বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভয় নয়, বাঙালের হাই কোর্টেই ভরসা

মোস্তফা কামাল

ভয় নয়, বাঙালের হাই কোর্টেই ভরসা

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বৈধতা নিয়ে রিট খারিজ করে রবিবার আপাতত ঝামেলামুক্ত হয়েছে হাই কোর্ট। কিন্তু তা মোটেই নিষ্পত্তি নয়। অন্যদিকে, এর বিকল্পই বা কী? সংসদে নিজ দলের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ভোট দিলে সদস্যপদ শূন্য হওয়াসংক্রান্ত এ অনুচ্ছেদটি নিয়ে রাজনীতির মাঠে অন্তহীন কথাবার্তা। বিষয়টি শতভাগ রাজনৈতিক। নিষ্পত্তিও নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। এর পরও মাঝেমধ্যেই এটিকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু করে বাজারে ছাড়া হয়। টাটকা কোনো ইস্যুতে চাপা না পড়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে কদিন। এ ধরনের রাজনৈতিক বিষয়কে আদালতে ঠেলে দেওয়া এবং নেওয়া দুটোই বিচারপতি ও বিচারালয়ের জন্য বিব্রতকর। গ্রহণ-খারিজ কোনোটাতেই এর ফয়সালা দেওয়া সম্ভব নয়।

বাঙালকে হাই কোর্ট দেখিয়ে লাভ নেই বা বাঙাল হাই কোর্টে ভয় পায় না— প্রবাদে এমন কথার পেছনে কিছু পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে। তবে কখনো কখনো ভয় না পেলেও বাঙাল শেষ পর্যন্ত হাই কোর্টকে অমান্য-অগ্রাহ্য করে না। বরং ভরসা করে। নির্দেশনা চায়। রায় মানে শিরোধার্য হিসেবে। হুকুম-হাকিমে নয়, গোলমাল অন্য জায়গায়। রাজনৈতিক বিষয়-আশয়ে। রাজনীতিতে, সংসদে বা প্রশাসনে ফয়সালাযোগ্য বিষয়কে আদালতে টেনে নেওয়ায় অভিসন্ধি শুধু পাকছে। পাকানো হচ্ছে। সংক্ষুব্ধরা বিচার, বিচারপতি, বিচারালয়ের বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। ঝাঁপিয়ে পড়ছেন নিম্নমানের ভাষা ও আচরণে। বিপরীতে প্রতিপক্ষের তখন আদালতের প্রতি বেদম সম্মান প্রদর্শন। সেটা আরেক রাজনীতি। যারা দুই দিন আগেও সংক্ষুব্ধ হয়ে একই কাণ্ড করেছেন। অপজিশনে থেকেও আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে লাভবান হওয়া, সরকারকে ঘায়েল করার নাটকীয় ঘটনা রয়েছে। এ দুই পক্ষের কেউই কি যেনতেন বাঙাল? তারা রাজনৈতিক ক্ষমতাধর। সাবেক বা বর্তমান পরাক্রমশালী। বিগত বা বর্তমান রাজশক্তি। তাদের মনোভাব ও দলান্ধতার জের সইতে হচ্ছে বিচার বিভাগকে। আদালতে ভরসা করা অসহায় বাঙালকেও। অথচ আদালতে ভয় পায় না বলে গালমন্দ হজম করতে হয় এই বাঙালকে। এর বিহিতের কোনো লক্ষণ বা রাজনৈতিক অঙ্গীকারের আভাসও নেই।

স্বাভাবিক-সাধারণ কোনো বাঙালের বিরুদ্ধে কখনো এভাবে হাই কোর্টে ভয় না পাওয়ার রেকর্ড নেই। এ শ্রেণির কোনো বাঙাল কখনো বিচারালয়ে অশোভন আচরণ করেছে? বিচারপতির দুয়ারে লাথি বা বাসায় বোমা মেরেছে? কোনো বিচারপতিকে আয়ত্ত বা অসহায়ত্বের কম্বলে ঢুকিয়েছে? সেই বিবেচনায় বাংলা ব্যাকরণ ও প্রবাদ বাঙালির প্রতি অবিচারই করে চলেছে। সাম্প্রতিক যেসব ঘটনায় দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা ও ভাবমূর্তিতে খরার টান পড়েছে, এসবের একটিতেও জড়িত নয় সাধারণ কোনো বাঙাল। বরং এই বাঙালের এখনো ভরসাস্থল বিচারালয়। তাদের এ আস্থা অটুট রাখতে বিচারপতি, আইনজীবীসহ বিচার ও আইনসংশ্লিষ্টদের দায় কম নয়। অথচ বিচারাঙ্গনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন যা করার তা হচ্ছে মহাশয়-মহোদয় মহল থেকেই। কখনো কখনো নিজেদের বিতর্কিত-অসম্মানিত করার অভিযোগের তীর স্বয়ং বিচারক-বিচারপতিদের দিকেও। বিচার, বিচারপতি, বিচারালয়ের মর্যাদার সঙ্গে তা বেমানান।

রাষ্ট্র এবং বাঙালের এ ভরসাস্তম্ভের নির্দেশ উপেক্ষার হালনাগাদ চিত্র বড় করুণ। উদ্বেগজনক। এক তথ্যে জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টে রিট মামলা কমছে। কমে গেছে শুনানির হারও। নির্দেশনা-পর্যবেক্ষণও ভাটার দিকে। কমের মধ্যেও দেওয়া নির্দেশনাগুলো মান্য-গণ্যের নমুনা বড় দুর্বল। প্রশাসন, পুলিশ, সংস্থা-প্রতিষ্ঠান কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই। আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে নদী ভরাট, খাল উদ্ধার না করা, স্থাপনা নির্মাণ, গ্রেফতার, রিমান্ডে নির্যাতন, উচ্ছেদের মতো সংবাদের ছড়াছড়ি গণমাধ্যমে। ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া, ইংরেজি মাধ্যমে বাড়তি ফি না নেওয়াসহ সর্বোচ্চ আদালতের কিছু নির্দেশনা মানুষকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন নেই। উপরন্তু আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা ক্ষমতাবানদের কাছে অনেকটা স্মার্টনেসের ব্যাপার। হিম্মতের জানান দেওয়ার মতো। এই ড্যাম-কেয়ারের মধ্যে প্রভাবের সঙ্গে জলুস প্রদর্শনের মাত্রা বেড়ে গেছে। আবার আদালত থেকেও সম্প্রতি আশাজাগানিয়া তেমন কোনো নির্দেশনার খবর নেই।  এসব নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থাও নেই। বরং ক্ষেত্রবিশেষ প্রণোদনা ও ভিন্ন দৃষ্টান্ত। তা কী বার্তা দিচ্ছে?

বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, কথিত সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে না নেওয়ার নির্দেশনা না মানায় নগদে বেনিফিশিয়ারি ক্ষমতাসীনরা। একসময়  নির্যাতনে মৃত্যু বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয় তাদেরও। সেই তরতাজা নজির তো নিত্য ঘটছে আমাদের আশপাশে। এর পরও লাগাম টানার গরজ নেই। ঘটনার পরম্পরায় চতুর-ধূর্তরাও কোথাও শূন্যতা আঁচ করছেন। আদালতের অজ্ঞাত কোনো নিদানকালও মালুম করছেন তারা? কেমন যেন ভিক্টরি ভিক্টরি জ্বরে পেয়েছে তাদের। বিচারপতি, আইনজীবী, সংসদ, নির্বাহী বিভাগ, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল কারও জন্যই এটা শুভবার্তা নয়। এর উল্টো পীঠে লুকিয়ে রয়েছে নির্বাচন, গণতন্ত্র, সুশাসন, সমৃদ্ধিকে চূর্ণ করার ঝুঁকিও। এর আগে, রাজনৈতিক অভিলাষে বিচার বিভাগকে কটাক্ষ করে জাতীয় সংসদে এখতিয়ারবহির্ভূত আলোচনার নামে নিজেদেরও কত ঠুনকো করা হয়েছে সাহস করে কেউ তা মনে করিয়েও দেননি মাননীয়দের।

নিজেদের ক্রিয়াকর্মের খেসারতে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে বিচার বিভাগের ওপর সওয়ার হওয়া তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলোর বৈশিষ্ট্য। তাদের টার্গেট বিরোধীরা যেন অগণতান্ত্রিক অ্যাকশনের বিরুদ্ধে আইনি সাহায্য না পায়। তখন নানা উটকো ঝামেলা ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা করা হয় আদালতের দিকে। এর মধ্যেও গা-ঝাড়া দেওয়ার রেকর্ড তৈরি করে চলেছে বন্ধু প্রতিবেশী ভারত ও শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তান। ভারতের মতো শক্ত ভিতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সুপ্রিম কোর্টকে সমীহ করে। নির্দেশনাগুলো কার্যকরে ভূমিকা রাখে। আমাদের অপছন্দের রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিচার বিভাগও শক্তিমত্তা দেখাচ্ছে একের পর এক।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট

বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সর্বশেষ খবর