সোমবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ও আমার চক্ষু নাই

নঈম নিজাম

ও আমার চক্ষু নাই

কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। চোখে ঝাপসা দেখছি। কয়েক বছর আগে ডাক্তার গ্লুকোমা সন্দেহ করেছিল। গ্লুকোমা হলে মানুষ নাকি এক পর্যায়ে অন্ধ হয়ে যায়। আমারও কি তাই হবে? এমনিতে চারপাশে দিনকানাদের সঙ্গে চলতে হয়। তার মাঝে শুনি কলিম শরাফীর দরদি গলার সেই গান, যা আমাকে এখনো আপ্লুত করে। অসাধারণ গেয়েছেন—‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে, সেই দুঃখে চোখের পানি, ও আমার চক্ষু নাই।’ প্রথম দিকে আমার ধারণা ছিল, গানটি লোকসংগীত। আসলে তা সিনেমার গান। ছবিটি আমার দেখা হয়নি। খান আতাউর রহমান সূর্য্যস্নান ছবির জন্য গানটি লিখেছিলেন। খান আতার মেয়ে রুমানার সঙ্গে গানটি নিয়ে কথা হয়। তিনি বললেন, তার বাবা গানটি লন্ডনের টেমস নদীর তীরে বসে লিখেছিলেন। সালাউদ্দীন পরিচালিত সূর্য্যস্নান ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে। তার মানে গানটি আরও আগে লেখা। অসাধারণ দরদ দিয়ে গানটি গেয়েছিলেন কলিম শরাফী। এই গানের একটি লাইন কয়দিন ধরে গুনগুন করছি, ‘ও আমার চক্ষু নাই।’ চোখ থেকেও অনেক সময় আমরা অন্ধ হয়ে থাকি। আলোর ঝলকানি আমাদের চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে চারপাশে সব দেখে মনে হয়, কেউ কি বাস্তবতায় নেই? আর বাস্তবতায় থাকলে খারাপ কাজগুলোকে কী করে বলি, আহ বেশ বেশ। এখন কাউকে মারা বেশ! সেই দৃশ্য সামাজিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া বেশ! নিষ্ঠুরভাবে পেটানোর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করাও বেশ! আমাকেও অনেকে অনুরোধ করে একটু বেশ বলুন না! হতাশা আর বিস্ময় নিয়ে শুনি, দেখি। বড় অদ্ভুত সমাজে বাস করছি। হিংসা ও বিদ্বেষ এখন স্বাভাবিক। এখন একজনের জন্য গোটা কমিটি বাতিল হয়ে যায়। সময় নিয়ে সব কিছু দেখার প্রয়োজনীয়তা কেউ মনে করে না। বড় অস্থিরতা সব কিছুতে। কারও মনেই হয় না, সর্বনাশ সব সময় এক-দুজনের কারণেই হয়। আপনি ভক্ত হলে সংশোধন করুন তাদের। কারণ এই দিন দিন নয়, আরও দিন আছে। এই দিন নিয়ে যাবে সেই দিনের কাছে। আর আওয়ামী লীগ কাউকে পদ-পদবি দেয়নি অপরাধ করার লাইসেন্স হিসেবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার জন্য। অপকর্ম করে এবং সেই সব কাজকে উৎসাহিত করে শেখ হাসিনার সর্বনাশ করার অধিকার কারও নেই। অতি উৎসাহীদের বলছি, সামনে সিটি ভোট। এরপর জাতীয় নির্বাচন। সব কিছু ভুলে যাবেন না। মানুষকে খুঁচিয়ে অতিষ্ঠ করবেন না। অকারণে জাগিয়ে তুলবেন না। কুমিল্লা কিংবা রংপুরের মতো কিছু হলে হয়তো নতুন ব্যাখ্যা তুলে ধরবেন আপনারা। কিন্তু ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়েই যাবে।

অনেক সময় বাঙালি চরিত্র চোর গেলে বুদ্ধি বাড়ে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় তাই মনে হচ্ছে। একবার এক গেরস্থ বাড়িতে চোর এলো। চোর চলে যাওয়ার পর পুলিশ এলো। গেরস্থের তরুণ সন্তানের তখন চোখে-মুখে আগুন ঝরে পড়ছে। চোরকে পাওয়া মাত্রই যেন পিষে মেরে ফেলবে। ভাব অল্পের জন্য চোরকে সে ধরতে পারেনি। পুলিশ ভাবল, ছেলেটা ঘুমিয়ে ছিল। তাই চোরকে ধরতে পারেনি। তবুও দারোগা জিজ্ঞেস করল, চুরির সময় তুমি কি ঘুুমিয়ে ছিলে? ছেলেটি বলল, না জেগেই ছিলাম। দারোগা বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। তাহলে করলে কী? এবার ছেলেটি বলল, আমি হারিকেনের আলোতে পরিষ্কার দেখলাম, ওরা ঘরের বেড়া কেটে ভিতরে প্রবেশ করল। আমি ভাবলাম, ধরবো ব্যাটাকে আরেকটু সময় দেখা যাক। তারপর দেখলাম, ঘরের সব জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম আরেকটু সময় যাক। তারপর ধরে মাইর দেব। তখন ব্যাটা পালাবে কোথায়? তারপর দেখলাম, চোর ঘরের সব জিনিসপত্র নিয়ে চলেই গেল। আমি উঠলাম। দেখলাম চোর অনেক দূর চলে গেছে। আমি ভাবছিলাম, এবার চিৎকার দেব। তারপর যখন দেখলাম, চোরকে আর দেখা যাচ্ছে না, তখন বুঝলাম এখন আর বসে থাকা যায় না। তখনই চিৎকার শুরু করলাম। বুঝতেই পারছেন, এরপর আমার চিৎকারে সবাই এসে হাজির। সাম্প্রতিক সময়ে দেখছি, নীতিনির্ধারক মহল সব কিছু স্বাভাবিক করার পর অনেকে চিৎকার করছেন, চোর চোর চোর। বড় অদ্ভুত সব কিছু। আমি পরিষ্কার বলছি, অপরাধকে যারা জায়েজ বলছে, তারা পুরো আওয়ামী লীগের সর্বনাশ করছে। এই সর্বনাশের খেসারত কি দাঁড়ায় জানি না। এ নিয়ে পুরনো আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে। গুলশান হলি আর্টিজানের ঘটনার রাতে পুরো জাতি উৎকণ্ঠায় ছিল। একই সময়ে একজন মানুষই পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন দৃঢ়চিত্তে, শক্ত হাতে— তিনি প্রধানমন্ত্রী। সেই মধ্যরাতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রধানরা নির্দেশ নেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন গণভবনে। তারা দেখলেন, গণভবনে আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী, এমপি কেউই নেই। প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা জেগে আছেন। বাইরে দুজন বসে ছিলেন একজন জাহাঙ্গীর কবীর নানক, আরেকজন এসএম কামাল হোসেন। আর কাউকে দেখা যায়নি।

আমার দেখা বাস্তবতায় কঠিন সময়গুলো একজনকেই মোকাবিলা করতে হয়। ১৯৮১ সালে তিনি শুরু করেছিলেন। এখনো করছেন। তার সেই পরিশ্রমকে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুবিধাভোগী লোকের অভাব নেই। সেই দিন আমার এলাকার এক ছেলে বলল, ভাই এখন আওয়ামী লীগের গণজোয়ার যাচ্ছে। প্রথম বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, ও বলছে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। পরে বুঝলাম অন্যকিছু বলার চেষ্টা করছে। আমি তার দিকে নজর দিলাম। বললাম, এবার বল। ছেলেটি আবার বলল, আমাদের উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এখন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। আমি বললাম, জানি তো। ছেলেটি বলল, পৌর জামায়াতের আমির এখন পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। শিবির, ছাত্রদল, যুবদলের নেতারা এখন ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতা। আমি বললাম জানি তো সব কিছু। ভালোই তো উন্নয়ন হচ্ছে, খারাপ কী? আমাকে এত কথা কেন শোনাচ্ছো? ছেলেটি বলল, কালের কণ্ঠে একটা রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে এ নিয়ে। সারা দেশের হাজার হাজার জামায়াত, শিবিরকর্মী এখন আওয়ামী লীগে। পত্রিকাটি সবার নাম-ঠিকানাও প্রকাশ করেছে। আমাদের অঞ্চলের কথা লিখেনি। তাই তার মন খারাপ। আমি হাসলাম, বললাম সব লিখে শেষ করা যাবে না। এখন অন্যায়কে কেউ অন্যায় মনে করে না। দলের ভালো কাজ হিসেবে দেখে। এই গ্রুপকে যখন বলি, বাবারা সামনে ভোট আছে। তারা বলে, নেত্রী সব সামাল দেবেন। যেন নেত্রীর কাছে আলাদীনের জাদুর প্রদীপ আছে। তারা অপকর্ম করবেন। মানুষ ক্ষুব্ধ হবে তাদের অপকর্মে। আর জনগণের পবিত্র দায়িত্ব সেই অপকর্মকে জায়েজ করা। দলের দায়িত্ব সব ভুলকে ইয়েস বলা। কথা বাড়াই না। ছেলেটিকে বললাম, চা খাও। মন ভালো হয়ে যাবে। ছেলেটি এবার বলল, ঢাকা এলাম একটা মেশিন দেখার জন্য। ভাবলাম, এখনকার তরুণরা গ্রামেগঞ্জে অনেক ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করে। এই ছেলেটিও তেমন কিছু করার চেষ্টা করছে। অনেক সময় আমার কাছে ওরা পরামর্শ চায়। এই ছেলেটিও তেমন কিছু হয়তো বলার চেষ্টা করছে। আমি বললাম, কি মেশিন দেখতে এলে? এবার ছেলেটি বলল, এখন নাকি দুটি মেশিন আবিষ্কার হয়েছে দেশে। এর একটিতে জামায়াত, বিএনপি ভরলে তারা বেরিয়ে আসে আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা হিসেবে। আরেকটিতে ভরলে যে যত অপরাধ করুক, সেই অপরাধের ছবি ছড়িয়ে পড়লে সবাই তার পক্ষ নেবে। বলবে, সব ঠিক আছে। সেই মেশিনগুলো দেখতে চাই। অনেক বছর আওয়ামী লীগ করেছি। ২০০১ সালের ভয়াবহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারছি না। বিএনপি-জামায়াত আমাদের ঘরে থাকতে দেয়নি। এখন আওয়ামী লীগ করলে তারাও শুদ্ধ। এই ছেলের কথা শুনে না হেসে পারলাম না। বললাম, তুমি তো ভালোই মজা করতে পার। ছেলেটি বলল, সমস্যা এখানেই। কষ্টের কথা বললেও আপনাদের কাছে মনে হয় মজা করছি। আসলে কে মজা করছে টের পাওয়া যাবে সময় মতো। কথা আর বাড়ালাম না। চা খাওয়া শেষে তাকে বিদায় দিলাম।

আমার আজকাল মনে হয়, দুঃসময়ের কথা মানুষ সহজে ভুলে যায়। ’৮৮ সালে ঢাকায় বন্যা হয়েছিল এই কথা এখন আর আমাদের কারও মনে নেই। সেই সময় মতিঝিলে নৌকা চলত। মিরপুর থেকে সবাই নৌকায় চড়ে কলেজ গেটে নামতেন। এই যুগে সব কিছুই গল্প মনে হবে। অতীত মনে না থাকলে বর্তমানে যা খুশি তা করা যায়। অতীতকে মনে রেখে সামনে গেলে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিছু দিন আগে এক সময়ের একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী এসেছিলেন আমার কাছে। তার এখনকার কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন। আমি মন দিয়ে সব শুনছিলাম। তারপর বললাম, আপনার স্বামীর তো অনেক সম্পদ ছিল। ঢাকার অভিজাত এলাকায় আপনাদের নিজের বাড়ি ছিল। আপনাদের দাপুটে অবস্থান সবারই জানা। সেই অভিনেত্রী বললেন, ভাই চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। এক সময় সব ছিল। স্বামী জীবিত থাকতেই সব শেষ। কারণ আছে, সেই কারণটা তিনি বললেন না। আমি জানি। সেই ভদ্রলোক নিয়মিত ঢাকার বড় বড় অভিজাত ক্লাবে যেতেন। জুয়া খেলতেন। সেই জুয়াতেই সর্বনাশ হয়ে যায়। তখন হয়তো ভাবতেও পারেননি, একদিন এই জুয়ার খেসারত তার পরিবারকে দিতে হবে। কিন্তু প্রকৃতি নিষ্ঠুর ও রহস্যময়। জুয়ার দানে বেশি দিন চলা যায় না। টাকার জুয়ার চেয়ে রাজনীতির জুয়া আরও ভয়াবহ। ক্ষমতায় থাকতে সবাই মনে করেন, এই জুয়াতে ঝুঁকি কম। কিন্তু বাস্তবে এই জুয়া ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আমি দেখেছি, রাজনীতির জুয়াতে ভিড় জমে ক্ষমতাসীন দলে। এক পর্যায়ে কেউ কেউ লাভ নিয়ে সটকে পড়েন। লোকসানকারীরা ভোররাতে সব হারিয়ে নেমে আসেন রাস্তায়। তারা তখন চোখে অন্ধকার দেখেন। তাই শুধু তেলবাজি করে লাভ নেই। তেলবাজি নিয়ে কবি নজরুল অনেক আগেই লিখে গেছেন, সাহেব ও মোসাহেব কবিতা। “সাহেব কহেন,  ‘ঝিমাইনি, কই এই ত জেগেই রয়েছি।’

মোসাহেব বলে, হুজুর জেগেই রয়েছেন, তা আগেই সবারে কয়েছি।”

বাস্তবতার সঙ্গে থাকুন। মোসাহেবী বাদ দিয়ে ভাবুন আগামী নিয়ে। এখন তো সবাই আওয়ামী লীগার। তাই অনেকে বাস্তবতা বুঝতে পারছেন না। আবার অনেকে হয়তো ভুলে গেছেন, এক সময় বাংলাদেশে ফ্রিডম পার্টি বলে একটি দল ছিল। সেই পার্টির নেতা-কর্মীরা হাওয়াতে মিলিয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, হাওয়াতে মিলিয়ে যায়নি। তারা মিশে গেছে বিভিন্ন দলে। এমনকি আওয়ামী লীগেও অনেকে আশ্রয় নিয়েছে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে হামলার আসামিও এই শহরে ভাব নিয়ে আছে। আর আসামির এক সহযোদ্ধা আওয়ামী লীগে এখন প্রভাবশালী। এভাবে চললে জুয়ার বোর্ডের মতো ভোররাতে বিজয়ীরা যাবেন হাসিমুখে। পরাজিতরা সব হারিয়ে পথে বসে যাবেন।

            লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর