোস্টমর্টেম হওয়া প্রয়োজন। এভাবে পোড় খাওয়া আদর্শিক, অনুগত, ত্যাগী, কমিটেড নেতা-কর্মীরা যদি মূল্যায়নে বঞ্চিত হন, আর হাইব্রিড সুবিধাভোগীরা লাভবান হন, তাহলে আদর্শিক কর্মীরা হতাশাগ্রস্তই হবেন না, রাজনীতির প্রতি তাদের অনীহাই জন্মাবে না, আওয়ামী লীগের মতো সাংগঠনিক দল ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে সবিনয়ে নিবেদন, আওয়ামী লীগের জেলার রাজনীতিতে কী ঘটছে সুনামগঞ্জ থেকেই একটি তদন্ত করুন। চলমান পৌর নির্বাচনে জেলা নেতৃত্বের একটি অংশ নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে নীরবে কাজ করছে— এরা কারা খুঁজে বের করুন। আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সব জেলা কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া নেতা-কর্মীদের আমলনামা নিয়ে বসুন।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজ

সর্বশেষ খবর